মত-মতান্তর

তাজমহল : স্থাপত্য জগতের এক অনন্য মহাকাব্য

গাজী মিজানুর রহমান

১৫ এপ্রিল ২০২১, বৃহস্পতিবার, ৫:২১ অপরাহ্ন

ভারত তথা এই উপমহাদেশের এক অমূল্য সম্পদ তাজমহল । সম্রাট শাহজাহানের সবচেয়ে প্রিয় স্ত্রী আর্জুমান্দ বানু বেগমের মৃত্যুর পর তার সমাধির উপরে সম্রাট এই তাজমজল নির্মাণ করেন । সম্রাজ্ঞীর অন্য নাম ছিল মমতাজ মহল । তাই এই সমাধিসৌধের নাম হয় তাজমহল । ১৬৩২ থেকে ১৬৫৩ সাল পর্যন্ত ২২ বছর এই প্রকল্পের নির্মাণ কাজ চলেছিল । ওস্তাদ আহমেদ লহৌরি এর তত্ত্বাবধানে অমর নাথ খান, ইশা শিরাজি, মোহাম্মদ হানিফের মতো বিখ্যাত কারিগরদের অধীনে ২২,০০০ শ্রমিক কাজ করেছিল এই প্রকল্পে । এছাড়া নির্মাণকাজে অংশ নিয়েছিল এক হাজার হাতি । নির্মাণ-কর্মীদের মধ্যে উচ্চ-স্তরের যারা ছিলেন , তাদের বেতন ছিল সে সময়ের ১০০০ রুপি যা বর্তমানে ৫ লক্ষ রুপির সমান। মার্বেল পাথর আনা হয়েছে ২৫০ মাইল দূরের রাজস্থানের মাকরানা থেকে । দামী দামী রত্ন যেমন সাদা প্রবাল , অনিক্স ,কর্নেলিয়া , নিলা , লাপিজ লাজুলি আনা হয়েছে আরব, মধ্য এশিয়া, আফগানিস্তান, তিব্বত, শ্রীলংকা এবং চীন থেকে। কর্মী আনা হয়েছে ইরান, তুরস্ক , ইতালি ও সমরখন্দ থেকে। সৌধ নির্মাণে সর্বমোট খরচ হয়েছিল এখনকার মূল্যমানের হিসেবে ২০ হাজার কোটি রুপির উপরে । কিন্তু তাজমহলের শ্রেষ্ঠত্ব টাকার অংক বিবেচনায় নয়, শ্রেষ্ঠত্ব এর রত্নখচিত কারুকাজে আর মূল্যবান শ্বেতপাথরের নান্দনিক ব্যবহারে । সেইসাথে দেশ-বিদেশের কারিগর জরো করে দুই যুগ ধরে সম্রাট শাহজাহান যে ধৈর্য আর শৈল্পিক চিন্তা নিয়ে প্রিয়তমা স্ত্রীর স্মৃতির জন্য তাজমহল নির্মাণ করেছেন , তার সেই কিংবদন্তীতূল্য একাগ্রতাই এই নয়নাভিরাম ঐতিহাসিক ভবনের আসল আকর্ষণীয় দিক । ইউনেস্কো ১৯৮৩ সালে তাজমহলকে বিশ্ব-ঐতিহ্য তালিকায় স্থান দিয়েছে ।

১৬৩১ সালে দাক্ষিণাত্যে বিদ্রোহ দেখা দিলে সম্রাট সেখানে স-সৈন্যে গমন করেন । তার অন্যান্য অভিযানের মতো স্ত্রী মমতাজ মহল তার সঙ্গী হন । তখন তিনি অন্তঃসত্তা ছিলেন । বর্তমান মধ্যপ্রদেশের অধীন বুরহানপুরের রাজকীয় তাবুতে মোগল বাহিনীর অভিযান চলাকালীন ১৬৩১ সালের জুন মাসে মমতাজ মহল তার চতুর্দশ সন্তানের জন্ম দেন । কিন্তু সম্রাজ্ঞী মৃত্যুবরণ করেন। তাকে তাপ্তী নদীর পাড়ে এক ছায়াঘন বাগানে দাফন করা হয়। সে বছর ডিসেম্বর মাসে তার দেহ কবর থেকে উঠিয়ে আগ্রায় এনে আবার দাফন করা হয় । তাজমহলের যে জায়গায় এখন মমতাজ মহলের শেষ ঠাঁই হয়েছে , তার পাশেই সম্রাট শাহজাহানের কবর । মমতাজ মহলের কবরটি চত্বরের ঠিক মাঝখানে বিধায় এটা বুঝা যায় যে , শাহজাহান এই তাজমহল কেবল মমতাজের জন্যই নির্মাণ করেছিলেন । সম্রাট শাহাজাহানের মৃত্যুর পর তার বিদ্রোহী পুত্র সম্রাট আওরঙ্গজেব পিতাকে তার মাতার পাশে সমাহিত করেন । সম্রাট-সম্রাজ্ঞীর ভালোবাসার কিংবদন্তী হয়ে যে তাজমহল এখন বিশ্ববাসীর দৃষ্টি কাড়ে , সেখানে শাহজাহান একজন অতিথি মাত্র - বড়জোর রাজকীয় অতিথি তিনি - আগন্তুকের হৃদয়ে শুধু মমতাজেরই ঠাঁই । স্বামীসুখের জন্য লালায়িত ভারতীয় রমণীদের মনে এই প্রশ্ন বারংবার উঁকি দেয় - কত বড় ভাগ্য নিয়ে জন্মেছিলেন এই রমণী , যে স্বামী তাকে এমন চোখধাঁধানো এক উপহার দিল ! আর দর্শনার্থী পুরুষেরা ভাবে যার যার ভালোবাসার মানুষের কথা । শাহজাহানের মতো তাজমহল দিতে না পারলেও কিছু-না-কিছু দেয়ার আগ্রহ জাগে তাদের মনে ।


