বিশ্বজমিন

‘মনে হচ্ছিল মরে গেছি’

ব্রাজিল ভ্যারিয়েন্টে যুবশ্রেণি কেন মারা যাচ্ছে!

মানবজমিন ডেস্ক

১৭ এপ্রিল ২০২১, শনিবার, ১১:২৭ পূর্বাহ্ন

ব্রাজিলে আইসিইউ ভরে গেছে যুব শ্রেণির করোনা রোগীতে। ঠাঁই নেই, ঠাঁই নেই কোথাও। এমন এক ভয়াবহ অবস্থায় সমাধিক্ষেত্রে কবর খুঁড়তে খুঁড়তে ক্লান্ত গোরখোদকরা। সমাধিক্ষেত্রে স্থান সংকুলানও এক বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। কিন্তু কেন এত ভয়াবহ হলো ব্রাজিল পরিস্থিতি? এর উত্তরে বলা হচ্ছে, সেখানে উচ্চ মাত্রায় করোনা ভাইরাসের ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়েছে। এর ফলে রেহাই পাচ্ছে না কেউই। এখন সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে যুবশ্রেণি। তাদের বয়স ৪০ বছরের নিচে। এই ভ্যারিয়েন্ট অত্যন্ত দ্রুত গতিতে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাছাড়া মানুষের আচরণও এক্ষেত্রে অনেকটা দায়ী। এসব নিয়ে একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে অনলাইন গার্ডিয়ান।

মিশেল ক্যাস্ত্রো (৩১) করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন।  মৃত্যুকে পরাজিত করে তিনি ফিরে এসেছেন। কিন্তু আইসিইউতে প্রত্যক্ষ করেছেন এক ভয়াবহ পরিস্থিতি। সেখানে যুদ্ধক্ষেত্রে নির্মিত সিনেমার দৃশ্যের মতো অবস্থা। চারদিকে শুধু মৃত্যুযন্ত্রণা। মানুষ মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে। রিও ডি জেনিরোতে এক আইসিইউতে এসব প্রত্যক্ষ করেছেন তিনি। তার পাশেই ৬ মাস বয়সী একটি শিশু যেন যুদ্ধ করছিল। শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে পারছিল না। একজন পুরুষের কিডনি ফেল করেছে। তিনি রক্ত প্রস্রাব করছিলেন। মেশিনে ব্লিপ ব্লিপ সংকেত দিয়ে যাচ্ছে। চিকিৎসকদের জানান দিয়ে যাচ্ছে আরো একটি জীবন বিদায় নেয়ার পথে। মিশেল ক্যাস্ত্রো ব্রাজিলের একজন সিস্টেম এনালিস্ট। তিনি মার্চের শুরুতে করোনা আক্রান্ত হন। এ সময়টা ব্রাজিলে করোনা মহামারির সবচেয়ে ভয়াবহ মাস ছিল। সেখানে মারা গেছেন কমপক্ষে ৩ লাখ ৬৫ হাজার মানুষ। মিশেল ক্যাস্ত্রো বলেন, এ ছিল এক যন্ত্রণার সময়। যখনই চোখ বন্ধ করতাম। মনে হতো ঈশ্বর আমাকে নরকে নিয়ে গেছেন। আমার চারপাশে সবকিছু প্রত্যক্ষ করেছি। দেখেছি শিশু, প্রাপ্ত বয়স্ক, যুবশ্রেণি এবং বডি বিল্ডার্সদের। তাদের সবার এক অবস্থা। শুধু যে করোনা ভাইরাস প্রবীণদের নিঃশেষ করে দিচ্ছে তা নয়। এমন ধারণাকে রাবিশ বলে আখ্যায়িত করেছেন তিনি। বলেন, যদি আপনি মানবজাতির কেউ হন তাহলে আপনি ঝুঁকিতে আছেন।

গত ফেব্রুয়ারিতে করোনা ভাইরাস যখন প্রথম ব্রাজিলে আঘাত করে, তখন মনে করা হয়েছিল এটা শুধু প্রবীণদের জন্য হুমকি। কিন্তু তার এক বছর পরে এই মহামারি ব্রাজিলকে যেন গ্রাস করেছে। না, সেখানে শুধু প্রবীণ নয়। করোনা ভাইরাস যেন তার প্রবণতা পরিবর্তন করেছে। কারণ, মিশেল ক্যাস্ত্রোর মতো যুব শ্রেণির পিতামাতায় আইসিইউ ভরে গেছে। তারা দৃশ্যত সবচেয়ে কঠিন অবস্থার মুখোমুখি। অস্বাভাবিকভাবে নবজাতক শিশু মৃত্য হয়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। গত বছর ব্রাজিলে করোনায় মারা গেছে কমপক্ষে এক হাজার শিশু। পক্ষান্তরে যুক্তরাষ্ট্রে এ সংখ্যা ৪৩।

