প্রথম পাতা

করোনার টিকা

ভারতবিহীন চীনা জোটে ঢাকার সায়

স্টাফ রিপোর্টার

২৩ এপ্রিল ২০২১, শুক্রবার, ৯:২৯ অপরাহ্ন

করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন সংগ্রহে চীনের নেতৃত্বে নতুন এক প্ল্যাটফরমে যোগ দিচ্ছে বাংলাদেশ। জরুরি প্রয়োজনে এই উৎস থেকে সদস্য দেশগুলো ভ্যাকসিন সংগ্রহ করতে পারবে। চীনের নেতৃত্বাধীন ‘ইমার্জেন্সি ভ্যাকসিন স্টোরেজ ফ্যাসিলিটি ফর কোভিড ফর সাউথ এশিয়া’- নামের প্ল্যাটফর্মে আরও যুক্ত হয়েছে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও নেপাল। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতাকে ভিত্তি করে এই প্ল্যাটফর্ম গঠন করা হলেও সেখানে ভারত নেই। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে একটি চুক্তির আওতায় ৩ কোটি ডোজের বিপরীতে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে প্রায় ১ কোটি ডোজ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন সংগ্রহ করেছে। করোনা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় ভ্যাকসিন রপ্তানি বন্ধ করে দেয় প্রতিবেশী ভারত। কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন সংকটের আলোচনার মধ্যে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চীনের নেতৃত্বাধীন প্ল্যাটফর্মে যোগ দেয়ার ঘোষণা দেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন। এছাড়া বিকল্প হিসেবে ভ্যাকসিন উৎপাদনে রাশিয়ার সঙ্গেও একটি চুক্তি করেছে বাংলাদেশ। এ চুক্তির আওতায় রাশিয়ার তৈরি ‘স্পুটনিক ভি’ ভ্যাকসিন বাংলাদেশে উৎপাদন হবে। গতকাল গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, যখন যার দরকার হবে ভ্যাকসিন স্টোরেজ ফ্যাসিলিটি থেকে তারা ভ্যাকসিনগুলো সংগ্রহ করবে। এটাকে বলছি সাউথ এশিয়া কো-অপারেশন। শুরুতেই চীন উপহার হিসেবে বাংলাদেশকে ছয় লাখ ডোজ টিকা উপহার দেবে বলেও জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এজন্য একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হবে যার খসড়াও তৈরি হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এখন আমরা চীনের সঙ্গে সম্পর্ক করেছি। চীন আমাদের ভ্যাকসিন দেবে। এ ভ্যাকসিন তারা খুব শিগগির দেবে।
ওদিকে রাশিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে করোনাভাইরাসের টিকা উৎপাদনের জন্য আরেকটি চুক্তি সই করেছে বাংলাদেশ। দেশটির সঙ্গে যৌথভাবে ভ্যাকসিন উৎপাদনের পাশাপাশি বাণিজ্যিকভাবেও ভ্যাকসিন কিনবে বাংলাদেশ। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলায় ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্য সরকার চীনের পাশাপাশি রাশিয়ার সঙ্গেও যোগাযোগ করছে। এ প্রসঙ্গে আব্দুল মোমেন বলেন, রাশিয়া আমাদের ভ্যাকসিন দিতে যে রাজি, সেটা জানিয়েছে। তবে বাংলাদেশের যে চাহিদা, সেটা তারা পূরণ করতে পারবে না। এজন্য তারা ভ্যাকসিনের ফর্মুলা দিতে রাজি হয়েছে। তারা জানিয়েছে, যৌথভাবে ভ্যাকসিন উৎপাদন হতে পারে। তবে বাংলাদেশকে একটা কাজ করতে হবে। ভ্যাকসিনের উৎপাদনের ফর্মুলা বাংলাদেশ কাউকে দেখাতে পারবে না। ভ্যাকসিনের ফর্মুলা গোপন রাখা হবে, এটা কাউকে জানানো হবে না, এই শর্তে আমরা চুক্তি সই করেছি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, বাংলাদেশে ভ্যাকসিনের উৎপাদনে সক্ষম এমন একাধিক প্রতিষ্ঠানের নামের তালিকা রাশিয়াকে দেওয়া হয়েছে। এখন রাশিয়া এক বা একাধিক প্রতিষ্ঠানকে এ ফর্মুলা দিতে পারে। রাশিয়া যৌথভাবে বাংলাদেশে উৎপাদিত ভ্যাকসিন তৃতীয় দেশে রপ্তানির প্রস্তাব মেনে নিয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তিটি কবে সই হয়েছে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এই চুক্তি ইদানীং হয়েছে। বিভিন্ন রকমের আনুষ্ঠানিক দলিলে সই করেছি। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যৌথ উৎপাদনের বিষয়ে চুক্তিটা হয়েছে। রাশিয়া থেকে বাণিজ্যিকভাবে ভ্যাকসিন কেনা হবে কি না, জানতে চাইলে আব্দুল মোমেন বলেন, রাশিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে ভ্যাকসিন উৎপাদনের জন্য তো সময় লাগবে। জরুরি ভিত্তিতে যে ভ্যাকসিন লাগবে, সেটা তাদের কাছ থেকে কেনা হবে।