অনেকে বলেন, শাহজাহান খামোখা এত অর্থ ব্যয় করে সে সময়ে ভারতকে দেউলিয়া করেছিলেন । এ কথা আদৌ সত্য নয় । টাকা অনেকেরই থাকে, কিন্তু খরচ করার হাত থাকে খুব কম লোকের । সম্রাট শাহজাহানের সেই খরচের হাত এবং অন্তর ছিল। মনে রাখা দরকার , এক-একটা যুদ্ধের জন্যেও কম খরচ হয় না। আর যুদ্ধ করে দেউলিয়া হলে কিছুই অবশিষ্ট থাকে না , থাকে শুধু ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরার ভয়াবহ স্মৃতি । তাজমহল নির্মাণের দুই দশক সময়ে বাদশা বড় কোন অভিযানে যাননি , তার ছেলেরা বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন । সেসব যুদ্ধের বেশিরভাগ ছিল বিদ্রোহ দমন করার যুদ্ধ । মোটা দাগে শাহজাহানের রাজত্বকালকে শান্তির সময় বলা যেতে পারে । দেশে শান্তি বিরাজমান না থাকলে সম্রাট এত বড় স্থাপনা নির্মাণকাজে হাত দিতে পারতেন না । তাজমহল কে তাই শান্তির প্রতীক বলা যেতে পারে । এই একটা স্থাপনার নাম শুনে তা দেখার জন্য আজ আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়া , আফ্রিকা , ইউরোপ এবং পৃথিবীর অন্যান্য স্থান থেকে লোক ছুটে আসে। প্রতি ভারতবাসী নজরানা দেয় ২৪৫ রুপি, সার্কবাসী ৭৩৫ , আর বিশ্ববাসী অন্যদেরকে গুনতে হয় ১২৫০ রুপি । তাজমহল দেখার জন্য হাজার মাইল থেকে ছুটে আসা মানুষ শুধু কি এই টাকাই খরচ করে ? তারা এই সুযোগে ভারতের অন্য পর্যটন স্থান ঘুরে ঘুরে দেখে , এবং তাতে ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার প্রাপ্তিযোগ ঘটে । পর্যটন খাতে তাজমহলের অবদান হিসেব করে বের করা দুঃসাধ্য ।

অনেকের কাছে মনে হয় , তাদের পূর্ব-পুরুষদের কাছ থেকে টাকা কেড়ে নিয়ে এই ইমারত করা হয়েছে।
সম্রাট শাহাজাহান তো সমগ্র হিন্দুস্তানের সম্রাট ছিলেন । তাজমহল নির্মাণের পেছনে ব্যয়িত অর্থ বেশি হলেও , বাদশাহের কাছে তা কত আর বেশি ! বিশাল হিন্দুস্তানের বাদশাহের অধীন রাজা , মহারাজা , নবাব , জমিদারেরা বাদশাহকে খুশি করতে , একটা খেতাব পেতে , কত কত টাকা দিয়েছে - গরীব নাগরিকের টাকা নেয়ার কি কোনো দরকার ছিল তার ? এই সাথে আর একটা কথা মনে রাখা দরকার যে , ধনদৌলত-টাকাপয়সা কোনো একজনের কাছে স্থায়ীভাবে থাকে না । তাজমহল না বানালে জমিয়ে রাখা ধনরত্ন হয় নাদির শাহ , নয় আহমদ শাহ আবাদালি , নয়তো ইংরেজরা নিয়ে চলে যেত। শাহজাহান তো আগ্রার মাটিতেই সম্পদ পুঁতে রেখেছেন । তাই ক্লাইভেরা জাহাজভরে নিয়ে ওয়েলস এর পাউয়েস প্রাসাদ ভর্তি করতে পারেনি । নাদির শাহেরা হাতি-ঘোড়া এবং গাঁধার পিঠে চড়িয়ে ইরানে নিয়ে নিজের সিন্দুকে ভরতে পারেনি । কোহিনূর এর মত আর দুচারটে মুক্তো ময়ুর সিংহাসনে রাখলে তা এখন ভিনদেশের রাজা-রাণীর মাথায় শোভা পেত । শাহাজাহান তাজমহলে বিনিয়োগ করেছেন বলে মাথা গুনে ভারত সরকার এখন দর্শনী নিতে পারছে। আসলে যারা সম্রাট শাহজাহানকে দোষারোপ করেন , তাদের লক্ষ্য অন্য । তা হচ্ছে মোগল শাসকদের খাটো করা। তারা
কারিগরদের হাত কাটার গল্প কিংবা তাদেরকে অন্ধ করে দেয়ার গল্প ফাঁদেন । গল্পকথার সর্বশেষ সংযোজন হলো , মমতাজের প্রতি ভালোবাসায় নয় , মমতাজের প্রতি বাদশাহের কৃত অপরাধের অনুশোচনা থেকে নির্মিত হয়েছে তাজমহল । স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার প্রেম-ভালোবাসার কীর্তিকথা মুছে ফেলতে চায় ওরা ।

