শেষের পাতা

করোনায় চট্টগ্রামে অসহায় মানুষ

জালাল রুমী, চট্টগ্রাম থেকে

২২ এপ্রিল ২০২১, বৃহস্পতিবার, ৯:১৫ অপরাহ্ন

গত বছরের লকডাউনের শুরু থেকে অনেকটা বেকার কাঠমিস্ত্রী মনিরুজ্জামান। নগরীর মুহাম্মদপুর মাজার গেটের ছোট ফার্নিচার দোকানটি ছেড়ে দিতে হয়েছে কিছুদিন আগে। দুই সন্তান, স্ত্রীসহ দুই রুমের যে বাসায় থাকেন সেটিরও কয়েকমাস ভাড়া বকেয়া পড়েছে। আয়- রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে অনেকটা মানবেতর জীবনযাপন করছেন তিনি। এভাবে সর্বনাশা করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে এসে অনেকটা অসহায় হয়ে উঠেছে মানুষ। করোনার প্রথম ঢেউ আসার পর নিম্নবিত্তরা বিভিন্ন জায়গা থেকে সহযোগিতা পেলেও এখন দ্বিতীয় ঢেউয়ে এসে যেন পাল্টে গেছে সব। খেটে-খাওয়া মানুষজনের কাছে এখন আর  সহযোগিতা আসে না। কারণ এতোদিন যারা আর্থিক সহযোগিতা করতেন তারাই এখন চরম দুর্দশায়।
জানা যায়, চলতি মাসের ১৪ তারিখ থেকে শুরু হওয়া দ্বিতীয় ধাপের লকডাউনে মানুষের দুর্দশা এখন সীমাহীন পর্যায়ে পৌঁছেছে। কাজ না থাকায় পরিবার নিয়ে এখন তাদের কাটাতে হচ্ছে অবর্ণনীয় জীবন। পেটের তাগিদে কেউ কেউ কাজে বের হলেও পুলিশের ভয়ে ফিরতে হচ্ছে ঘরে।
নগরীর পাঁচলাইশের  বিভিন্ন ব্যাচেলর বাসায় রান্নাবান্নার কাজ করেন নিলোফার বেগম। ব্রাক্ষণবাড়িয়ার কসবার বাসিন্দা এই নারী এর আগে ৪টি ছাত্রাবাসে কাজ করে পরিবার চালাতেন। অসুস্থ স্বামীসহ ৮ সদস্যদের পুরো পরিবার  তার আয়ের ওপর নির্ভরশীল  ছিল। গতবছরের করোনা প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় একটি বাদে সব বাসার কাজ বন্ধ হয়ে যায় তার। যে একটি বাসায় কাজ ছিল সেটিও চলতি লকডাউনে চলে যাওয়ায় অনেকটা নিরুপায় হয়ে চট্টগ্রাম শহর ছেড়ে  গ্রামের বাড়ি চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এই নারী।
মুরাদপুর মোড়ের চায়ের দোকানি মোহাম্মদ নজরুল বলেন, লকডাউনের পর থেকে কোনো আয় নেই। প্রথম রোজার রাতে কিছুক্ষণ দোকান খোলা রাখলেও পরে পুলিশ এসে বন্ধ করে দেয়। এখন বাসায় চাল নেই। দুই মাসের বাসা ভাড়াও দেয়া হয়নি। বাড়ির মালিক বলেছেন এই মাসে ভাড়া দিতে না পারলে বাসা ছেড়ে দিতে হবে। গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জে মা, ছোট বোনের জন্য প্রতি মাসে টাকা পাঠাতে হয়। এখন আর সেটি সম্ভব হচ্ছে না। গত বছরের রমজানে এমন দিনে অনেকে সহযোগিতা করেছেন। এই লকডাউনে কেউ এক পয়সাও দেইনি।
এই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বলেন, ‘পরিবার নিয়ে না খেয়ে না হয় রাস্তায় শুয়ে থাকলাম। কিন্ত দুইটি এনজিওকে তো একদিন পরপর কিস্তি দিতে হয়। আর তাদের টাকাতো কবর থেকে উঠে এসে হলেও দিতে হবে। এখন আমরা যাবো কোথায়।
