বই থেকে নেয়া

মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে-(৪০)

‘রাজনীতিতে শুরু হয়েছে এক নতুন ধরনের লীলাখেলা’

স্টাফ রিপোর্টার

৩ মে ২০২১, সোমবার, ১২:০৩ অপরাহ্ন

বৃহস্পতিবার ৩০ আগস্ট ২০০৭ দিন ১৪০
আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই রোজা রাখা হয়। গতরাতে আমি বিশেষ নামাজ আদায় করেছি ও আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে ও অসীম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে আজ রোজা রেখেছি। একই সাথে আমি সারা বিশ্বের গরিব, অসহায়, সুবিচারবঞ্চিত আবালবৃদ্ধবণিতা, জীর্ণ কুটির ও ফুটপাতে খোলা আকাশের নিচে আবাসহীন পড়ে থাকা জনতা, বন্যাক্রান্ত, দুর্ভিক্ষপীড়িত ও নির্যাতিত জনমানবগোষ্ঠী, প্যালেস্টাইন-আফগানিস্তান-ইরাক-বসনিয়ার অসহায় মানবকুল এবং বাংলাদেশের জেলখানায় অন্তরীণ সকলের স্ত্রী, সন্তান, পরিবারের জন্য মহান আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করেছি।
অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার জন্য ক্যাঙ্গারু কোর্টগুলোর মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা চলছে। মামলার মেরিট এবং সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তি বিবেচনা না করেই ন্যূনতম শাস্তি না দিয়ে আদেশ দেয়া হচ্ছে সর্বোচ্চ সাজার। আমানকে ১৩ বছরের, নাসিরকে ১৩ বছরের, মহিউদ্দীন খান আলমগীরকে ১৩ বছরের, মিজানুর রহমান মিনুকে ১৩ বছরের সাজা দিয়ে তাদের জরিমানা প্রদান ও সম্পদ জব্দ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া যায়নি তাদেরও ৩ বছর বা ৫ বছরের সাজা দেওয়া হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বিচারকরাও অবাধে এবং স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন না।

শুক্রবার ৩১ আগস্ট ২০০৭ দিন ১৪১
আজ আনার জন্মদিন। সে পা দিয়েছে ২২ বছরে। প্রাইমারি পালমুনারি হাইপার টেনশন সমস্যার কারণে আসিফের অকাল মৃত্যু ও আমানের প্রতিবন্ধী অবস্থায় আশঙ্কিত হয়ে আমরা অনেক বছর আর কোনো সন্তান পাওয়ার কথা চিন্তা করিনি। ৯ বছর পরে আশঙ্কাজর্জরিত অবস্থায় বোস্টনের ব্রিগহ্যাম অ্যান্ড উইমেন হসপিটালে জন্মলাভের পর প্রফেসর ফাইলার আমাদের আশ্বস্ত করে বললেন যে, আনা তার দুই ভাইয়ের মতো রক্তে হাইপার গ্লাইসেনিমিয়া থেকে মুক্ত। ১৯৮৪ সালে আমরা আজমীরে খাজাবাবার দরবারে গিয়ে স্বাভাবিক একটি পুত্র বা কন্যার জন্য তার দোয়া কামনা করি। ঢাকায় ফেরার পথে খবর পাই যে, দেশে ফেরার পরই আমাকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে। সাথে সাথে আমি স্বেচ্ছানির্বাসনে চলে যাই লন্ডনে আর আমানকে নিয়ে হাসনা ফিরে যায় ঢাকায়। ১৯৮৫ সালের এই দিনে আনার জন্ম। আট পাউন্ড ওজন নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই ভূমিষ্ঠ হয় আনা। আমি তার প্রথম কান্না শোনার জন্য ডেলিভারি থিয়েটারের বাইরে অপেক্ষা করছিলাম অধীর আগ্রহে।

কিন্তু একজন রাজনীতিবিদের কন্যা হিসেবে আনাকেও অশেষ বিপর্যযের শিকার হতে হয়েছে। তার মাত্র পাঁচ বছর বয়সকালে আমি যখন ১৯৯০ সালে আমাদের সরকারের পতনের পর আত্মগোপনে ছিলাম, তখন আমাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসীরা আমার বাড়িতে হামলা চালিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। সে সময় মার্কিন রাষ্ট্রদূত বিল মাইলাম আমার পরিবারকে রক্ষা করার সব ব্যবস্থা করেন।

