শেষের পাতা

চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসে দালালের দুষ্টচক্র

জালাল রুমি, চট্টগ্রাম থেকে

১ মে ২০২১, শনিবার, ৯:১৪ অপরাহ্ন

কয়েক বছর ধরে বাড়ির পাশে একটি কোচিং সেন্টার চালাচ্ছিলেন জিয়াউদ্দিন। করোনাকালীন দীর্ঘদিন বেকার থাকায় কাজের সন্ধানে মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন উত্তর চট্টগ্রামের হাটহাজারীর বাসিন্দা এই যুবক। এক প্রতিবেশীর মাধ্যমে ওমানের একটি দোকানে চাকরির কথাবার্তাও হয় তার। এরপর জরুরি ভিত্তিতে পাসপোর্ট করাতে অনলাইনে ফরম পূরণ করে যান শহরের মনসুরাবাদের বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসে। তবে দালাল ছাড়া আসায় এই ফরম সে সময় আর জমা দিতে পারেননি তিনি।

দালালের শরণাপন্ন না হয়ে পাসপোর্ট করতে আসা এই যুবককে দায়িত্বরত উচ্চমান সহকারী প্রথমে জানান, তার মায়ের ছবি স্পষ্ট না। আবার বলেন, চেয়ারম্যান সার্টিফিকেটের আসল কপি লাগবে। আবার বলা হয় ভোটার আইডি কার্ডের সঙ্গে তার ছবির তেমন মিল না থাকায় কাজ হবে না। শেষ পর্যন্ত সেখানে কর্তব্যরত এক আনসার সদস্যকে এক হাজার টাকা দিয়েই সেদিন জমা দেন ফরম।

এভাবে নগরীর মনসুরাবাদে অবস্থিত চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসে চলছে নিয়মিত গ্রাহক হয়রানি। দালাল ছাড়া এখানে সহজেই মিলছে না পাসপোর্ট সেবা। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পার্শ্ববর্তী কম্পিউটার দোকান উচ্ছেদ, কিছুু দালালকে আটক করে পুলিশে দেয়া, অভিযোগ বক্স রেখে প্রধান পরিচালকের নজরদারি, সার্বক্ষণিক সিসিটিভি ক্যামেরায় মনিটরিংসহ নানা উদ্যোগের পরও এখানে থামছে না দালালদের দৌরাত্ম্য। স্বয়ং এই রাষ্ট্রীয় সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে এই দালালচক্র তাদের ‘স্বাভাবিক’ কাজকর্ম অনেকটা আগের মতোই চালিয়ে যাচ্ছে।

জানা যায়, কমপক্ষে অর্ধশত দালালের এক দুষ্টচক্রে জিম্মি মনসুরাবাদের এই পাসপোর্ট অফিস। এই দালালদের মাধ্যম ছাড়া সেখানে গেলে সহজেই জমা দেয়া যাচ্ছে না পাসপোর্ট ফরম। অপ্রয়োজনীয়, ভুল তথ্য, ঠিকভাবে পূরণ হয়নিসহ নানা অজুহাতে সেবা গ্রহীতাদের ফিরিয়া দেয়া হচ্ছে সেখান থেকে। খুব সামান্য একটি ভুলের অজুহাতেও অফিসের কর্মকর্তারা আবেদনপত্র ফেলে দিচ্ছেন। আর এই সুযোগ নিয়ে নিজেদের পকেট ভারী করছে দালালচক্র। পাশাপাশি নিজেদের দালালির টাকার যথাযথ হিস্যাও দিচ্ছে এই অসাধু কর্মকর্তাদের।

গত বছরের নভেম্বরে ছুটিতে সৌদি আরব থেকে দেশে এসেছিলেন ফটিকছড়ির পাইন্দংয়ের বাসিন্দা লোকমান হোসেন। দেশে এসে পাসপোর্ট মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় নবায়ন করার জন্য দালাল ছাড়াই গিয়েছেন মনসুরাবাদ পাসপোর্ট অফিসে। তবে সেখানে গিয়ে ২নং কাউন্টারে ফরম দেয়া অফিসার জানালো, তার ভোটার আইডি কার্ডে ‘হোসাইন’ লিখা থাকলেও মেয়াদোত্তীর্ণ পাসপোর্টে হোসেন লিখা আছে। তাই এই পাসপোর্ট মেয়াদ বাড়ানোর আগে ভোটার আইডি কার্ড সংশোধন করাতে হবে। যদিও পরে পরিচিত এক ট্রাভেল এজেন্সির লোককে ফোন দিয়ে অতিরিক্ত ২ হাজার টাকা দিয়ে ওই পাসপোর্ট জমা দেন তিনি।

