শেষের পাতা

বিশ্বনাথে সুমেল হত্যা

হাওরের ‘ভয়ঙ্কর’ সাইফুলের সন্ধানে পুলিশ

ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে

৩ মে ২০২১, সোমবার, ৯:৩০ অপরাহ্ন

‘ভয়ঙ্কর’ হয়ে উঠেছে সিলেটের বিশ্বনাথের চাউলধনী হাওরের খাদক সাইফুল ইসলাম। সর্বশেষ গত শনিবার হাওরের বুকে প্রকাশ্য গুলি করে  স্কুলছাত্র সুমেলকে হত্যা করেছে সে। এর আগে বৃদ্ধ দয়াল হত্যা মামলার সে প্রধান আসামি ছিল। সুমেলকে খুনের পর লাপাত্তা সাইফুল। পুলিশ তাকে হন্যে হয়ে খুঁজেও পাচ্ছে না। দেশ ছেড়ে পালাতে না পারে সে বিষয়ে সতর্ক রয়েছে পুলিশ। এদিকে এলাকায় ক্ষোভ কমছে না। সুমেল হত্যার ঘটনার হাওরের তীরবর্তী ২৫-৩০টি গ্রামের মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। তারাও খুঁজছেন সাইফুলকে। কারণ বিশ্বনাথের খাদ্যভাণ্ডার বলে পরিচিত হচ্ছে চাউলধনী হাওর। এই হাওরের ‘নীরব’ সন্ত্রাস চালাচ্ছে সাইফুল ইসলাম নামের স্থানীয় এক লন্ডন প্রবাসী। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে সে হাওর দখলে নিয়ে অস্ত্রবাজ সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিল। প্রবাসী অধ্যুষিত বিশ্বনাথের চাউলধনী হাওরে জমির পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার একর। এর মধ্যে মাত্র ১৭৮ একর ভূমি রয়েছে সরকারি। দশঘর মৎসজীবী সমিতির নামের স্থানীয় ইসলামপুর গ্রামের লন্ডন প্রবাসী সাইফুল ইসলাম প্রায় ১৫ বছর আগে মাছ ধরার জন্য ওই ১৭৮ একর ভূমি লিজ আনেন। এরপর থেকে হাওরে অত্যাচার শুরু করে সাইফুল ইসলাম। গত ৩রা এপ্রিল এ নিয়ে সিলেটে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন হাওরপারের কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দারা। তারা জানিয়েছেন, সাইফুল জেলেদের নামে লিজ এনে গোটা হাওরকেই গ্রাস করা চক্রান্ত চালায়। হাওরের তার লিজের বাইরে রয়েছে ব্যক্তি মালিকাধীন কয়েকটি ডোবা ও পুকুর রয়েছে। এসব ডোবা ও পুকুরকে তার লিজের আওতাধীন এলাকা ঘোষণা দিয়ে জোরপূর্বক মাছ ধরে নিয়ে যায়। সে অন্য জমি থেকে ৫০-৬০ লাখ টাকার মাছ লুটে নেয় বলে অভিযোগ করেন তারা। সিলেট অঞ্চলে সাধারণত আশ্বিন-কার্তিক মাসে বিলে মাছ ধরা হয়। কিন্তু সাইফুল ফাল্গুন ও চৈত্র মাসে এসে বিল সেচে পানি সরিয়ে ফেলে। এ সময় মাছ ধরতে সে হাওরকে পানিশূন্য করে দেয়। এতে করে প্রায় ৩০-৩৫ হাজার কৃষক ক্ষতির মুখোমুখি হন। এবার চাউলধনী হাওরের অধিকাংশ ভূমিই পানির অভাবে ছিল ফসলশূন্য। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, গত দুই বছর ধরে সাইফুল হাওরে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। কাউকে পরোয়া করেনি। নিজেকে আওয়ামী লীগ কর্মী পরিচয় দিয়ে, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির নিকটজন বলে পরিচয় দেয়। সম্প্রতি সময়ে সে বিশ্বনাথ থানার ওসি শামীম মুসার ‘বন্ধুু’ বলেও পরিচয় দেয়। এতে করে সে অনেকটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল চাউলধনী হাওর ও আশেপাশে এলাকায়। তার বিরুদ্ধে দফায় দফায় বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দিয়েও কোনো ফল পাননি এলাকাবাসী। গত এক সপ্তাহ ধরে চাউলধনী হাওরের মধ্যখান দিয়ে ইসলামপুর গ্রাম থেকে লামা টুকেরবাজার পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণকাজ শুরু করেন সাইফুল ইসলাম ও তার সহযোগীরা। এই রাস্তা নির্মাণের সময় বিভিন্ন ব্যক্তি মালিকানাধীন ভূমি থেকে জোরপূর্বক মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছিলেন সাইফুলের লোকজন। এতে করে বাধা দিয়েছিলেন ভূমির মালিক নজির আহমদসহ স্থানীয় লোকজন। এ নিয়ে দ্বন্দ্বের জের ধরে