পরে বারিধারায় আমার এক বন্ধুর বাসায় আত্মগোপনে থাকাকালীন আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রথমে আমাকে অন্তরীণ রাখা হয় আমার নিজের বাড়িতে ও পরে আমাকে পাঠানো হয় জেলখানায়। সে সময় বর্তমানের এই একই সেলে আমি আটক ছিলাম তিন মাসেরও বেশি সময়।

আমি জানি না আজ আনা কীভাবে তার জন্মদিন পালন করছে। কোথায় আছে। তার মা ও আমান?

শনিবার ১ সেপ্টেম্বর ২০০৭ দিন ১৪২
আজ বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। আমি ছিলাম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন। কেবলমাত্র দল গঠনে নয়, গণতন্ত্রের উত্তরণের লক্ষ্যে সংবিধানে প্রাসঙ্গিক সংশোধনী নিয়ে আসার ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আমি রেখেছি।

বেগম জিয়াকে শেরেবাংলা নগরে প্রেসিডেন্ট জিয়ার কবর জিয়ারত ও মোনাজাতের জন্য বাসা থেকে বের হতে দেওয়া হয়নি। এভাবে শেখ হাসিনাকে কারাবন্দি করে খালেদা জিয়াকেও একরকম গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে ।

রবিবার ২ সেপ্টেম্বর ২০০৭ দিন ১৪৩
দুই মাসের বেশি সময় ধরে আমি আমার আইনজীবীদের সাথে পরামর্শ করতে পারছি না। অথচ যে কোনো মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য নাগরিকদের এটা হলো এক চিরন্তনভাবে স্বীকৃত অধিকার। চৌদ্দ দিন হয়ে গেল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবের জবাবও আমি পাইনি। আজ আমি তাকে আরো একটি চিঠি পাঠিয়েছি। বাহ্যত কারো সাথে কোনো যোগযোগের সুযোগ আমার নেই। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব বা আইনজীবী কারো সাথেই আমাকে যোগাযোগের সুযোগ যদি না দেয় তাহলে সাধারণ একজন নাগরিকের ক্ষেত্রে কী ঘটছে তা সহজেই অনুমেয়। পরিস্থিতি নিশ্চয়ই হবে তাদের জন্য আরো ভয়াবহ। কী ধরনের সুবিচার তারা আশা করতে পারে?
দেশের ভবিষ্যৎ এখন পুরোপুরি নির্ভর করছে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার বলিষ্ঠতা ও দূরদর্শিতার ওপর।

সোমবার ৩ সেপ্টেম্বর ২০০৭ দিন ১৪৪
আজ প্রত্যুষে বেগম খালেদা জিয়া ও তার ছেলে আরাফাত রহমান কোকোকে তাদের বাসা থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনার হ্যান্ডেলিং-এর চুক্তিতে দুর্নীতিসংক্রান্ত একটি অভিযোগে গ্রেপ্তার করে আদালতে হাজির করা হয়েছে। আদালতে বেগম জিয়া নিজেকে ও তার দুই সন্তানকে নির্দোষ বলে দাবি করেছেন। কিন্তু আমাদের সম্পর্কে কিছু বলেননি। এরপর খালেদা জিয়াকে নিয়ে যাওয়া হয় শেরেবাংলা নগরে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারদের জন্য বানানো ভবনে যাকে রূপান্তরিত করা হয়েছে সাব-জেলখানায়। শেখ হাসিনাকে কারারুদ্ধ করে রাখা হয়েছে একই জায়গায়। কোকোকে ৭ দিনের জন্য রিমান্ডে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। একই মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে সাবেক নৌমন্ত্রী মরহুম আকবর হোসেনের স্ত্রী ও পুত্রকে। এই মরহুম আকবর হোসেনের বিরুদ্ধে একসময় ডেনমার্কের সরকার সরকারিভাবে দুর্নীতির অভিযোগ এনেছিলেন।

অন্যদিকে খুলনায় বার্জ মাউন্টেড পাওয়ার প্ল্যান্ট সংশ্লিষ্ট আর এক দুর্নীতিবিষয়ক ফৌজদারি মামলায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। এতে সহ-অভিযুক্ত করা হয়েছে সাবেক বিদ্যুৎ সচিব তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীকে।

