শেষের পাতা

বাংলাদেশে বসে লন্ডনপ্রবাসীদের সঙ্গে প্রতারণা

তাইসির মাহমুদ, লন্ডন থেকে

১৯ এপ্রিল ২০২১, সোমবার, ৯:২১ অপরাহ্ন

একটি প্রতারকচক্র বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্য প্রবাসীদের মোবাইল ফোন হ্যাক করে অভিনব কায়দায় হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। তারা প্রথমে প্রবাসীদের মোবাইল ফোন হ্যাক করে কন্টাক্ট লিস্ট থেকে সকল নম্বর নিয়ে নেয়। এরপর ইমোর মাধ্যমে একটির পর একটি নম্বরে কল করে অভিনব কায়দায় হাতিয়ে নেয় লাখ লাখ 
টাকা। সমপ্রতি যুক্তরাজ্যে এ ধরনের একাধিক প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে।
প্রতারণার শিকার একজন হলেন পূর্ব লন্ডনের ডেগেনহ্যাম ইস্টের মদীনা ফাউন্ডেশন মসজিদের ট্রেজারার সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার চন্দরপুরের অধিবাসী মো. সাদ উদ্দিন (৮২)। তিনি এই প্রতিবেদকের কাছে তার প্রতারিত হওয়ার কাহিনী বর্ণনা করেছেন। তিনি জানান, গত ১০ই এপ্রিল শনিবার দুপুরে জোহরের নামাজ পড়তে মসজিদে যান। নামাজে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তার ফোনে বারবার কল আসতে থাকে। তিনি তখন মোবাইল ফোনটি সাইলেন্টে রেখে দেন।
এরপর নামাজ শেষে ঘরে ফিরে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখতে পান অনবরত কল আসছে। ‘শামসুল’ নামক তার এক বন্ধুর নাম থেকে ইমোতে কল আসছে। তিনি কলটি রিসিভ করেন। তখন ওপাশ থেকে ভেসে আসে মহিলা কণ্ঠ। কলদাতা ব্যক্তি নিজেকে শামসুলের স্ত্রী পরিচয় দিয়ে বলেন, বাংলাদেশে তাদের এক আত্মীয় গুরুতর অসুস্থ। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। তাই জরুরিভিত্তিতে ৪শ’ পাউন্ড বিকাশ করে পাঠানোর জন্য অনুরোধ করেন।
সাদ উদ্দিন শামসুলের স্ত্রীর কণ্ঠের সঙ্গে পরিচিত না হলেও যেহেতু বন্ধুর স্ত্রী পরিচয় দিয়ে অনুরোধ করেছেন তাই টাকা পাঠাতে মনস্থ করেন। কিন্তু কলদাতা ব্যক্তির আরো কিছু কথাবার্তা ও তাড়াহুড়ো ভাব দেখে তার কিছু সন্দেহ হয়। তাই তিনি শামসুলের সঙ্গে কথা বলতে চান। মহিলা ফোনটি একজন পুরুষের হাতে দেন। ওপাশ থেকে পুরুষ কণ্ঠে শামসুল পরিচয়ে সাদ উদ্দিনের সঙ্গে একজন কথা বলেন। দুই একটি কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে সাদউদ্দিন বুঝতে পারেন এই কণ্ঠ শামসুলের নয়। তখনই তিনি বুঝতে পারেন প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়েছেন। এরপর লাইন কেটে দেন।
এদিকে সাদ উদ্দিন প্রতারণা থেকে বাঁচলেও প্রতারিত হোন তার বন্ধু লন্ডনের আক্সব্রিজের বাসিন্দা আব্দুল মুমিন (৫৮)। বাংলাদেশ থেকে ওই প্রতারক আব্দুল মুমিনের মোবাইলে কল করে নিজেকে সাদ উদ্দিনের স্ত্রী পরিচয় দিয়ে কীভাবে ৪০০ পাউন্ড হাতিয়ে নেয় তার বর্ণনা দিয়েছেন এ প্রতিবেদককে।
তিনি বলেন, ১০ই এপ্রিল শনিবার তিনটার দিকে আমার ফোনে একজন মহিলা ফোন করে জানান (সিলেটি ভাষায়), তিনি আমার বন্ধু সাদ উদ্দিন সাহেবের স্ত্রী। তাদের এক আত্মীয় সিলেটে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। অপারেশন হবে। কিন্তু টাকা দিতে না পারায় ডাক্তার অপারেশন করছে না। তাই জরুরিভিত্তিতে বিকাশ নম্বরে ৪শ’ পাউন্ড পাঠাতে অনুরোধ করেন।
আব্দুল মুমিন সরল বিশ্বাসে কিছুক্ষণের মধ্যেই সেন্ডওয়েব-এর মাধ্যমে ৪শ’ পাউন্ড প্রেরণ করেন। বাংলাদেশি টাকায় ৪৫ হাজার ৭০০ টাকা হয়। তিনি যে বিকাশ নম্বরে টাকা পাঠান তা হচ্ছে ০০৮৮ ০১৭৯৮ ২৩৩ ৯৯৬। নাম রুনা বেগম। পাঠানোর পর ফোন করে জানতে চান টাকা পেয়েছেন কিনা। জবাবে মহিলা বলেন, বললাম ৮০০ পাউন্ড পাঠানোর জন্য, আপনি ৪০০ পাউন্ড পাঠালেন কেন? তখন আব্দুল মুমিনের কিছুটা সন্দেহ হয়। সঙ্গে সঙ্গে তিনি সাদ উদ্দিনের নম্বরে কল করেন। কথা বলে বুঝতে পারেন তিনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন। কিন্তু যেহেতু তিনি ততক্ষণে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছেন তখন আর করার কিছুই নেই।