গত শনিবার বিকালে সাইফুল ইসলাম নিজের এক নলাবন্দুক দিয়ে প্রতিপক্ষের ওপর হামলা চালায়। এক পর্যায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান স্থানীয় শাহজালাল (রহ.) উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র সুমেল আহমদ শুকুর। স্থানীয় চৈনত্যনগর গ্রামের নজির উদ্দিন জানান, ‘আমাদের কৃষি জমি থেকে সাইফুল জোরপূর্বকভাবে মাটি কাটছে খবর পেয়ে আমরা সেখানে গিয়ে বাধা দেই। এ সময় সাইফুল তার হাতে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে আমাদেরকে লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি করে। সাইফুলের করা গুলিতে আমার ভাতিজা সুমেল মারা যায়। এ ছাড়া আমার প্রবাসী ভাইসহ চারজন গুলিবিদ্ধ হই। এ ছাড়া আমাদের পক্ষের আরো কয়েকজন আহত হয়েছেন।’ পলাতক হওয়ার আগে সাইফুল আলম সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ‘এলাকার মুরব্বিদের দেয়া পূর্ব নিধারিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সড়কের মাটি কাটতে গেলে তারা নজিরের লোকজনেরা আমাদের ওপর হামলা চালায়। হামলায় আমাদের বেশ কয়েকজন আহত হন। এ সময় নজিরের ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসীরা আমাদের লক্ষ?্য করে গুলি করে।’ বিশ্বনাথ থানার ওসি শামীম মুসা জানিয়েছেন, সাইফুলের কাছে একটি এক নলা বন্দুক রয়েছে। এই বন্দুক তার বৈধ বলে জানা গেছে। ওই বন্দুক থেকে সে নিজেই গুলি করে সুমেলকে খুন করেছে প্রাথমিক তদন্তে মিলেছে। ফলে ঘটনার পর থেকে পুলিশ সাইফুলকে খুঁজছে। কিন্তু তাকে পাওয়া যাচ্ছে না।’ তিনি জানান, ‘ঘটনার পর সাইফুলই প্রথম ফোন করে পুলিশকে বিষয়টি জানিয়েছিলেন। তিনি পাল্টা অভিযোগ করেছিলেন তাকে গুলি করা হয়েছে। কিন্তু তাকে গুলি করার কোনো প্রমাণ মিলেনি। স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, সাইফুল ও তার সহযোগীদের কাছে বেশ কয়েকটি আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। এসব আগ্নেয়াস্ত্র দিয়েই সে ও তার লোকজন হাওরে নীরব সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে। এর আগে গত ২৮শে জানুয়ারি হাওরের জোরপূর্বক মাছ ধরাকে কেন্দ্র করে বৃদ্ধ ছরকুম আলী দয়ালকে হত্যা করা হয়েছিল। এ ঘটনায় তাজুলসহ ১০-১২ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়েছিল। ওই মামলার পর আসামিরা প্রকাশ্য বেড়ালেও পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করেনি বলে সিলেটের সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেছিলেন। আসামি অবস্থায় বিশ্বনাথ থানায় সাইফুল ইসলাম বসে আড্ডা দিয়েছে বলে অভিযোগ করেন স্থানীয়রা। বিশ্বনাথের ওসি জানান, ওই মামলায় সাইফুলকে আসামি করা হলেও পরবর্তী সময় ময়নাতদন্ত রিপোর্টে জানা গেছে, দয়াল হার্টঅ্যাটাকে মারা গেছেন। পুলিশ এ ঘটনায় আদালতে ইতিমধ্যে চার্জশিট দিয়েছে। সাইফুলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন ওসি শামীম মুসা। এদিকে সাইফুলের প্রশ্রয়দাতা হিসেবে স্থানীয়রা অভিযুক্ত করেছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পংকিখানকে। প্রকাশ্যই তারা পংকিখানের বিরুদ্ধে এ নিয়ে বিষোদাগার করেন। তবে মানবজমিনকে পংকিখান জানিয়েছেন, সাইফুল আওয়ামী লীগের একজন কর্মী। সে মাঝেমধ্যে আমার অফিসে আসে। তবে, চাউলধনী হাওর কেন্দ্রিক ঘটনার সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত নন জানান। খুনি, সন্ত্রাসীদের সঙ্গে তার সংখ্যতা নেই। যারা দোষী হবে পুলিশ অবশ্যই তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসবে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status