ব্রাজিলে ৪২ বছর বয়সী টেলিভিশন তারকা পাওলো গুস্তাভো মারা গেছেন। রিও ডি জেনিরোর আইসিইউতে তিনি গত একটি মাস জীবনের সঙ্গে লড়াই করে হেরে গেছেন। তিনি ছিলেন সুস্থ এবং সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। তার মৃত্যু ব্রাজিলিয়ানদের মধ্যে ব্যাপক হতাশার সৃষ্টি করেছে। গত সপ্তাহে ব্রাজিলিয়ান এসোসিয়েশন অব ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিন প্রথমবারের মতো বলেছে, আইসিইউতে যেসব করোনা রোগী আছেন তাদের বেশির ভাগের বয়স ৪০ বছরের মধ্যে। ফ্রন্টলাইনে থাকা চিকিৎসকরাও এ কথাই বলেছেন। দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলে একটি হাসপাতালের আইসিউউতে ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিষয়ক ডাক্তার পেদ্রো কারভালহো। তিনি বলেছেন, যুব শ্রেণির রোগীদের বাস্তবেই সংখ্যা বৃদ্ধি দেখতে পাচ্ছি আমরা। তিনি কয়েক দিনে ২৭, ২৮, ২৯, ৩২ এবং ৩৪ বছর বয়সী করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিয়েছেন। এর মধ্যে দু’জন ছিলেন নারী। তারা সবেমাত্র সন্তান জন্ম দিয়েছেন। এর মধ্যে একজন ৩৩ বছর বয়সী আরেক রোগীর স্ত্রী। তারা চতুর্থ সন্তান নেয়ার আশা করছিলেন। কিন্তু তার স্বামীকে ডায়ালাইসিস দেয়া হচ্ছিল। তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুবই কম। কারভালহো বলেন, আমাদের চোখের সামনে যেন আমরা ঘূর্ণিঝড় দেখছি। পরিস্থিতি খারাপ থেকে আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে। আরো তীব্র হয়ে উঠছে এই প্রবণতা।

রিও ডি জেনিরোতে ফিয়োক্রজ কোভিড হাসপাতালে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেন ড. ক্লারিসে ব্রেসান। তিনি বলেছেন, তিনিও গত তিন সপ্তাহে একই ধারা পর্যবেক্ষণ করছেন। এর মধ্যে ক্রমবর্ধমান হারে অন্তঃসত্ত্বা নারীদের হাসপাতালে ভর্তি করানো হচ্ছে। তাদের গড় বয়স আস্তে আস্তে কমতির দিকে। শুক্রবার আমরা ৮০ বছরের ওপরে বয়সী রোগীদের চেয়ে ৪০ বছর বয়সী রোগী পেয়েছি বেশি। তিনি আরো বলেন, এসব রোগী দৃশ্যত কঠিন কষ্টে নিপতিত। তাদের অবস্থার অবনতি ঘটছে। আমি দেখেছি যুব শ্রেণির মধ্যে বেশি দেখা দিচ্ছে করোনার লক্ষণ। তারা সবাই যে একেবারে ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছাচ্ছেন তা নয়। কিন্তু যুব সমাজের খুব কম মানুষকেই আমরা পাচ্ছি, যাদের লক্ষণ প্রকাশ পায়নি। করোনা মহামারির শুরুতে এমনটা আমরা দেখতে পাইনি। এর ব্যাখ্যা এখন অস্পষ্ট। তবে কেউ কেউ মনে করেন ব্রাজিলিয়ান অ্যামাজনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নতুন উচ্চ মাত্রার সংক্রামক ভাইরাস এর জন্য দায়ী। ইউনিভার্সিটি অব সাও পাওলোর সংক্রামক ব্যাধি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ড. মারকোস বুলোস বলেসন, স্পষ্টত এর সঙ্গে পি১ ভ্যারিয়েন্টের কানেকশন আছে। তিনি বিশ্বাস করেন এই ভাইরাস এখন অনেক বেশি দ্রুততার সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছে এবং তা যুব সমাজকে খুব বেশি আক্রমণ করছে। তিনি বলেন, কখনো কখনো কয়েক ঘন্টা বা কয়েক দিনের মধ্যে মারা যান এসব যুবক রোগী। কেন এমন হচ্ছে তার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা আপনি পাবেন না। এটা একটা নাটকীয় ব্যাপার। তিনি এ সময় দক্ষিণ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টের সঙ্গে এর তুলনা করেন। এই ভ্যারিয়েন্টও যুব সমাজকে আক্রমণ করছে মারাত্মকভাবে।