খালেদাকে গ্রেপ্তারের পর দুই নেত্রীই এখন জেলে। এভাবে দেশের রাজনীতিতে শুরু হয়েছে এক নতুন ধরনের লীলাখেলা।

গ্রেপ্তার হওয়ার আগের রাতে খালেদা জিয়া দলের চেয়ারপার্সন হিসাবে দলীয় গঠনতন্ত্রে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে আবদুল মান্নান ভূঁইয়াকে বিএনপির মহাসচিব ও প্রাথমিক সদস্য পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছেন এবং তার স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে  খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে।

এ দুই জনপ্রিয় রাজনীতিককে জেলখানায় আটকিয়ে রাখার ঠেলা দুর্বল এই সরকার কীভাবে সামাল দেবে তা নিয়ে চিন্তাও করা যায় না। সরকারের নিশ্চয়ই মতিভ্রম ঘটেছে। অবশ্য মতি বলে কিছু যদি তাদের থেকে থাকে!

মঙ্গলবার ৪ সেপ্টেম্বর ২০০৭ দিন ১৪৫
বিকেলে হঠাৎ করেই আমার ডাক এলো জেলগেট থেকে। আমার সম্পত্তি ও আয়ের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়েরকৃত মামলাসংক্রান্ত বিষয়ে প্রশ্ন করতে মেজর রেদোয়ানের নেতৃত্বে ৪ সদস্যের একটি টাস্কফোর্স প্রতিনিধিদল এসেছে। আইনের কোন বিধিবলে তারা এসেছে জিজ্ঞেস করাতে তদন্তকারী অফিসার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সেনাবাহিনীর মেজরের দিকে তাকালেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের ১১নং বিধিবলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দুর্নীতিসংক্রান্ত বিষয়ে লিখিতভাবে নোটিশ দিলে একজন আইনজ্ঞের উপস্থিতিতে তদন্তকারী তার সাথে কথা বলতে পারেন বা একটি লিখিত জবাবের মাধ্যমে তিনি অভিযোগ বিষয়ে অস্বীকৃতিও জানাতে পারেন। এসব নিয়ম পালন না করাতে আমি কোনো প্রশ্নের জবাব দিতে অস্বীকার করলাম। কারণ, আমি জানতাম যে, নোটিশ ব্যতিরেকে যা-ই বলি না কেন তারা আমার বিরুদ্ধে তা সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। সংবিধানের ৩৫(৪) অনুচ্ছেদবলে ক্ষমতার এ ধরনের অপব্যবহার প্রয়োগ থেকে নাগরিকদের রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। তাদেরকে দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনের ধারাগুলো সম্পর্কে অবহিত করার পর আর কোনোদিন তারা আমার সাথে দেখা করার চেষ্টা করেনি।
এভাবেই দুর্নীতি দমন কমিশন নিজেদেরই প্রণয়ন করা আইন ভঙ্গ করে। প্রতিনিয়ত রাজনীতিবিদ ও অন্যান্যদের তাড়াহুড়ো করে সাজা দেওয়ার লক্ষ্যে তদন্তকার্য পরিচালনা করে চলেছে। এতে করে ক্যাঙ্গারু কোর্টগুলো তাদের দোষী সাব্যস্ত করে সাজা দিতে পারে। কিন্তু সুপ্রীম কোর্টে আপিল করা হলে এসবের কোনোটাই আর টিকবে না।
বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিষয়ক বইটি লেখার কাজ আমি ইতিমধ্যে অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছি। কিন্তু এ নিয়ে আমি যতই লেখায় অগ্রসর হচ্ছি ততই শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া উদীয়মান সেই গণতন্ত্রকে সুসংহত না করার জন্য দায়ী কিনা তা পর্যালোচনা করছি। বর্তমানে আমি বইয়ের সেই অধ্যায়টিই লিখছি।


(চলবে..)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৪)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৫)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৬)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৭)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৮)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৯) 
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১০)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১১)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১২)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৩)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৪)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৫)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৬)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৭)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৮)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৯)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২০)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২১)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২২)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২৩)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২৪)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২৫)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২৬)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২৭)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২৮)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২৯)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩০)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩১)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩২)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩৩)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩৪)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩৫)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩৬)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩৭)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩৮)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩৯)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status