প্রথম পাতা

বিশেষ ফ্লাইটও বাতিল, ক্ষুব্ধ যাত্রীদের বিক্ষোভ

নূরে আলম জিকু

১৮ এপ্রিল ২০২১, রবিবার, ৯:২২ অপরাহ্ন

লকডাউনে নিয়মিত ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছেন দেশে আটকে পড়া প্রবাসীরা। বিশেষ ফ্লাইট চালুর ঘোষণা দেয়া হলেও প্রথম দিনের অর্ধেক ফ্লাইটই বাতিল হয়ে গেছে। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন যাত্রীরা। লকডাউনে কষ্ট মেনে ঢাকায় এলেও তারা এখন নতুন কষ্টে পড়েছেন। ক্ষুব্ধ যাত্রীরা গতকাল দফায় দফায় বিক্ষোভ করেছেন কয়েকটি স্থানে।

সৌদি এয়ারলাইন্সের বিশেষ ফ্লাইটের টিকিটের জন্য প্যানপ্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলের সামনে বিক্ষোভ করছিলেন জয়পুরহাট থেকে আসা জয়নাল আবেদীন। মানবজমিনকে তিনি বলেন, আমার ভিসার মেয়াদ ১৯শে এপ্রিল শেষ হবে। ১৮ই এপ্রিল রাতে সৌদি যাওয়ার ফ্লাইট, আমি কি আমার কর্মক্ষেত্রে যেতে পারবো। এ খবর জানতে কঠোর লকডাউন উপেক্ষা করে জয়পুরহাট থেকে ঢাকায় সৌদি এয়ারলাইন্সের অফিসে আসলাম। এমন কষ্ট আমার আগে কখনো হয়নি। রাতে ঘুমাইনি। জীবনের মায়া ত্যাগ করে টিকিটের জন্য এসেছি। অথচ টিকিট পাইনি। এসে দেখি টিকিটের জন্য প্রবাসীরা বিক্ষোভ করছেন। হাতে সময় আছে মাত্র একদিন। এখন আমি কি করবো। করোনাও টেস্ট করা হয়নি। আমি এখনো জানি না, আমি সৌদিতে যেতে পারবো কিনা। না যেতে পারলে পথে বসে যাবো। এখনো ঋণের টাকা শোধ হয়নি। মরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম বলেন, ২ মাস আগে রিটার্ন টিকিট নিয়ে দেশে আসছি। ১৪ই এপ্রিল সৌদি আরব ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। ফ্লাইট বন্ধ থাকায় যেতে পারিনি। গতকাল রাতে শুনেছি সৌদি এয়ারলাইন্সের বিশেষ ফ্লাইট চলবে, তাই রাতেই লকডাউন উপেক্ষা করে ১২০০ টাকা খরচ করে ঢাকায় আসছি। কিন্তু এয়ারলাইন্সের কর্তৃপক্ষ আমাদের কথা শুনতে চায়নি। প্রায় ৩ শতাধিক যাত্রী একযোগে বিক্ষোভের পরে তারা আমাদের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হয়েছেন। একটা টিকিটের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছি। শত শত মানুষের চাপ। কোথাও বসার স্থান নেই। তীব্র গরম আর করোনার ঝুঁকি নিয়ে মানুষের মধ্যে ঠেলাঠেলি করে দাঁড়িয়ে আছি। টিকিটের জন্য এসে মানা হয়নি কোনো স্বাস্থ্যবিধি। এমনও হতে পারে যুদ্ধ করে টিকিট পাওয়ার পরে যে কেউ করোনায় সংক্রমিত হতে পারে। এই দায় কে নিবে? এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণে আমরা আজ অসহায়। ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন হাজার হাজার প্রবাসী যাত্রী।

জয়নাল আবেদীন ও সিরাজুল ইসলামের মতো কয়েক শতাধিক প্রবাসী গতকাল সৌদি এয়ারলাইন্সের অফিসের সামনে টিকিটের জন্য বিক্ষোভ করেন। তাদের অভিযোগ বিভিন্ন মেয়াদে সৌদি এয়ারলাইন্সের রিটার্ন টিকিট নিয়ে দেশে এসে আটকা পড়েছেন কয়েক লক্ষাধিক সৌদি প্রবাসী। অনেকের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন ফ্লাইট চলাচল বন্ধ থাকায় অনেকে যেতে পারেন নি। অনেকের ভিসার মেয়াদ ২ থেকে ৫ দিন বাকি আছে। এই সময়ের মধ্যে সৌদি আরবে পৌঁছাতে না পারলে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বেন তারা। অনেকেই  রিটার্ন টিকিট কেটে আসলেও ফ্লাইট না থাকায় আর যেতে পারেননি। এই সময়ে ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। তারা এখন অভাব-অনটনে দিন অতিবাহিত করছেন।

