মত-মতান্তর

মাস্কই আমাদের সবচেয়ে বড় বন্ধু

গাজী মিজানুর রহমান

১ মে ২০২১, শনিবার, ১১:৪১ পূর্বাহ্ন

এই করোনার সময়ের সবচেয়ে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্বকারী প্রতীক, ব্যাজ, লোগো বা এমব্লেম কি হতে পারে ? এর সোজা উত্তর –মাস্ক। কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে মানুষকে সুরক্ষা দিতে সক্ষম সবকিছুর মধ্যে মাস্ক এর নামটা মুখ্য। এ-পর্যন্ত যতজন যত কথা বলেছেন, তার প্রত্যেকটিতে দূরত্ব নিশ্চিত করা এবং মাস্ক ব্যবহার করার সুপারিশ রয়েছে। মাস্ক এর বুনন-সামগ্রী বিষয়ক সুপারিশে তারতম্য থাকলেও মাস্ক-ব্যবহারকে কেউই নাকচ করেননি। মাস্ক ছাড়া চলাচলে নিষেধাজ্ঞা এবং জরিমানা আরোপের বিধান তো আছেই। আবার বলা হচ্ছে – মাস্ক নেই, সার্ভিস নেই। এ-সব কথাই প্রমাণ করে মাস্ক এখনকার দিনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

কোভিড-১৯ শত্রুর আক্রমণে মাস্ক হচ্ছে প্রথম কাতারের সৈনিক – ঠিক পদাতিক বাহিনীর মতো। এরা শত্রুর কাছাকাছি চলে যায়। আর্টিলারি, নেভি আর এয়ার ফোর্স দূর থেকে গোলা ছুঁড়ে যতই প্রতিরক্ষা দিক, প্রিয় শরীর-মানচিত্রের স্পর্শকাতর স্থাপনা, অর্থাৎ নাক-মুখের ঢাল হয়ে প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করা এবং সুস্বাস্থ্যের সার্বভৌমত্বের প্রতীক ঝান্ডা তুলে সরেজমিন দখল বজায় রাখার ব্যাপারে মাস্কের পদাতিক সেনাদের কনো বিকল্প নেই।

মাস্ক এর ব্যবস্থাপনায় কোনো জেন্ডার-পক্ষপাতিত্ব নেই। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে একইরকম মাস্ক পরতে হয়। নারীর জন্য একটা, আর পুরুষের জন্য আর-একটা, এমন কোনো ভেদনীতি প্রচলিত নেই। অন্যদিকে শিশু, যুবা, বৃদ্ধ – নানা বয়সের হিসেব হাজির ক’রে মাস্ক ব্যবহারের প্রয়োজনীতা-অপ্রয়োজনীয়তার জন্য ভিন্ন ভিন্ন নীতি প্রণীত হয় না এখানে। কোনোরকম বৈধতার প্রশ্ন না তুলে সবাই মাস্ক পরছেন। ম্যান, উইম্যান, চাইল্ড, ইয়াংম্যান, ওল্ডম্যান – এসব শব্দের চেয়ে ‘হিউম্যান ‘ কথাটার ওপর মাস্ক-প্রশাসন সম্পূর্ণরূপে আস্থাশীল। যে মানুষ ঘরের বাইরে যাবে, তাকেই পরতে হবে মাস্ক।

মাস্ক পরলে মুখটাকে বন্ধ রাখতে হয়। জরুরি কথা ছাড়া বাড়তি কথা বলার সুযোগ থাকে না। মাস্ক-পরা অবস্থায় উন্মুক্ত মুখের মতন শব্দকে ইচ্ছেমাফিক খেলিয়ে খেলিয়ে ছেড়ে দিয়ে আর কণ্ঠের কারুকাজ দেখিয়ে শ্রোতার হৃদয় গলিয়ে দেয়া যায় না। মাস্ক মুখের উপর একটা হাত চাপা দিয়ে বলে, ‘’ থামুন ! গল্পবাজি বন্ধ করুন ! নিরেট প্রয়োজনের কথা আর খাঁটি কথাটুকু বলুন ! তাতে আপনার ও লাভ, আমারও লাভ। নইলে লালারসে সিক্ত হয়ে আমার যে মরণদশা ঘটছে ! প্রচন্ড ভ্যাপসা গরমে কথা বললে আপনার গলার ভেতর থেকে যে গরম বাস্প বেরিয়ে আসে, তাতে আমার জীবন অতীষ্ঠ হয়ে যায়, তা কি বোঝেন ? মাস্কদের এমন শাসনের পক্ষে তুলে ধরা যুক্তি অকাট্য। তাই যতটা মৃদু স্বরে কথা বলে কাজ হাসিল করা যায়, ততই মঙ্গল।

