বিশ্বজমিন

বিভিন্ন স্থানে টিকা কেন্দ্র বন্ধ

বিশ্বে সবচেয়ে বেশি টিকা উৎপাদনকারী ভারত টিকা সঙ্কটে

মানবজমিন ডেস্ক

১৮ এপ্রিল ২০২১, রবিবার, ২:০১ অপরাহ্ন

বিশ্বে সবচেয়ে বেশি টিকা উৎপাদনকারী দেশ ভারত। কিন্তু করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ে পরিস্থিতি বিপর্যস্ত। এ সময়ে সেখানেই লাখ লাখ মানুষ টিকার জন্য অপেক্ষা করছে। অনলাইন সিএনএনে প্রকাশিত জেসি ইয়াং এবং এশা মিত্রার লেখা প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে আরো বলা হয়, বিশ্বে যে পরিমাণ টিকা বিক্রি হয় তার শতকরা ৬০ ভাগের বেশি উৎপাদন করে ভারত। এখানেই রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া (এসআইআই)। প্রতিষ্ঠানটির রয়েছে বিপুল উৎপাদন সক্ষমতা। এ জন্য জাতিসংঘের কর্মসূচি কোভ্যাক্সে একটি বড় অবদান রাখা দেশ ভারত। কোভ্যাক্স কর্মসূচিতে বিশ্বের নি¤œ আয়ের দেশগুলোকে কম মূল্যে বা বিনামূল্যে করোনা ভাইরাসের টিকা দেয়া হচ্ছে। গত বছর প্রাথমিক চুক্তির অধীনে ৯২ টি দেশের জন্য ২০ কোটি ডোজ টিকা উৎপাদন করার কথা এসআইআই-এর। এখন থেকে কয়েক মাস আগেও ভারতের পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। কিন্তু মার্চে সেখানে দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে করোনা ভাইরাসের। ফলে পরিস্থিতি দ্রুতই প্রথম দফা সংক্রমণকে অতিক্রম করে গেছে। এখানে গত বছর সেপ্টেম্বরে এক দিনে সংক্রমিত হয়েছিলেন কমপক্ষে ৯৭ হাজার মানুষ। সেটা ছিল প্রথম দফা সংক্রমণের পিক সময়। কিন্তু সে অবস্থাকে এবার অতিক্রম করে গেছে অনেক আগেই। রোববার ভারতে একদিনে নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন কমপক্ষে ২ লাখ ৬১ হাজার ৫০০ মানুষ। ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ডাটা অনুযায়ী, এটাই এ যাবতকালের মধ্যে ভারতে একদিনে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ করোনায় আক্রান্ত হওয়ার রেকর্ড। এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে সেখানে কমপক্ষে ১০ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার এই সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় এক কোটি ৪০ লাখ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এমন অবস্থায় বিভিন্ন রাজ্যে ও শহরে নতুন করে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এর মধ্যে রাজধানী দিল্লিতে সাপ্তাহিক ছুটিতে এবং নৈশকালীন কারফিউ জারি করা হয়েছে। এই দিল্লিতে বসবাস করেন এক কোটি ৯০ লাখ মানুষ। অন্যদিকে আরো কঠোর লকডাউন দেয়া হলে অবরুদ্ধ হয়ে পড়বেন- এই ভয়ে অভিবাসী শ্রমিকরা দলে দলে তাদের নিজেদের গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন। মাঠপর্যায়ে পরিস্থিতি এমন হলেও আরো কঠিন এক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আস্তে আস্তে করোনা ভাইরাসের টিকা সরবরাহ ফুরিয়ে আসছে। কমপক্ষে ৫টি রাজ্য থেকে টিকার ভয়াবহ সঙ্কটের কথা জানানো হয়েছে। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে আহ্বান জানানো হয়েছে।
এমন উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকার এবং এসআইআই সম্মিলিতভাবে কোভ্যাক্সিন কার্যক্রমে টিকা সরবরাহ দেয়ার চেয়ে নিজের দেশে নিজের নাগরিকদের টিকা সরবরাহকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। কোভ্যাক্স কার্যক্রম পরিচালনার জোটে আছে আন্তর্জাতিক টিকা বিষয়ক সংগঠন গাভি এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ২৫শে মার্চ কোভ্যাক্স এক বিবৃতিতে বলেছে, মার্চ এবং এপ্রিলের টিকা সরবরাহ বিলম্বিত করবে এসআইআই। ভারতে করোনা ভাইরাসের টিকার চাহিদা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে এই বিলম্ব করা হচ্ছে।
এ পর্যন্ত কোভ্যাক্সে অক্সফোর্ড/এস্ট্রাজেনেকার টিকা ২ কোটি ৮০ লাখ ডোজ সরবরাহ দিয়েছে ভারত। মার্চে আরো ৪ কোটি ডোজ সরবরাহ দেয়ার কথা ছিল। এপ্রিলে দেয়ার কথা ছিল ৫ কোটি ডোজ। এ নিয়ে ভারত সরকার এবং কোভ্যাক্স আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে, এবারই প্রথম কোভ্যাক্সে টিকা সরবরাহ স্থগিত করেছে ভারত এমন নয়। জানুয়ারিতে এসআইআই উৎপাদিত এস্ট্রাজেনেকার টিকা রপ্তানিতে বিধিনিষেধ দিয়েছিল ভারত সরকার। এসআইআই-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আধার পুনাওয়ালা বলেছিলেন, তারা ভারতে আগে সবচেয়ে বিপন্ন জনগোষ্ঠীকে অগ্রাধিকার দিতে চান। এ জন্য এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