কেউ কেউ ভাবেন , তাজমহল ভালোবাসার জন্য নয়, খেয়ালী সম্রাট বিশ্বকে টেক্কা দিতে গিয়ে এই সৌধ নির্মাণ করেছেন মাত্র । হতে পারে বাদশাহের সৌধ নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা তাজমহলের মাধ্যমে বিমূর্ত হয়েছে । সে-ও যদি হয় , তবু মানতে হবে এটা না বানালে তিনি অন্য আর একটা বানাতেন । তাই বলে স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা ছিল না , এ কথা তা বলা যায় না । মমতাজের মৃত্যুর পর অঝোর ধারায় কয়েকদিন যাবত অশ্রু বিসর্জন দিয়েছিলেন সম্রাট। সে কি ভালোবাসা নয় ? মোগল সম্রাটদের সব স্ত্রীদের মধ্যে মমতাজের ইমেজ অনেকটা ক্লিন ছিল । ১৬০৭ সালে বাগদানের পর থেকে ১৬১২ সালে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তাদের মধ্যে নারী-পুরুষের মধ্যে যে ভালোবাসা হয়, তাই ছিল । ১৬১২ সাল থেকে ১৬৩১ সাল পর্যন্ত বাদশাহের অন্য দুইটি স্ত্রী থাকা সত্বেও মমতাজ ছিলেন বাদশাহের প্রধান সহচরী এবং তার চৌদ্দটি সন্তানের মাতা । সম্রাট শাহজাহান রাজধানীর বাইরে যাওয়ার সময় তাকেই সাথে নিয়ে যেতেন। সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের মতো ক্ষমতার রাজনীতিতে ভাগ বসাবার কোনো আকাঙ্ক্ষাও ছিল না তার । তার একমাত্র আকাঙ্ক্ষা ছিল বাদশাহের নৈকট্য । সে কি ভালোবাসা নয় ? আওরঙ্গজেবের হাতে বন্দি হওয়ার পর শাহজাহান লালকেল্লার একটা জানালা দিয়ে অমর সৃষ্টির আকর তাজমহলের দিকে তাকিয়ে থাকতেন । তাজমহল সম্রাটের কাছে শুধু একটা পাথরের বাড়ি ছিল না । বন্দি অবস্থায় তার নিঃস্বতার উল্টোপিঠে যমুনার তীরে দাঁড়িয়ে তাজমহল তাকে তার সুসময়ের কথা মনে করিয়ে দিত । এই অমর সৃষ্টির মধ্যে শাহজাহান তার সুন্দরী এবং বিদূষী স্ত্রীর স্মৃতি হাতড়ে বেড়াতেন - এ কথা কি মিথ্যে হতে পারে ?

তাজমহল হচ্ছে ভারতের এক স্থাপত্য মহাকাব্য । এই শিল্পকর্মকে দুচোখ ভরে দেখেও সাধ মেটানো যায় না । বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাই লিখেছেন -

“এ কথা জানিতে তুমি, ভারত-ঈশ্বর শা-জাহান
কালস্রোতে ভেসে যায় জীবন যৌবন ধনমান ।
শুধু তব অন্তর-বেদন
চিরন্তন হয়ে থাক সম্রাটের ছিল এ সাধন ,
রাজশক্তি বজ্র-সুকঠিন
সন্ধ্যারক্তরাগসম তন্দ্রাতলে হয় হোক লীন,
কেবল একটি দীর্ঘশ্বাস
নিত্য-উচ্ছ্বসিত হয়ে সকরুণ করুক আকাশ
এই তব মনে ছিল আশ ।
হীরামুক্তামণিক্যের ঘটা
যেন শুন্য দিগন্তের ইন্দ্রজাল ইন্দ্ৰধনুচ্ছটা
যায় যদি লুপ্ত হয়ে যাক,
শুধু থাক
একবিন্দু নয়নের জল
কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল
এ তাজমহল।”

কালের কপোলে একবিন্দু অশ্রুর সাথে তুলনা করে তাজমহলকে তিনি যে মহাকব্যিক স্থাপত্যের স্বীকৃতি দিয়েছেন , সাহিত্যের জগতে তার জুড়ি কেবল বিশ্বনন্দিত মহাকাব্যগুলি ।

( গাজী মিজানুর রহমান, সাবেক সিভিল সার্ভেন্ট ও লেখক)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status