মাস্কের গড়ন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দু’রকম। একটার গড়ন এন-৯৫ এর মতো একটু টুপির আকার। মুখের উপরে বাটির মতো নাকটাকে কোলের মধ্যে টেনে নিয়ে ওরা বসে। একটা মুরগির মতো চিলের ছোঁ থেকে ছানা দুটোকে বাঁচাতে পাখনার নিচে টেনে নেয়। অন্য প্রকার মাস্ক হচ্ছে ফ্লাট, যেমন সার্জিক্যাল মাস্ক। বুক দিয়ে আগলে রাখার জন্য নাক-মুখের উপর সমান্তরাল ভাবে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকে। ধুলিঝড় আসলে খোলা প্রান্তরে মা যেমন সন্তানকে বুকের সাথে চেপে রাখেন, নিজে পিঠ দিয়ে ঝঞ্ঝা আটকে দেন, ঠিক তেমনি মমতাময়ী মাস্ক সটানভাবে শায়িত শরীর নিয়ে ঝড়-বিপদে নাক-মুখের পরম আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মাস্কের রঙ সাদা এবং নীল। সাদা হচ্ছে পবিত্রতা, আর নীল হচ্ছে উদারতার প্রতীক। তবু ফ্যাশানিষ্ট যারা, তারা কি কখনো দুটো রঙে সন্তুষ্ট থাকেন ? পুরুষেরা টাইয়ের আর কোটের পকেটের রুমালের সাথে রঙ মিলিয়ে মাস্কের রঙ বাছাই করেন। মেয়েরা দোপাট্টার রঙের সাথে বা কোটি আর কার্ডিগানের রঙের সাথে ম্যাচিং করে অর্ডার দিয়ে কাপড়ের মাস্ক তৈরি করিয়ে নেন। এভাবে মাস্ক হয়ে যাচ্ছে নন্দনতত্ত্ব আর স্বাস্থ্যতত্ত্ব উভয়ের প্রতিভূ।

কথায় আছে, নাক দিয়ে কি করবো, নিঃশ্বাস বেরুলেই হলো, অর্থাৎ খাড়া-খাড়া টিকোলো টাইপের শ্রেষ্ঠতম নাকের দরকার নেই, চৈনিক বা জাপানিজ ছোটখাটো নাক হলেই চলবে। সে কেবল শ্বাস-প্রশ্বাসের আসল কাজটা ভালোভাবে করতে পারলেই হলো। এমন বেরসিক মানুষের সংখ্যা বেশি। তারা মাস্ক নিয়ে অত বাছাবাছি করেন না। নাক-মুখের সর্বোচ্চ হেফাজত করতে পারে যে মাস্ক, তার মধ্যে যেটা হাতের কাছে পান, সেটাই পরেন। রঙ এবং ঢঙ নিয়েও তারা খুব বেশি চিন্তিত নন।

মাস্ক যতই মানুষের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস থেকে মানুষকে রক্ষা করুক না কেন, এর ব্যবহার শুরু হয়েছে একটা বিশেষ পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করার জন্য। ব্যবহারটা তাই স্বতঃ স্ফূর্ত নয়। কোভিড -১৯ এসে জোর করে মানুষকে মাস্ক ব্যবহারে বাধ্য করেছে। তাই সবসময় মনে রাখতে হবে, মাস্কের ব্যবহার নিশ্চিত করতে সকলের সহযোগিতা দরকার— যেমন নাক আর মুখের উপর ব’সে থাকতে মাস্ককে সহায়তা দেয় কান দুটো। ওরা সুতোর লুপকে কত কষ্ট করে নিজের ধড়ের সাথে পেঁচিয়ে রাখে ! সেভাবে সমাজের এক জন আরেক জনকে মাস্ক ব্যবহারে সহায়তা দিতে হবে। যেই দেখবে মাস্ক নেই, বলতে হবে— মাস্ক প্লিজ ! যেই দেখবে, এক জনের মাস্ক এর ভেতর থেকে নাকের খানিকটা অংশ বের হয়ে গেছে, তখন বলতে হবে— মাইন্ড ইয়োর নোজ প্লিজ ! এভাবে চলতে থাকুক, যতক্ষণ কোভিড-হিরো জিরো না হয়ে যায়।

(গাজী মিজানুর রহমান, রম্যলেখক এবং প্রবন্ধকার)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status