শরীর ও মন

করোনাকালে ভোগান্তিতে গর্ভবতী নারীরা

ফাহিমা আক্তার সুমি

১ মে ২০২১, শনিবার, ১১:৩৩ পূর্বাহ্ন

করোনাকালে আতঙ্কে দিন যাপন করছেন গর্ভবতী নারীরা। করোনার পূর্বের সময়ের মতো স্বাভাবিক জীবন কাটছে না তাদের। গর্ভধারণ থেকে শুরু করে প্রসব পর্যন্ত নানা ধরনের মানসিক ও শারীরিক ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। প্রসব বেদনায় ছটফট করলেও করোনায় আক্রান্ত অবস্থায় গর্ভবতীদের ভর্তি করছে না বেসরকারি অনেক হাসপাতাল। এরমধ্যে ঝুঁকি নিয়ে সিজারের মাধ্যমে অনেকের ডেলিভারি হচ্ছে। এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ঘুরতে হচ্ছে গর্ভবতীদের।
ঢাকার সাইন্সল্যাবে থাকেন তাহসিন আজাদ নদী। তিনি একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন। তিনি জানান, ৭ই এপ্রিল তার ডেলিভারির দিন নির্ধারণ ছিল। ৩রা এপ্রিল তিনি রাজধানীর ধানমন্ডির পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ভর্তির জন্য যান। নিয়ম অনুযায়ী তাকে হাসপাতালে ভর্তির আগে করোনার টেস্ট করতে বলা হয়। তিনি স্যাম্পল দেন। শরীরে কোনো ধরনের উপসর্গ না থাকলেও তার করোনা পজেটিভ আসে। তখন ওই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেন, তাকে ভর্তি করা যাবে না। অনেক ভোগান্তির পর ৬ই এপ্রিল তিনি ভর্তি হন ঢাকা মেডিকেলে। সেখানে কোভিড ও গাইনি ডেডিকেটেড ইউনিটে তাকে ভর্তি করা হয়। করোনা পজেটিভ আসায় কোনো প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি হতে পারেননি তিনি।
তাহসিন আজাদ নদী জানান, এই সময়টাতে আমার মানসিক ও শারীরিক অনেক বেশি ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। করোনা পজেটিভ অবস্থায়ই আমার বাচ্চা হয়েছে। ভর্তির পরই কোভিড ইউনিটের চিকিৎসকরা সিদ্ধান্ত নেন সিজারের জন্য। কারণ তারা বলেছেন, বাচ্চাকে সেইফ করা জরুরি আগে। তারপর আমাকে চিকিৎসা দেয়া হবে। সে সময়ে ডেলিভারির তারিখ সম্পূর্ণ হওয়ায় ডেলিভারিটা আরো বেশি জরুরি ছিল। তারপর এপ্রিলের ৭ তারিখে সিজারের মাধ্যমে আমার বাচ্চা হয়। হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরি ১২ তারিখে। বাসায় আসার দুদিন পরে টেস্ট করিয়ে করোনা নেগেটিভ আসে।
তিনি আরো জানান, ডেলিভারির আগেও আতঙ্কে ছিলেন। ডাক্তার দেখানো, রেগুলার চেকআপ বা একজন গর্ভবতী মায়ের যেগুলো করতে হয় সেগুলো ঠিকমতো করতে পারেননি স্বাভাবিক সময়ের মতো। ওই সময় তিনি একজন গাইনোকোলজিস্টকে দেখান। তিনি ফোনে গর্ভবতী ওই নারীকে পরামর্শ দিয়েছেন।
তাহসিন আজাদ নদী বলেন, বাচ্চা হওয়ার আগে সবার মধ্যে একটা আনন্দ থাকে। আত্মীয়-স্বজন আসে। কিন্তু শুধু পরিবারের দু’একজন লোক ছাড়া আমার পাশে আর কেউ থাকতে পারেননি। প্রথম বাচ্চা হওয়ার আনন্দটা করোনা আতঙ্কে ওইভাবে ছড়িয়ে যায়নি পরিবারে। তারমধ্যে যতটা পেরেছি নিজে থেকে সতর্ক থাকার চেষ্টা করেছি। গর্ভকালীন অবস্থায় নিজের অনেক কিছু ইচ্ছে থাকার পরেও করতে পারিনি। আমার পরিবারও আমাকে নিয়ে সব সময় আতঙ্কে থাকতো। আমার স্বামীরও অফিস করতে হতো। তখন বাসায় সব ধরনের সতর্কতা থাকলেও একটা ভয় কাজ করতো। এখন বাচ্চা হয়ে যাওয়ার পরেও একটা আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হচ্ছে। বাচ্চার কোনো ধরনের সমস্যা দেখা দিলে কোনো শিশু ডাক্তারের কাছে যেতেও এক ধরনের আতঙ্ক কাজ করছে বলে জানান এই নারী।