ভুক্তভোগী এই প্রবাসী বলেন, ‘৫ বছর আগে প্রথমবার নিজের এলাকার এক দালালের মাধ্যমে এই পাসপোর্ট করাই। আগে তো এই আইডি কার্ড দিয়েই সব হয়েছিল। এখন কেন আবার সমস্যা হবে। আর পাসপোর্ট করতে কেন আবার ভোটার আইডি কার্ড লাগবে। আসল ব্যাপার হচ্ছে এসব করে আমাদের দালালের কাছে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে।’
জানা যায়, অসম্পূর্ণ তথ্য, আবেদন ফরমে কাটাছেঁড়া, হাতের লেখা অস্পষ্টসহ নানা অজুহাত দেখিয়ে সেবা গ্রহীতাদের ফিরিয়ে দেয়া হয়। সকালে এসে দিনভর ঘুরেও আবেদন জমা না দিয়ে ফিরে যেতে হচ্ছে সরাসরি আবেদনকারীদের। আর যেসব আবেদন দালালের মাধ্যমে আসে সেখানে গোপন সংকেত বা স্বাক্ষর দেয়া থাকে। সেগুলো কোনোরকম হয়রানি ছাড়াই জমা নেয়া হয়।

নিয়ম অনুযায়ী, জরুরি ভিত্তিতে ৭ দিনের মধ্যে পাসপোর্ট করতে সর্বমোট ৬৯০০ টাকা ও সাধারণ পাসপোর্ট করতে খরচ ৩৪৫০ টাকা। তবে দালালের মাধ্যমে করতে প্রথমটাতে লাগে ১২,০০০ টাকা ও দ্বিতীয়টায় ৭,০০০ টাকা। এর থেকে প্রতি পাসপোর্টে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা পান ১০০০ টাকা ও পুলিশ পায় ৫০০ টাকা। বাকি ১৫০০ টাকা দালালদের ভাগ্যে জোটে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রাম পাসপোর্ট অফিসে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা গ্রাহক হয়রানি সংস্কৃতির পেছনে অন্যতম দায়ী হচ্ছে এখানকার কয়েক হাজার ট্রাভেল এজেন্সি। নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত এসব এজেন্সির আয়ের বড় অংশ আসে পাসপোর্ট অফিস থেকে। এই ট্রাভেল এজিন্সির মাধ্যমে করলে প্রতি পাসপোর্ট বাবদ ২,৫০০ থেকে ৩,০০০ টাকা বেশি গুনতে হয়। আর একটি অংশ পাসপোর্ট অফিসের পাশাপাশি চলে যায় পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের কিছু সদস্যের কাছে।
জানা যায়, আইনত এই এজেন্সিরগুলোর প্রধান কাজ হচ্ছে হজসহ দেশ বিদেশে ভ্রমণ সুবিধা দেয়া। অভিযোগ রয়েছে মূল কাজ বাদ দিয়ে বেশির ভাগ এজেন্সি ব্যস্ত পাসপোর্ট দালালি নিয়ে। যে কারণে ট্রাভেল এজিন্সির অনেক মালিককেও অনেক সময় পাসপোর্ট অফিসের সামনে ঘুরঘুর করতে দেখা যায়।

নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক নগরীর মুরাদপুর মোড়ের এক ট্রাভেল এজেন্সির মালিক মানবজমিনকে জানান, একটি পাসপোর্ট করাতে তারা গ্রাহকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ৩ হাজার টাকা নেন। এর মধ্যে ১০০০ টাকা দিতে হয় পাসপোর্ট অফিসে। ৫০০ টাকা পুলিশ সুপার কার্যালয়ের ডিএসবি শাখাকে ভ্যারিকিশনের জন্য দেন। সবশেষে বাকি যা আছে তা তাদের লাভ।

এদিকে দালালের বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিয়ে মনসুরাবাগ পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক আবু সাঈদ এই প্রতিবেদককে  জানান, বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়ার কারণে বর্তমানে এখানে দালাল নেই বলেই চলে। তবে মাঝেমধ্যে কিছু বিচ্ছিন্ন ব্যাপার হয়। আর সেটাও মানুষের অসচেতনতার কারণে হচ্ছে। পাশাপাশি জনবল সংকট এবং বর্তমানে শুরু হওয়া ই-পাসপোর্ট মেশিনে মাঝেমধ্যে সৃষ্ট যান্ত্রিক ত্রুটির কারণেও মানুষকে মাঝেমধ্যে কষ্ট পেতে হচ্ছে বলে জানান বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের এই সর্বোচ্চ কর্মকর্তা।

পরিচালক আবু সাঈদ বলেন, আমি দায়িত্বে আসার পর দালালদের আঁতুড়ঘর বলে পরিচিত পার্শ্ববর্তী কম্পিউটার দোকানগুলোর উচ্ছেদ কার্যক্রম চালিয়েছি। রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট করাতে আসা কিছু দালালকে কয়েক দফা আটক করে পুলিশের কাছে সোপর্দ করিয়েছি। নিজেই উপরতলা থেকে নেমে কর্মকর্তাদের কার্যক্রম নজরদারি করছি। এসব কারণে সুবিধা করতে না পেরে কিছু অসাধু ব্যক্তি এখন প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে। আসলে এসবের কোনো ভিত্তি নেই।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status