শেষের পাতা

রাজশাহীতে নাভিশ্বাস

আসলাম-উদ-দৌলা, রাজশাহী থেকে

২৪ এপ্রিল ২০২১, শনিবার, ৯:১৩ অপরাহ্ন

করোনা মোকাবিলায় চলমান ধারাবাহিক লকডাউনের মুখে রাজশাহীতে নিম্ন মধ্যবিত্ত, খেটে খাওয়া মানুষদের নাভিশ্বাস অবস্থা। দিনে দিনে কর্মহীন মানুষ প্রতিবাদী হয়ে উঠছে। বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে নগরীর প্রাণকেন্দ্র আরডি মার্কেটে দোকান খুলতে শুরু করেছেন ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, উপার্জনের আশায় বাধ্য হয়েই তারা দোকান খুলেছেন। প্রশাসন বাধা দিলে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করবেন।
এদিকে, গত ৩২ দিনে করোনা উপসর্গ নিয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছেন ৮৭ জন। হাসপাতালের দুইজন চিকিৎসকও করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। অন্তত ৫০ জন চিকিৎসক নার্স করোনা আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নেন। এতে হাসপাতালে চিকিৎসক-নার্সসহ সংশ্লিষ্ট সেবাদানকারীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন।
গত ২৭শে মার্চ করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যান রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক আব্দুল হান্নান (৪৬)। ৩ দিন লাইফ সাপোর্টে থাকার পরেও শেষ পর্যন্ত না ফেরার দেশে চলে যান। ১লা এপ্রিল রামেক হাসপাতালের অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. মো. ওবাইদুল্লাহ করোনায় আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় মারা যান।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক সাইফুল ফেরদৌস মানবজমিনকে বলেন, করোনা আক্রান্ত চিকিৎসক ও নার্সের অনেকেই সুস্থ হয়ে উঠছেন। ওয়ার্ডে পর্যাপ্ত চিকিৎসক-নার্স দেয়া হচ্ছে। বেডের সংখ্যা প্রয়োজনে বাড়ানো হচ্ছে। বর্তমানে ১৫৩টি বেডের মধ্যে ১১৬টি বেডে করোনা রোগী রয়েছেন। ১০টি আইসিইউ’র মধ্যে ৭টিতে রোগী ভর্তি আছেন।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেন, আমরা করোনা ওয়ার্ড আরো বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছি। এমনকি রাজশাহী টিচার্স ট্রেনিং কলেজের হলরুমকেও করোনা ওয়ার্ডে পরিণত করার উদ্যোগ নিয়েছি। পাশাপাশি সাধারণ ওয়ার্ডেও হাইফ্লো অক্সিজেন ব্যবস্থা করা হচ্ছে। যাতে করে করোনা আক্রান্ত রোগীদের আইসিইউ বেডে নেয়ার আগেই অনেকটা সুবিধা দেয়া যায়।
করোনা ওয়ার্ডে প্রতিদিনই কোনো না কোনো রোগী মারা যাচ্ছেন। গত বুধবার রাতে করোনা সংক্রমণে দুজন, উপসর্গ নিয়ে আরো দুজন মারা গেছেন। এতকিছুর পরও দরিদ্রদের জন্য ভয়াবহ হয়ে উঠেছে লকডাউন। নিম্ন আয়ের মানুষের কাজ না থাকায় তারা খাবারের ব্যবস্থা করতে পারছে না। অনেকে লকডাউনে পুলিশের মারমুখী আচরণের প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