গর্ভবতী নারী শারমিন সুলতানা জানান, তার গর্ভধারণের পাঁচ মাস চলছে। তিনি অনলাইনের মাধ্যমে চিকিৎসকের পরামর্শ নেন। হাসপাতালে চেকআপ করাতে গেলেও ভয়ে থাকেন। এই অবস্থায় করোনা হলে কতটুকু ভুগতে হবে তাকে। বাচ্চার কিছু হবে কি-না। নানা ধরনের দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তিনি।
আরিফা বেগম জানান, গর্ভকালীন অবস্থায় প্রথমদিকে হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। কিন্তু এখন খারাপ লাগলে অনলাইনের মাধ্যমে চিকিৎসকের পরামর্শ নেন। করোনার ভয়ে বাসার বাইরে যান না। ঠিকমতো চেকআপ করাতে পারছেন না।
এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (পিজি) গাইনি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রেজাউল করিম কাজল মানবজমিনকে বলেন, ‘গর্ভধারণ একজন নারীর জীবনে দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা এমনকি মৃত্যুঝুঁকি থেকে যায়। বাংলাদেশে সরকারি হিসাবে প্রতিদিন প্রায় ১৬ জন মা গর্ভকালীন জটিলতায় মারা যান। এটা স্বাভাবিক সময়ের একটি চিত্র। যেকোনো মা গর্ভাবস্থায় সব সময় চিন্তায় থাকেন। তার সন্তান ঠিকমতো পৃথিবীতে আসবে কিনা, তার কোনো সমস্যা হবে কিনা। সেই সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে করোনা পরিস্থিতি। তিনি নির্ধারিত সময়ে যে চিকিৎসকের কাছে চেকআপে যাবেন তখন যাতায়াত, যানবাহন পাবেন কি-না, তার চিকিৎসক ঠিকমতো চেম্বারে বসবেন কি-না, তিনি করোনায় আক্রান্ত হবেন কি-না এগুলো নিয়ে তার মধ্যে সব সময় একটা দুশ্চিন্তা থাকে।’
তিনি আরো বলেন, ‘গর্ভকালীন সময়ে যে জটিলতাগুলো তৈরি হয় একজন মায়ের দেহে যেমন, উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে, গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হতে পারে, তার সন্তান ঠিকমতো বেড়ে না-ও উঠতে পারে, রক্তশূন্যতা হতে পারে এগুলো বোঝার জন্য চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়। কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হয়।
ডা. রেজাউল করিম কাজল বলেন, এখন পর্যন্ত করোনা আক্রান্তের পর যে মায়েরা সন্তান জন্ম দিয়েছেন সেই নবজাতকদের কোনো সমস্যা দেখা যাইনি। কিন্তু মায়েদের সমস্যা হয়েছে। করোনা আক্রান্তের কারণে অনেক মায়ের গর্ভপাত হয়েছে অথবা সময়ের আগে প্রসববেদনা হয়েছে। দেখা গেছে বাচ্চার ওজন ঠিকমতো বাড়েনি। শেষ তিন মাসে যদি করোনা পজেটিভ হয় কোনো গর্ভবতী মায়ের তখন তার জীবনের ঝুাঁকি সবচেয়ে বেশি। কারণ স্বাভাবিক সময়ে যে ফুসফুসটা অক্সিজেন নেয়ার জন্য প্রসারিত হয় জরায়ু শেষ তিন মাসে বেশ বড় হয়ে যাওয়ার কারণে মাত্র তিন ভাগের প্রায় এক ভাগ ফুসফুস প্রসারিত হতে পারে। করোনা ছাড়া স্বাভাবিক সময়ে যে বাতাস তারা গ্রহণ করতে পারে শেষ তিন মাসে তা না পারার কারণে এমনিতেই মায়েদের শ্বাসকষ্ট হয়। তখন করোনা হলে তা জটিল আকার ধারণ করে। এজন্য চিকিৎসকরা দ্রুত সিজারের ব্যবস্থা করে বাচ্চাটিকে আলাদা করার চেষ্টা করেন বলে জানান তিনি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status