মত-মতান্তর

অনলাইনে শিক্ষাঃ মান, গ্রহণযোগ্যতা এবং উহার নিয়ন্ত্রণ

ড. শেখ মাহাতাবউদ্দিন

২ মে ২০২১, রবিবার, ৫:৪০ অপরাহ্ন

করোনা বা কোভিড-১৯ মহামারির বর্ষ পূর্তিতেও তার তাণ্ডব বেড়েছে, বৈ কমেনি! এই তাণ্ডবে সকল কিছুই লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছে, যার মধ্যে শিক্ষাখাতে অপূরণীয় ক্ষতি যুক্ত হচ্ছে। যদিও সমন্বিত প্রচেষ্টা এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা শিক্ষা খাতকে খুব সহজেই এই ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারে। রক্ষা পেতে পারে আমাদের অনাগত ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এবং ভবিষ্যতের সম্মানিত নাগরিকগণ। আজ যারা স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে পড়ছে তারাই কিন্তু আগামী দিনের পেশাজীবী কিংবা চাকরিজীবী। তাই দেশের ভবিষ্যৎ বিবেচনাতে তাদের সঠিক শিক্ষা এবং মানসম্পন্ন মূল্যায়ন পদ্ধতি একান্ত জরুরি একটি মৌলিক অধিকার বলেই বিজ্ঞজনেরা একমত হবেন। করোনার এই তাণ্ডবের আকস্মিকতাতে অনেকে দেশেই শিক্ষাখাত থমকে দাঁড়িয়েছিল কিন্তু ধীরেধীরে তারা আবার গতিশীল হয়েছে। অনলাইন এবং ফিজিক্যাল মিলিয়ে তারা মিক্সড পদ্ধতিতে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে যেন ভবিষ্যতের কাণ্ডারিরা এই তাণ্ডবের কাছে হার মেনে হারিয়ে না যায়।
প্রচলিত শিক্ষা মূলত তিনটি বিষয়ের উপর নির্ভরশীল-

১। যুগোপযোগী এবং বাস্তবতার নিরিখে বিষয়ভিত্তিক সঠিক জ্ঞানের আধার প্রতিষ্ঠা করা
২। এই জ্ঞান শিক্ষার্থী পর্যায়ে বোধগম্য, আকর্ষণীয় এবং সহজলভ্য করে তুলার মত করে বিতরণ করা এবং
৩। শিক্ষার্থীরা বিতরণকৃত জ্ঞানের কতটুকু নিতে পারে এবং কত অংশ বাস্তবতার নিরিখে ব্যবহার করতে জানল তা পরীক্ষা করে দেখা। এই তিন পদ্ধতির সমন্বয় ক্লাসরুম এবং ফিজিক্যাল পরীক্ষা নিয়েই করা হয়েছিল যুগযুগ ধরে। এখন করোনাকালীন সময়ে এসে আমরা এই তিনের সঠিক সমন্বয় করতে না পারার ভয়েই শিক্ষা ব্যবস্থাকে একরকম ফ্রোজেন করে রেখেছি। কিন্তু কতদিন রাখতে পারব বা অন্য ভাষাতে বললে আমাদের মত একটি উন্নয়নশীল জাতি এমন একটি অচল অবস্থা কতদিন সহ্য করতে পারবে? পক্ষপাতহীন উত্তর হবে আর এক মুহূর্তও নয়! তাহলে কিভাবে আমরা সঠিক মান নিয়ন্ত্রণ করে ও গ্রহণযোগ্য উপায়ে উক্ত তিন মূল্যবান বিষয় নিশ্চিত করে উন্নত বিশ্বের মত করে অনলাইন এবং ফিজিক্যাল শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করব?