এদিকে বরাবরের মতো অনেকটা অসহায় দিন কাটাচ্ছেন এখানকার   মধ্যবিত্ত  শ্রেণী। তারা আত্মসম্মানের ভয়ে না পারছেন কাউকে বলতে। আবার না পারছেন সইতে। ফলে নিদারুণ অসহায় হয়ে বোবাকান্নায় দিন যাচ্ছে তাদের। অনেকের ঘরে খাবার নেই। ভাসাভাড়ার টাকা নেই। চরম অনিশ্চয়তায় কাটছে তাদের সময়।
এই শ্রেণির কেউ বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কেউ ছোটখাটো প্রতিষ্ঠানের চাকুরে,  কেউ  বিক্রয়কর্মী,  কেউ  কোনো কোম্পানির কর্মচারী। ২০-২৫ হাজার বেতনে টেনেটুনে চলতো সংসার। এখন চাকরি হারিয়ে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা তাদের।
একটি ডেভেলপার কোম্পানিতে চাকরি করতেন শাহেদুল ইসলাম। ফটিকছড়ির নাজিরহাটের এই  বাসিন্দা স্ত্রীসহ থাকতেন নগরীর অভিজাত এলাকা সুগন্ধায়। ব্যবসা কমে যাওয়ায় কোম্পানি কিছুদিন  আগে প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়ায় চাকরি চলে যায় তার। পরে দুইমাস অনেক চেষ্টা করেও নতুন চাকরি জোগাড় করতে না পারায় শহর থেকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। তবে গ্রামে নিজের বাড়িতে থাকার মতো জায়গা না থাকায় শ্বশুরবাড়িতে উঠতে হয় এক সময়ের এই চরম আত্মসম্মান নিয়ে চলা যুবকের।
একদিকে চলমান মহামারির মধ্যেই অসাধু ব্যবসায়ীরা জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়েছে ইচ্ছামতো। চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। এতে চরম বিপাকে পড়েছেন নিম্ন ও মধ্য আয়ের  মানুষগুলো। অনেকে খাবার খাওয়ার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েও খরচের লাগাম টানতে পারছেন না।
বুধবার সরজমিনে দুই নং গেটের কর্ণফুলী মার্কেটে গিয়ে জানা যায়,  সব ধরনের চাল প্রতিকেজিতে ৭-৮ টাকা বেড়েছে। তেল প্রতিলিটার বেড়েছে ৩০ টাকা,  গুঁড়ো দুধ প্রতিকেজিতে ৪০ টাকা, চা পাতায় ২৫ টাকা, চিনিতে বেড়েছে ১৫ টাকা। ডাল, মসলা, আটা, শিশুখাদ্যের দাম বাড়ানো হচ্ছে ইচ্ছামতো। আর কাঁচাবাজার ও মাছ-মুুরগিতে যেন আগুন জ্বলছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চলমান করোনায় অনেক উচ্চবিত্ত মানুষ মধ্যবিত্ত কাতারে চলে এসেছেন। আর মধ্যবিত্তরা নেমে এসেছেন নিম্নবিত্তে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, একসময় উচ্চ চাকরি করে মর্যাদা নিয়ে সমাজে বসবাস করা অনেকে চাকরি হারিয়েছেন। এদের অনেকে আয়ের পথ না পেয়ে অসৎ উপায় অবলম্বন করছেন। অনেকে আবার ছোট কোনো চাকরি, অনলাইন ব্যবসার সঙ্গে নিজেকে জড়াচ্ছেন।
সমপ্রতি বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির এক জরিপে বলা হয়, চলমান করোনা পরিস্থিতিতে-মধ্যবিত্ত মানুষের সংখ্যা  ৩ কোটি ৪০ লাখ থেকে ১ কোটি ২ লাখ নিম্ন্ন-মধ্যবিত্তে নেমেছে। নিম্ন-মধ্যবিত্তে থাকা ৫ কোটি ১০ লাখ মানুষ থেকে ১ কোটি ১৯ লাখ দরিদ্র হয়েছেন। আর দরিদ্র থাকা ৩ কোটি ৪০ লাখ থেকে ২ কোটি ৫৫ লাখ হতদরিদ্র হয়েছেন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status