কিন্তু তাদের বার বার এই বিলম্ব করার কারণে দরিদ্র দেশগুলো প্রচ-ভাবে কঠিন অবস্থার মুখে। আফ্রিকার রোগ নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক পরিষদের পরিচালক সতর্ক করেছেন এই বলে যে, ভারতের টিকা রপ্তানি বন্ধ করায় এই মহাদেশে এক বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। পক্ষান্তরে টিকার বড় গ্রহীতা পাকিস্তান সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেসরকারি উদ্যোগে টিকা আমদানি করে শূন্যতা পূরণ করতে বিক্রির অনুমোদন দেয়ার।
ভারতের ভিতরে বর্তমানে দুটি টিকা উৎপাদন হচ্ছে। একটি হলো অক্সফোর্ড/এস্ট্রাজেনেকা। এই টিকা কোভিশিল্ড নামে পরিচিত। অন্যটি হলো ভারত বায়োটেক ও সরকারি পরিচালিত ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিকেল রিসার্চ (আইসিএমআর) যৌথভাবে উৎপাদিত টিকা কোভ্যাক্সিন। ভারতে প্রথমেই স্বাস্থ্যকর্মী এবং অগ্রাধিকারে থাকা গ্রুপকে টিকা দেয়া শুরু হয়। আগস্টের মধ্যে সেখানে ৩০ কোটি মানুষকে টিকা দেয়া সম্পন্ন করার টার্গেট ধরা হয়। কিন্তু এই উদ্যোগ বাধগ্রস্ত হয় শুরুতেই। প্রথমেই জনগণের মধ্যে এই টিকা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করতে থাকে। বিশেষ করে কোভ্যাক্সিন নিয়ে। এই টিকা জরুরি ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দেয়া হয়, যখন এর তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়। এখন পর্যন্ত মাত্র এক কোটি ৪৩ লাখ মানুষকে পুরোপুরি টিকা দেয়া হয়েছে। জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির মতে, এই সংখ্যা ভারতের ১৩০ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে শতকরা মাত্র এক ভাগের সামান্য উপরে। সরকার এই টিকা নিয়ে প্রচারণা বাড়ানোর ফলে জনগণের মধ্যে আস্থা বাড়তে থাকে। এতে টিকাদান কর্মসূচি গতি পায়। এ অবস্থায় মার্চ ও এপ্রিলে যখন প্রতিদিন করোনা ভাইরাসে সংক্রমণের গতি ত্বরান্বিত হয় তখন বেশ কয়েকটি রাজ্য থেকে টিকা সঙ্কটের রিপোর্ট আসা শুরু হয়েছে।
ওড়িশাতে টিকা সঙ্কটের কারণে গত সপ্তাহে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে প্রায় ৭০০ টিকাদান কেন্দ্র। ওড়িশার স্বাস্থ্য বিষয়ক কর্তৃপক্ষ লিখিতভাবে এ কথা জানিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারকে। এতে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে যে, রাজ্যের মজুদে যে পরিমাণ টিকা আছে তা খুব শিগগিরই শেষ হয়ে যেতে পারে। গত সপ্তাহে পাঞ্জাবের একজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা রাজেশ ভাস্কর সিএনএন’কে বলেছেন, ওই রাজ্যে কোভিশিল্ডের ৪ লাখ ৫০ হাজার এবং কোভ্যাক্সিনের ৩০ হাজার ডোজ টিকা ছিল। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই রাজ্যে বসবাস করেন কমপক্ষে ২ কোটি ৭০ লাখ মানুষ। রাজেশ বলেন, আমরা প্রতিদিন কমপক্ষে এক লাখ মানুষকে টিকা দিতে চাই। কিন্তু এ জন্য যে পরিমাণ টিকার প্রয়োজন, আমাদের কাছে বর্তমানে তার জন্য পর্যাপ্ত মজুদ নেই।
করোনা ভাইরাস সবচেয়ে বাজেভাবে আক্রমণ করেছে মহারাষ্ট্রকে। সেখানকার বেশ কিছু জেলায় অস্থায়ী ভিত্তিতে টিকাদান বন্ধ করে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু মুম্বইতে গত সপ্তাহে বন্ধ করা হয়েছে কমপক্ষে ৭০টি টিকাদান কেন্দ্র। এমন তথ্য দিয়েছেন রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী রাজেশ তোপে। এই রাজ্যে বৃহস্পতিবার নাগাদ এক কোটি ১১ লাখ ডোজ টিকা প্রয়োগ করা হয়েছে। ৭ই এপ্রিল রাজেশ তোপে বলেছেন, শহর থেকে গ্রামে সব স্থানেই আমরা টিম করে দিয়েছি। যাদের বয়স ৪৫ বছরের ওপরে তাদেরকে টিকা দেয়ার জন্য তাদেরকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এখন জনগণ টিকাদান কেন্দ্রে আসছেন। কিন্তু আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীরা তাদেরকে বলছেন- তারা টিকা পাননি। এ জন্য টিকা নিয়ে যাওয়া লোকজনকে তারা বাড়ি ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।
এমন অবস্থায় আইসিএমআরের সাবেক মহাপরিচালক নির্মল কুমার গাঙ্গুলি বলেছেন, এখন এই সঙ্কটে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ সামনে চলে এসেছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো কাঁচামালের সরবরাহ। তিনি বলেন, ভারতের উৎপাদন সক্ষমতা আছে। কিন্তু টিকা তৈরিতে যে সরবরাহ চেইন কার্যকর থাকার কথা তা বিঘিœত হচ্ছে। টিকার ফর্মুলা এবং তৈরিতে যে কাঁচামাল প্রয়োজন তা রাতারাতি পাল্টে ফেলা যাবে না। তাই আমদানি করা কাঁচামালের ওপরই আমাদেরকে নির্ভর করতে হবে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status