ক’দিন আগে রিকশাযোগে নগরীর বর্ণালী মোড় দিয়ে উপশহর যাচ্ছিলেন এক ব্যক্তি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সামনে যেতে না দিয়ে ফিরিয়ে দিলে ওই ব্যক্তি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়েন। একপর্যায়ে প্রতিবাদস্বরূপ রাস্তার ধারে নামাজ পড়তে শুরু করেন। নামাজ শেষ করে মুনাজাত করে বাড়ি ফিরে যান তিনি। নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতিটি মানুষ লগডাউনে ক্ষুব্ধ। মূলত রাজশাহীর অর্থনেতিক ব্যবস্থা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদালয়, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় লক্ষাধিক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। করোনার প্রথম দফা থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রয়েছে। এরপর দ্বিতীয় দফার কঠোর লকডাউনে সাধারণ মানুষ বেঁচে থাকার শেষ ভরসাটুকু হারাতে বসেছে।
কথা হলো রিকশাচালক রবিউল আলমের সঙ্গে। তিনি ক্ষোভ নিয়ে বলেন, বাড়িতে গিয়ে বৌ, ছেলে-পেলেকে কি খাওয়াবো? এভাবে চলতে থাকলে গলায় দড়ি দেয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।’
গণকপাড়া এলাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাক। লকডাউনে বাধ্য হয়ে টেবিল পেতে মাস্কের দোকান নিয়ে বসেছেন। তিনি বলেন, লোকজন আর কত মাস্ক কিনবেন। বাড়িতে কেউ অসুস্থ হলে ওষুধ কেনার টাকারও নেই।    
কয়েক দিন আগে পুলিশ রিকশাচালকদের উপর চড়াও হলেও এখন সেটি কমেছে। কিন্তু খালি রিকশা দেখলে চাকার বাতাস ছেড়ে দেয়। রিকশাচালক আনার বলেন, সবসময় তো রিকশায় লোক পাওয়া যায় না। দু’ঘণ্টা বসে থেকে একটি ভাড়া মারলাম। মানুষজনের হাতে কাজ নাই, টাকা নাই; এভাবে কতদিন চলবে?    
গতকাল সকালে দোকান খুলে দেয়ার দাবিতে রাজপথে আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছিল ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আন্দোলনে না গিয়ে লকডাউন ভেঙে সকাল ১০টায় সাহেববাজার আরডিএ মার্কেটের ব্যবসায়ীরা দোকান খুলে ব্যবসা শুরু করেন।
এর আগে ব্যবসায়ী নেতারা জেলা প্রশাসক আবদুল জলিলের সঙ্গে দেখা করে দোকান খোলার অনুমতি চান। জেলা প্রশাসক তাদের আগামী ২৮শে এপ্রিল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেন। তারপরও ব্যবসায়ীরা দোকান খোলেন। গতকাল ৩টা পর্যন্ত নগরীর বিভিন্ন মার্কেটে দোকানপাট খোলা রেখে ব্যবসা করতে দেখা গেছে।
রাজশাহী জেলা প্রশাসক আব্দুল জলিল বলেন, রাজশাহী আরডিএ মার্কেট সকালে ব্যবসায়ীরা খুলে দেয়। এরপর তাদের নেতৃবৃন্দদের সঙ্গে আমার মিটিং হয়। তারা আমার সঙ্গে কথা দেয় আগামী ২৮ তারিখ পর্যন্ত তারা দোকান বন্ধ রাখবে। সরকারি বিধিনিষেধ মেনে চলবে। আমরা কোনো ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করছি না। তারা নিজেরাই বন্ধ করে দিবে।
এ প্রসঙ্গে রাজশাহী প্রেস ক্লাব ও জননেতা আতাউর রহমান স্মৃতি পরিষদ সভাপতি সাইদুর রহমান বলেন, শিক্ষানগরী হিসেবে রাজশাহী পরিচিত। অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সেভাবে গড়ে উঠেছে। দীর্ঘসময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধে এই অঞ্চলের মানুষ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এমতাবস্থায় জরুরি ভিত্তিতে বিশেষ বরাদ্দ ও সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। সংকট মোকাবিলায় সমাজের বিত্তশালীদের এগিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় সকল ক্ষেত্রে ব্যাপক বিপর্যয় দেখা দিবে। সে সময় শত চেষ্টায় ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হবে না।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status