বিক্ষোভকারীরা মানবজমিনকে বলেন, গত কয়েকদিন সৌদি এয়ারলাইন্সের প্রধান কার্যালয় বন্ধ রয়েছে। ফ্লাইট চলবে কিনা সে বিষয়ে তারা কোনো তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন নি। এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য প্রবাসীদেরকে যে ফোন নম্বর দেয়া হয়েছে তা বন্ধ রয়েছে। এতে তাদেরকে নানা দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়তে হয়েছে।
শুক্রবার রাতে সংবাদমাধ্যমের মাধ্যমে তারা জানতে পারেন ১৭ই এপ্রিল থেকে সৌদি এয়ারলাইন্সের বিশেষ ফ্লাইট চালু হওয়ার খবর। এমন সংবাদে অনেকেই খুশি হয়েছেন। যাদের ভিসার মেয়াদ এক সপ্তাহের কম, তারা সরকার ঘোষিত কঠোর লকডাউন উপেক্ষা করে  দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকায় আসেন। ঢাকায় এসে বিপত্তির মুখে পড়েন। সৌদি এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ তাদেরকে ফিরতি টিকিটের রি-ইস্যু করতে সময়ক্ষেপণ করে। এতে অনেকের ভিসার মেয়াদ শেষদিন কিংবা ২/৩ দিন বাকি থাকায় চিন্তিত হয়ে পড়েন। এরমধ্যে দুপুরে সৌদি এয়ারলাইন্সের গেট বন্ধ করে দেয়া হয়। এতে কাউন্টারের সামনে বিক্ষোভ করেন প্রবাসী যাত্রীরা। তারা জানান, ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে আসা এবং ফ্লাইটের দিন অতিক্রম হয়ে যাওয়ায় তারা বিক্ষোভ করেন। আগামী ১/২ দিনের মধ্যে ফ্লাইট না পেলে তারা আর সৌদি যেতে পারবেন না। ফলে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে হয়েছে তাদের। দ্রুত সময়ের মধ্যে সৌদি আরবে ফিরে যেতে বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতা চাইছেন তারা।

লাগেজ নিয়ে কুমিল্লা থেকে আসা সৌদি প্রবাসী মিলন মিয়া বলেন, ১৭ই এপ্রিল রাতে আমার ফ্লাইট হওয়ার কথা। অথচ আমি এখনো জানি না যেতে পারবো কিনা। আজ এখনো (শনিবার দুপুর ৩টা) টিকিট রি-ইস্যু করা হয়নি। টিকিট পেলে করোনার নমুনা টেস্ট করতে দিবো। ভিসার মেয়াদ হবে রোববার (আজ)। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, সৌদি এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষের সঙ্গে  যোগাযোগ করতে পারছি না। দুপুর হয়ে গেল। বাড়ি থেকে লাগেজ নিয়ে এক সঙ্গে বের হয়ে আসছি। আমার আয়ের উপর ৯ সদস্যের পরিবার চলে। আমি যদি আমার কর্মস্থলে সময়মতো না পৌঁছাতে পারি, তাহলে আমার পরিবারের দায়িত্ব কে নেবে? কাউকে মুখ দেখাতে পারবো না।

নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা মোতাহার উদ্দিন বলেন, শনিবার রাতে আমার ফ্লাইট। সকালে করোনা টেস্ট করাতে যাবো- এমন সময় জানতে পারলাম ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। ভিসার মেয়াদ শনিবার রাতেই শেষ। আমার সব শেষ হয়ে গেল। পরিবারের স্বপ্নগুলো আজ হারিয়ে গেল। এখন বাসায় ফিরার মতো সাহস পাচ্ছি না। দেশের মানুষ কর্মের খোঁজে হন্য হয়ে ঘুরছেন। আমারে কে কাজ দিবে। কেমন করে সংসার চালাবো- সেই চিন্তায় চোখে পানি চলে আসে।