ব্রেসান সন্দেহ করেন এই বিস্তারের জন্য মানুষের আচরণগত বিষয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কাজ করে। এই শ্রেণির মানুষরা কাজের জন্য বাইরে যান। পার্টিতে যান। রেস্তোরাঁয়, নাইটক্লাবে যান। তাই এখন দেখা যাচ্ছে বেশির ভাগ রোগী পাওয়া যাচ্ছে যাদের বয়স ৪০ বছরের মধ্যে। এরা হয়তো গৃহকর্মী, পরিচ্ছন্নকর্মী, খুচরা বিক্রেতা না হয় ওয়েটার। মোদ্দাকথা হলো, যেসব মানুষ কাজের জন্য ঘরের বাইরে যাচ্ছেন, তারাই বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন।

মিশেল ক্যাস্ত্রোর কোনো ধারণা নেই কোন ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হয়ে তিনি গত মাসে রিও ডি জেনিরোর এক হাসপাতালে গিয়েছিলেন। তার লক্ষণের মধ্যে ছিল উচ্চ তাপমাত্রা। শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যা। সেটা এমন ছিল যে তিনি যেকোনো সময় মারা যেতে পারতেন। মিশেল ক্যাস্ত্রো বলেন, আমার পুরো ফুসফুস কালো হয়ে গিয়েছিল বলে এক ডাক্তার আমাকে জানিয়েছেন। তিনি আরো বলেছেন, আমি যে বেঁচে আছি, এটা নাকি এক মিরাকল। এ জন্যই আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আইসিইউতে। সেখানে ভিতরে তিনি যা দেখেছেন সে সম্পর্কে ক্যাস্ত্রো বলেন, সে এক ভীতিকর অবস্থা। মনে হচ্ছিল যুদ্ধক্ষেত্র নিয়ে নির্মিত কোনো ছবির দৃশ্য। চারদিকে যেন যুদ্ধাহত সেনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছেন। ঘটনাটি যেন ‘দ্য ওয়াকিং ডেড’ ছবির কোনো একটি দৃশ্য। আসলেই এমনটা ঘটছে ব্রাজিলে।

সেখানে ঘুমহীন একটি রাত কাটান মিশেল ক্যাস্ত্রো। এরপর তাকে সরিয়ে নেয়া হয় বিশেষায়িত কোভিড ইউনিটে। সেখানে তিনি মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে গিয়েছিলেন। তার অক্সিজেন লেভেল একেবারে কমে গিয়েছিল। কয়েক দফা হার্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা হয়েছিল। তার হার্টবিট প্রতি মিনিটে ১৪০ উঠে যায়। আবার তা নেমে আসে মাত্র ৪০শে। তিনি বলেন, এত ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেছি, যা জীবনে আর কোনোদিন বোধ করিনি। ভীষণ ঠা-া লাগছিল। খুব বেশি শরীর ব্যথা করছিল। বুকে প্রচ- ব্যথা ছিল। প্রচ- কাশি হচ্ছিল। পুরো শরীর ব্যথা করছিল। তারপর আকস্মিকভাবে সবকিছু থেমে গিয়েছিল। বুঝতে পারছিলাম মারা যাচ্ছি। কোনো ভয় পেলাম না। কোনো ব্যথা রইল না। আর ঠা-াও লাগলো না। অনুভূতি কাজ করছিল না। মনে হচ্ছিল আমার শরীর থেমে গেছে। আমি মারা গেছি।

শুধু গত এক মাসে ব্রাজিলে মারা গেছেন কমপক্ষে ৬৬ হাজার মানুষ। এই মাসে সেখানে এক লাখ মানুষ মারা যেতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে যা-ই হোক মিশেল ক্যাস্ত্রো বেঁচে আছেন। পরের চার দিনে তার সব প্রদাহ ও সংক্রমণ আকস্মিকভাবে ভালো হয়ে গেল। তিনি চাতুবা’তে অবস্থিত বাড়ি ফিরে যান। ক্যাস্ত্রো বলেন, এ সবই মিরাকল। তার এই রোগমুক্তিতে আনন্দে কেঁদে ফেলেন তার স্ত্রী ও ২০ মাস বয়সী ছেলে আর্থুর। চিকিৎসক তাকে বলেছেন, আপনার ফুসফুস বাস্তবেই মারাত্মক খারাপভাবে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আপনি এই রোগকে পরাজিত করেছেন। এক মাস পেরিয়ে গেছে। ক্যাস্ত্রো বলেন, এখনও তার শরীরে মাঝে মাঝে ব্যথা হয়। অবসন্নতা দেখা দেয়। শ্বাসপ্রশ্বাসে কষ্ট হয়। হাঁটতে এবং খেতে কষ্ট হয়।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status