আব্দুল মুমিনের দেশের বাড়ি বিশ্বনাথের রামপাশা ইউনিয়নের নরসিংহপুর গ্রামে। তিনি তার ভাতিজা সুমনকে ফোন করে প্রতারণার ঘটনা বর্ণনা করেন এবং বিশ্বনাথ থানায় গিয়ে সাধারণ ডায়েরি করতে বলেন। তিনি বিশ্বনাথ থানায় গিয়ে ঘটনা বললে, পুলিশ বিকাশ নম্বরটি অনুসন্ধান করে জানায় রুনা বেগমের ঠিকানা মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায়। তার ন্যাশনাল আইডি নম্বর ৫৮১৫৬ ৭৬৮৯ ৬১৯৬। কিন্তু এই প্রতারণার সঙ্গে ঢাকার বড় একটি সিন্ডিকেট জড়িত। তারা হয়তো রুনা বেগমকে ব্যবহার করেছে। প্রতারণাটি যেহেতু লন্ডনে সংঘটিত হয়েছে তাই সেখানে অভিযোগ করতে হবে।
আব্দুল মুমিন লন্ডনে মানি ট্রান্সফার কোম্পানি সেন্ডওয়েবকে বিষয়টি অবহিত করলে তারা বলে রুনা বেগম ইতিমধ্যে টাকা তুলে নিয়ে গেছে। তাই এখন আর করার কিছুই নেই।
তিনি বলেন, এই প্রতারক চক্র নিশ্চয় এভাবে লন্ডন প্রবাসীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। যারা প্রতারণার মাধ্যমে বিকাশে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে তাদের নাম, মোবাইল ও এনআইডি নম্বর আছে। তাই বাংলাদেশ পুলিশ চাইলে তাদের খুঁজে বের করে গ্রেপ্তার করতে পারে। তিনি তার সঙ্গে সংঘটিত প্রতারণার ঘটনাটি তদন্ত করতে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানান।
এদিকে সাদ উদ্দিন আরো জানান, ওই প্রতারক মহিলা তার মোবাইল ফোন হ্যাক করে একের পর এক আত্মীয়স্বজনের নম্বরে কল করতে থাকে। দুবাইয়ে বসবাসরত তার জামাতা ফোন করে বলেন, তার কাছেও এক মহিলা ফোন দিয়ে নিজেকে তার শাশুড়ি পরিচয় দিয়ে বলেন, তোমার শ্বশুর অসুস্থ। জরুরিভিত্তিতে বিকাশ নম্বরে টাকা পাঠানোর দরকার। এরপর কুয়েত থেকে কল করেন তার ভাতিজা মাখন। তিনিও একই কথা বলেন। পূর্ব লন্ডনের চ্যাডওয়েলহিথ থেকে কল করেন তার এক ভাগিনা। প্রতারক চক্রের কাছ থেকে তিনিও এ ধরনের কল পেয়েছেন বলে জানান। তবে তারা কেউ টাকা পাঠান নি।
এদিকে অনুরূপ আরো একটি প্রতারণার ঘটনা ঘটে ৮ই এপ্রিল বৃহস্পতিবার দুপুরে। একই কায়দায় টাকা হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা চালায় ডেগেনহ্যাম মদীনা ফাউন্ডেশন মসজিদের সাবেক ডেপুটি ইমাম সামসু মিয়ার কাছ থেকে। তিনি জানান, ৮ই এপ্রিল বৃহস্পতিবার জোহরের জামাতের পূর্ব মুহূর্তে আমার মোবাইলে একটি কল আসে। ওপাশ থেকে মহিলা কণ্ঠে একজন বলেন, তিনি মুফতি আব্দুল মালিক সাহেবের স্ত্রী। বাংলাদেশে তাদের এক আত্মীয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ডাক্তার তাকে ডিসচার্জ করেছে, কিন্তু টাকা না থাকায় বিল পরিশোধ করতে পারছেন না। জরুরিভিত্তিতে সাড়ে ৪শ’ পাউন্ড পাঠাতে হবে। মুফতি আব্দুল মালিক সাহেব মসজিদে যাওয়ার পথে আছেন। তিনি সাড়ে ৪শ’ টাকা পকেটে নিয়ে গেছেন। মসজিদে পৌঁছেই তিনি দিয়ে দেবেন। যেহেতু জরুরি তাই তিনি যেন নামাজে দাঁড়ানোর আগেই সাড়ে ৪০০ পাউন্ড পাঠিয়ে দেন। সামসু মিয়া বলেন, নামাজ শুরু হয়ে গেছে। এখন কিছু করা যাবে না। নামাজের পরে দেখবো।
নামাজ শেষ করার পর মোবাইল হাতে নিয়ে দেখতে পান তখনো একটার পর একটা কল আসছে। তখন তিনি ফোন রিসিভ করলে ওপাশ থেকে মহিলা বলেন, আপনি কি এখনো টাকা পাঠাননি? তাড়াতাড়ি পাঠান। তখন সামসু মিয়ার সন্দেহ হয় এবং তিনি মুফতি আব্দুল মালিককে ফোন করে জানতে চান তার স্ত্রী কি তাকে ফোন দিয়েছেন। তখন আবদুল মালিক নিশ্চিত করেন, তার স্ত্রী কাউকে কল করেন নি। তিনি তাকে সতর্ক করে বলেন, এসব প্রতারণা। তিনি জানান, দুইদিন আগে প্রতারণার মাধ্যমে তার কাছ থেকেও ৫০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছে এক প্রতারক।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status