প্রসঙ্গত, অক্সফোর্ডের তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন আনতে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে গত বছরের পাঁচ নভেম্বর যে চুক্তি হয়েছিল তাতে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন রপ্তানি করবে এবং সে অনুযায়ী প্রতিমাসে ৫০ লাখ ডোজ পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ সেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ভ্যাকসিন পাচ্ছে না। এ পর্যন্ত ভারত থেকে ভ্যাকসিন এসেছে মোট এক কেটি দুই লাখ ডোজ। এরমধ্যে ভারত সরকারের উপহার হিসেবে গত ২১শে জানুয়ারি প্রথমে আসে ২০ লাখ ডোজ। সরকারের অর্থে কেনা ভ্যাকসিনের প্রথম চালানে ২৫শে জানুয়ারি আসে ৫০ লাখ ডোজ, ফেব্রুয়ারি মাসের ২৩ তারিখ আসে আরও ২০ লাখ ডোজ। সর্বশেষ গত ২৬শে মার্চ উপহার হিসেবে আসে ১২ লাখ ডোজ। অর্থাৎ, ভারত থেকে কেনা ও উপহার মিলিয়ে এ পর্যন্ত মোট ভ্যাকসিন এসেছে এক কোটি দুই লাখ ডোজ। দেশে গত সাত ফেব্রুয়ারি থেকে গণটিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়। গত ৮ই এপ্রিল থেকে শুরু হয় ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ। তবে ভারত থেকে গত ফেব্রুয়ারি মাসের জন্য চুক্তির ৩০ লাখ এবং মার্চ মাসের ৫০ লাখ অর্থাৎ চুক্তির ৮০ লাখ টিকা এখনও দেশে আসেনি। এপ্রিল মাসে ভ্যাকসিন আসার সম্ভাবনা এখনও পর্যন্ত নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ মিলিয়ে প্রায় ৭৭ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন ইতিমধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। বাকি ২৫ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন মজুত আছে। যে হারে বর্তমানে ভ্যাকসিন কর্মসূচি চলতে এতে করে আগামী ১৫/২০ দিনের মধ্যেই মজুত ফুরিয়ে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ভারতবিহীন চীনা ‘হিমালয়ান কোয়াড’: ১৭ই এপ্রিল সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টে চীনভিত্তিক চীনা এবং পূর্ব এশিয়া বিশেষজ্ঞ মারিয়া সিয়াও, ‘হিমালয়ান কোয়াড: চীন কি নেপাল, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সঙ্গে নিজস্ব নিরাপত্তা ব্লক শুরু করছে?’- শীর্ষক এক নিবন্ধে লিখেন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ভারত এবং  অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে যে কোয়াড করেছে তার বিপরীতে বেইজিং কেবল নিরাপত্তা ইস্যুতেই নয়, সন্ত্রাসবাদ ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পাল্টা ব্লক স্থাপন করবে কিনা তা নিয়ে শীর্ষস্থানীয় বিশ্লেষকরা প্রশ্ন তুলেছেন।
মারিয়া উল্লেখ করেন, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন কোয়াডের প্রথম শীর্ষ সম্মেলন মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত হয় যেখানে চার দেশের নেতারা ২০২২ সালের মধ্যে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে করোনা ভ্যাকসিনের এক বিলিয়ন ডোজ সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি দেন। এই প্রতিশ্রুতিকে চীনের ভ্যাকসিন কূটনীতির বিরোধী হিসেবে মনে করা হচ্ছে।
এদিকে সমপ্রতি ভারতের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন (ওআরএফ) এ ভারতে বেলারুশের সাবেক কূটনীতিবিদ ইউরি ইয়ারমোলিনস্কির একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে ইউরি লিখেছেন, চীনের নেতৃত্বে এই কোয়াড এখনো তাত্ত্বিকভাবে রয়েছে। কিন্তু চীনা স্বার্থে কোনো আঘাত আসলে তা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেবে। এটা হবে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন কোয়াডের কাউন্টার কোয়াড। পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং নেপালের সঙ্গে তো ইতিমধ্যেই চীনের নিরাপত্তা ও কৌশলগত সহযোগিতার সম্পর্ক রয়েছে।