মনির নামের একজন বলেন, লকডাউনের মধ্যে সিরাজগঞ্জ থেকে অনেক কষ্ট করে এবং ৫ হাজার টাকা খরচ করে টিকিটের জন্য আসছি। এখনো টিকিট পাইনি। এখানে টিকিট নিয়ে সৌদি এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ টালবাহানা করছেন। আমাদের দেশে লকডাউন থাকলেও সৌদিতে লকডাউন নেই। আমরা খবর নিয়েছি, আমাদের কফিলের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি, তারা বলছেন ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই সৌদি আরব পৌঁছাতে। এখন সমস্যা শুধু বাংলাদেশে। এখান থেকে টিকিট নিয়ে বিমানে উঠতে পারলে আর কোনো সমস্যা হবে না।

এ বিষয়ে সৌদি এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করলে সংস্থাটির ঢাকা অফিসের ব্যবস্থাপক (সেলস অ্যান্ড বুকিং) জাহিদুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, অবস্থানরত সৌদি গমনেচ্ছুদের আশ্বস্ত করেছি। যারা টিকিট পাবেন না তাদের টাকা ফেরত দেয়া হবে। আপাতত শুধু রোববার যে ফ্লাইটগুলো আছে, আমরা সেগুলোর টিকিট দিচ্ছি। পর্যায়ক্রমে এপ্রিলের ১৪, ১৫, ১৬, ১৭ এবং ১৮ তারিখের যাত্রীদের টিকিট দেয়ার চেষ্টা করছি।

এদিকে, প্রবাসী কর্মীদের জন্য বিশেষ ফ্লাইট চালুর প্রথম দিনেই চরম ভোগান্তির শিকার হয়েছেন প্রবাসী যাত্রীরা। বিশেষ ফ্লাইটের টিকিটের জন্য রাজধানীর মতিঝিলে বিক্ষোভ করছেন তারা। জানা যায়, বিশেষ ফ্লাইট চালুর খবর ছড়িয়ে পড়লে ভোররাত থেকেই বিমানের মতিঝিলের কার্যালয়ে ভিড় করেন যাত্রীরা। করোনা উপেক্ষা করে টিকিটের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেন তারা। যাত্রীদের অভিযোগ, বিমান টিকিট দিতে চাচ্ছে না। অথচ যাত্রী সংকট দেখিয়ে ফ্লাইট বাতিল করছে।

গতকাল শনিবার ১৪টি বিশেষ ফ্লাইট চলাচলের কথা থাকলেও এর মধ্যে ৭টি ফ্লাইট বাতিল হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি ফ্লাইট রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের। তিনটি সৌদি আরবের ও চারটি ফ্লাইট সংযুক্ত আরব আমিরাতের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল। পর্যাপ্ত যাত্রীর অভাব ও সৌদি আরবে ল্যান্ডিং অনুমতি না পাওয়ার কারণেই ফ্লাইটগুলো বাতিল হয়েছে। এর আগে শনিবার থেকে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, কাতার ও সিঙ্গাপুরের উদ্দেশ্যে বিশেষ ফ্লাইট পরিচালনার অনুমোদন দেয়া হয়। এদিন সকাল সাড়ে ৯টায় ওমানের মাসকাটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে গেছে একটি বিশেষ ফ্লাইট। সৌদি আরবে ল্যান্ডিং অনুমতি না পাওয়ায় ভোর সাড়ে ছয়টার রিয়াদগামী ফ্লাইটটি ঢাকা ছাড়তে পারেনি। সৌদি আরবের নিয়মে প্রতিটি বিশেষ ফ্লাইটের জন্য আলাদা ল্যান্ডিং অনুমতির প্রয়োজন হয়। অন্যদিকে পর্যাপ্ত যাত্রী না পাওয়ার কারণে বিমান কর্তৃপক্ষ বাতিল করেছে দুবাইয়ের দুটি বিশেষ ফ্লাইট। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক তৌহিদ-উল আহসান বলেন, শনিবার পাঁচটি দেশে মোট ১৪টি বিশেষ ফ্লাইট নির্ধারিত ছিল। কিন্তু নানা কারণে সাতটি ফ্লাইট বাতিল হয়েছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status