এ বিষয়টি মোটাদাগে চারটি গুরুত্বপূর্ণ পিলারের উপর নির্ভরশীলঃ
১। অনলাইন শিক্ষা গ্রহণের গ্যাজেট এর সহজলভ্যতা
২। শিক্ষকের অনলাইন কিংবা অফলাইনে শিক্ষা প্রদানের যোগ্যতা
৩। শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে এই কাজ সুচারু রুপে সমন্বয় করার মত দক্ষ জনবল
৪। শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক লেভেলে সততা এবং নৈতিকতা পূর্ণ আচরণ নিশ্চিত করা।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার স্তর চারটি, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্যায়ের শিক্ষা। আমার এই চার স্তরেই শিক্ষকতা এবং গবেষণা করার অভিজ্ঞতা রয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ্। সেই অভিজ্ঞতা এবং গত এক বছরের অনলাইনে শিক্ষা প্রদানের বাস্তবিকতার আলোকে আমাদের দেশে এই ফিজিটাল (ফিজিক্যাল + ডিজিটাল) শিক্ষার বাস্তবতা তুলে ধরতে চেষ্টা করব।
প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে গেজেট এর কিছুটা সমস্যা থাকবে তবে বেশীরভাগ মানুষের হাতেই এখন অ্যান্ড্রয়েড ফোন আছে এবং গ্রামঞ্চলে এখনো করোনার প্রকোপ খুবই কম। সুতরাং এই লেভেলে চাইলেই আমরা ফিজিটাল পদ্ধতি চালু করতে পারি কিন্তু বড় সমস্যা হচ্ছে বিগত কয়েক দশকে শিক্ষাখাতে ডেডিকেটেড শিক্ষক নিয়োগের যে অনীহা আমরা দেখিয়েছি সেই বাঁধা অতিক্রম করা। এই বাঁধা অতিক্রম করতে শিক্ষকগণের ব্যাপক প্রশিক্ষণ চালু করতে হবে এবং তা অনতিবিলম্বেই। কারন এই সিদ্ধান্তহীনতাতে ভুগতে ভুগতেই আমাদের বিদ্যার্থীদের একটি মূল্যবান বছর আমরা নষ্ট করে ফেলেছি। একটি উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার, যা মানুষের জীবনের মোড় ঘুরানোর জন্য সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা, সঠিক মূল্যায়ন না করেই এই ক্ষেত্রে আমাদের অটোপাশ দিতে হয়েছে! অথচ কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়িয়ে এবং থানা ভিত্তিক ব্যবস্থাপনা করেই নুন্যতম মূল্যায়ন করে হলেও এই ফলাফল দেয়া অসম্ভব কিছু ছিল না! সে যাই হোক, এখন সামনের দিন গুলোতে আমাদের ফিজিটালের কোন বিকল্প নেই। যেখানে প্রতিটি শ্রেণীকক্ষে একটি ওয়েবক্যাম থাকবে আর শিক্ষার্থীদের জন্য সামাজিক দূরত্ব নিয়ে বসার ব্যবস্থা থাকবে। শিক্ষকের ক্লাস লাইভ হবে যেসকল শিক্ষার্থী ক্লাসে আসতে পারছে না তারা ডিজিটাল উপায়ে সেই ক্লাস দেখবে। প্রয়োজনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাপ কমানোর জন্য ক্লাস ভিত্তিক রুটিন হতে পারে। যেমন ক্লাস নাইন-টেন দুই দিন, সেভেন-এইট দুই দিন এবং ফাইভ-সিক্স দুই দিন। কিছু ক্লাস পূর্ণ অনলাইন এবং কিছু ক্লাস ফিজিটাল। খুব সহজেই শিক্ষার্থীদের নিকট জ্ঞানের পরিচলন নিশ্চিত করবে। এখন আসে মূল্যায়ন পদ্ধতি। আমাদের দেশের ক্ষেত্রে এই লেভেলে অনলাইন মূল্যায়ন করা অসম্ভব। কারণ আমাদের অনেক অভিভাবকই শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁশ করে দিতে পারলে নিজেদের দায়িত্বশীল ভাবেন! সেহেতু মূল্যায়ন রোটেশন পদ্ধতিতে ফিজিক্যালই হবে। এ বিষয়ে বিস্তারিত এই লেখাতে রয়েছে, এইচএসসি-২০২০ পরীক্ষা এবং অতীত অভিজ্ঞতা থেকে একটি প্রস্তাবনা। এই পদ্ধতি বাস্তবায়নে কালবিলম্ব না করে  প্রকৃত যোগ্য এবং অভিজ্ঞ শিক্ষকগণের সমন্বয়ে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করতে হবে।
প্রশ্ন হল বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে তাহলে কিভাবে সম্ভব? বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ফিজিটাল পদ্ধতিতে শিক্ষাদান আরও সহজতর হবে। কারণ এখানে প্রায় ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর হাতে অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল যা তাদের অনলাইন ক্লাসে সহযোগিতা করবে। একই সাথে যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীর ঘনত্ব অনেক কম সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ফিজিক্যাল ক্লাসও সম্ভব। ল্যাব নির্ভর বিষয়গুলোতে ফিজিক্যাল ক্লাসের বিকল্প নেই। এই সমস্যা সমাধানে জাপান, অ্যামেরিকা, অস্ট্রেলিয়া কিংবা যুক্তরাজ্যে আমাদের বন্ধুরা শিক্ষার্থীদের ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত করে অনেকগুলো ক্লাসের মাধ্যমে সঠিক ব্যবহারিক শিক্ষা নিশ্চিত করছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়েও আমরা এই ব্যাবস্থা শুরু করেছিলাম এবং সামনে আরও কার্যকর ভাবে করার পরিকল্পনা করছি। যা আমাদের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনের উপর এই প্যান্ডেমিকের বিরূপ প্রভাব কমাতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। এই লেভেলে পরীক্ষা সংক্রান্ত বিষয়টি আরও সহজ ভাবে সমাধানযোগ্য আর তা হল ওপেন বুক এক্সাম এবং সফটওয়্যার ভিত্তিক পরীক্ষা।