এদিকে, মনোহর পারিকর ইনস্টিটিউটের জগন্নাথ পি পান্ডা বলেছেন, করোনাভাইরাস মহামারি নিয়ে আলোচনার জন্য চীন ইতিমধ্যে নেপাল, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানকে একত্রিত করার চেষ্টা করেছে। চীনের ‘হিমালয়ান কোয়াড’ এই অঞ্চলে ভারতের প্রভাবকে ভারসাম্যে আনার উদ্দেশ্যে গঠিত বলে তিনি মনে করেন। বেইজিং দক্ষিণ এশিয়ায় তার প্রভাব বাড়াতে চাইবে এবং আরো অনেক দেশকেও ভবিষ্যতে এই কোয়াড এ আনা হতে পারে বলে তার ধারণা।
এদিকে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম মুখপাত্র বলে পরিচিত গ্লোবাল টাইমস এ দিল্লিতে চীনা দূতাবাসের রাজনৈতিক বিভাগের সাবেক উপপ্রধান লান জিয়াংসিউ মঙ্গলবার লিখেছেন, গত বছরের ২৭শে জুলাই চার দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভিডিও কনফারেন্সের পর কেউ কেউ ‘হিমালয়ান কোয়াড’ এর অতিরিক্ত প্রচার করতে শুরু করেন। এটি আসলে চীন এবং তার প্রতিবেশীদের মধ্যে সহযোগিতার একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এর মতে, এই সম্মেলনের মূল লক্ষ্য ছিল এই দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে করোনা মহামারি, একে নিয়ন্ত্রণে রাখা, ভ্যাকসিন এবং মহামারি পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এবং উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়ে যৌথ সহযোগিতা জোরদার করা। এই প্রক্রিয়াটির ভবিষ্যৎ খুব ভালো, কারণ চীন এবং তার পার্শ্ববর্তী দেশগুলো সুখ-দুখের সাথী।
তার মতে- চীন, নেপাল, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান সকলেই উন্নয়নশীল দেশ। মহামারি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে এখনকার সাধারণ কাজ ছাড়াও, এই চারটি দেশকেই তাদের অর্থনীতির বিকাশ এবং মানুষের জীবনযাত্রার উন্নতি সাধন করতে হবে।
চীন ও এই দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতার ব্যবস্থাটি কোনো ভূ-কৌশলগত ও সামরিক উদ্দেশ্য ছাড়াই উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। জানুয়ারির ৬ তারিখ চীন, নেপাল, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা এবং বাংলাদেশ এই ছয়টি দেশ করোনা এবং দারিদ্র্যবিমোচনে সহযোগিতা বিষয়ে মহাপরিচালক স্তরে প্রথম বৈঠক করেছে।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হুয়া চুনইং যেমনটি বলেছেন, এই বৈঠকটি (২০২০ সালের) জুলাই মাসে করোনা নিয়ে চীন, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও নেপালের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের ভিডিও কনফারেন্স এবং করোনা নিয়ে ২০২০ সালের নভেম্বরে চীন, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীদের ভিডিও কনফারেন্সের ‘ফলো আপ স্টেপ’।

লান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন কোয়াড এর সঙ্গে চীনা নেতৃত্বাধীন কোয়াড এর পার্থক্য হলো- প্রথমটি সামরিক-রাজনৈতিক জোট যা স্নায়ুযুদ্ধকে ধারণ করে। এতে আঞ্চলিক বিভেদ বাড়বে। এই কোয়াড ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোকে একটা পক্ষ নিতে এবং তারপরে এই অঞ্চলে কলহের সৃষ্টি করতে বাধ্য করবে। এই অঞ্চলের দেশগুলো এটি গ্রহণ করবে না, তাই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোটের বিরুদ্ধে বাতাস বইতে থাকবে। একই সঙ্গে বেইজিংকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ওই কোয়াডের এজেন্ডা কখনোই কাজ করবে না, কারণ চীনের উত্থান অবশ্যম্ভাবী। অন্যদিকে চীনের লক্ষ্য হলো সকলের অংশীদারত্বমূলক ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে একটি কমিউনিটি তৈরি করা।
তবে চীন এবং এই দেশগুলো পরিস্থিতি সাপেক্ষে নিজেদের মধ্যে ‘সহযোগিতা’ আরো প্রশস্ত করতে পারে বলেও তিনি স্বীকার করেন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status