ওপেন বুক এক্সাম নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের এস জেড হায়দার স্যারের একটি বিখ্যাত গল্প রয়েছে। স্যারের শিক্ষার্থীরা স্যারের প্রশ্ন কঠিন বলে অভিযোগ করে দাবি তুলল এমন প্রশ্নে বই নিয়ে বসেই কেবল ভালো পরীক্ষা দেয়া সম্ভব! স্যার বুঝালেন যে বই না পড়াশুনা ভালো ভাবে করলেই ভালো করা যাবে। শিক্ষার্থীরা নাছোড়বান্দা, স্যার বললেন ঠিক আছে তাহলে অমুক দিন ওপেন বুক এক্সাম হবে। যে যেই বই পারে নিয়ে আসবে পরীক্ষার হলে এবং বই দেখে দেখেই পরীক্ষা দিবে! ফলাফল অবিসম্ভাবি যারা পড়াশুনা করেই বই এর আশা না করে হলে গিয়েছিল তাদের পরীক্ষাই ভালো হয়েছিল! অর্থাৎ, সঠিক মানের এবং পূর্ণ কগনিটিভ ডোমেইন এর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মত প্রশ্ন করলে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অনলাইন এবং অফলাইন পরীক্ষার কোন ভেদাভেদ থাকে না। সমস্যা হল এমন প্রশ্ন করতে জানা ফ্যাকাল্টি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আছে কত শতাংশ! অ্যামেরিকার শিক্ষা বিষয়ক গবেষণাতে শীর্ষে থাকা ইউ সি, বারকলে এর গ্র্যাজুয়েট ট্রেনিং সেন্টারের ডীন একটি প্রশিক্ষণে আমাদের বলেছিলেন শিক্ষক হবার সর্বাপেক্ষা বড় গুণ হচ্ছে সঠিক প্রশ্ন করতে জানা যা আমাদের শিক্ষার্থীদের পরিপূর্ণ মূল্যায়ন করতে সহযোগিতা করবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণের জন্য এই ট্রেনিং যোগ্য  এবং যারা জানেন তাদের নেতৃত্বে চালু করা এখন সময়ের দাবি। যা আমাদের দেশের ওপেন সিক্রেট খ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের হাজারো অনিয়মের মাধ্যেমে ঢুকে পরা কম যোগ্যতা সম্পন্ন শিক্ষকদের যোগ্যতা বৃদ্ধিতেও সহায়ক হবে এবং শিক্ষার্থীরা সঠিক মানের শিক্ষার সান্নিধ্যে আসতে পারবে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হলে আমাদের শিক্ষার্থীদের যে জি আর ই পরীক্ষা দেয়া লাগে এটাও অনলাইন! কিন্তু এর মান নিয়ে আজও কোন প্রশ্ন আসেনি। অর্থাৎ সঠিক শব্দচয়নের মাধ্যমে পূর্ণ টেকনিক্যাল প্রশ্ন করতে জানলেই সঠিক মূল্যায়ন সম্ভব। যার জন্য কোন প্রকারের অনলাইন শিক্ষার প্লাটফর্ম (Learning Module System or LMS) থাকলেই যথেষ্ট।
পরিশেষে বলব, ইচ্ছা, সততা এবং নৈতিকতার সমন্বয় হলে যেকোনো পরিস্থিতিতেই আমাদের বসে থাকতে হবে না। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকই অনলাইন ক্লাসটুকুন নিতে রাজি হচ্ছেন না! আবার অনেকেই এই সিস্টেমের সাথে নিজেকে আপডেট করতে নারাজ! এটা কল্পনার বাইরের জগতের কথা! কারন শিক্ষক হল সেই পেশাজীবী যারা যুগের সাথে নিজেদের সর্বাপেক্ষা বেশি আপডেটেড রাখতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। যেমনটি দেখি আমাদের অনেক বয়স্ক বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসরে যাওয়া কলিগণের মধ্যে! এই বয়সেও উনাদের শিক্ষার আগ্রহের কমতি নাই! অথচ আমরা উনাদের উত্তরসরি হয়ে সামান্য অনলাইন ক্লাসে নিজেদের জ্ঞান কে সহজলভ্য করার মত কারিগরি দক্ষতা শিখতে নারাজ! আমি আশাবাদী এবং আশা করব আমাদের সম্মানিত শিক্ষকগণ প্রকৃতির এই পরিবর্তনের সাথে শিক্ষার্থীদের মঙ্গলের কথা বিবেচনা করে নিজেদের পরিবর্তন করে ফিজিটাল শিক্ষাকে সাধুবাদ জানাবেন। সৃষ্টিকর্তার প্রদত্ত জ্ঞানে বিজ্ঞানের সঠিক ও কার্যকর প্রয়োগ এবং সমন্বিত প্রচেষ্টাই কেবল আমাদের শিক্ষাখাত তথা ভবিষ্যতের কা-ারি শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনকে এই প্যান্ডেমিকের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করতে পারে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে আমরা সহজেই প্রচলিত শিক্ষার তিনটি বিষয় এবং শিক্ষার চারটি স্তম্ভ সঠিক উপায়ে এবং সঠিক মানে নিশ্চিত করতে পারব বলেই আমাদের বিশ্বাস।

লেখক: বিভাগীয় প্রধান, ফুড এন্ড নিউট্রেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ (NFE), ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভারসিটি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status