এক্সক্লুসিভ

বিএনপিএস’র জরিপ

৯১ শতাংশ স্কুলছাত্রী সঠিক স্বাস্থ্যবিধি জানে না

রোকনুজ্জামান পিয়াস

১৪ এপ্রিল ২০২১, বুধবার, ৮:৫৫ অপরাহ্ন

দেশের ৯১ শতাংশ স্কুলছাত্রী পিরিয়ড বা মাসিকের সময় অপরিষ্কার কাপড় ব্যবহার করে। মাসিক সংক্রান্ত সঠিক স্বাস্থ্যবিধি জানে না তারা। এদের মধ্যে মাত্র ৩৬ শতাংশ প্রথম মাসিকের আগে স্বাস্থ্যবিধি জানে। নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের অর্থায়নে সিমাভি-এর সহায়তায় পরিচালিত বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের (বিএনপিএস) এক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। ২০১৬ সালে ঋতু প্রকল্পের আওতায় নেত্রকোনা জেলার ১৪৯টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৪০৪৬ জন ছাত্রীর ওপর জরিপ চালিয়ে এ তথ্য দিয়েছে সংস্থাটি।

বিএনপিএস’র তথ্যানুযায়ী, মফস্বলের ৫৩ শতাংশ শিক্ষার্থী মাসিকের সময় কমপক্ষে ৩ দিন বিদ্যালয়ে যায় না। স্কুলগুলোতে পানি, স্যানিটেশনের স্বাস্থ্যকর বাবস্থাপনার অভাব প্রকট। ৮৬ শতাংশ শিক্ষার্থী মাসিকের সময় পুরনো কাপড় ব্যবহার করে। গ্রামাঞ্চলে মাত্র ৯ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থী স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করে। বিপরীতে ৮৭ শতাংশ শিক্ষার্থী মাসিকের সময় পুরনো কাপড় ব্যবহার করে। কাপড় ব্যবহার করা ৯০ শতাংশ গ্রামীণ শিক্ষার্থী আবার বারবার ব্যবহারের জন্য তাদের মাসিকের কাপড় গোপন স্থানে সংরক্ষণ করে। শহর এলাকায় ২১ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থীরা স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করে, বিপরীতে ৭৬ শতাংশ শিক্ষার্থী মাসিকের সময় পুরনো কাপড় ব্যবহার করে। মাসিকের সময় পুরনো ও অপরিষ্কার কাপড়ের ব্যবহারকে খুবই ঝুঁঁকিপূর্ণ বর্ণনা করে দুস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক ডা. কল্লোল চৌধুরী বলেন, মাসিকের সময় পুরনো ও অপরিষ্কার কাপড় ব্যবহার ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের আশঙ্কা বৃদ্ধি করে। মূত্রনালী ও জরায়ুতেও ইনফেকশন হতে পারে। ইনফেকশন দীর্ঘদিন থাকলে পরবর্তীতে সেটি জরায়ুর ক্যান্সারে পরিণত হওয়ার আশঙ্কাও থাকে। যদি কাপড় ব্যবহার করতেই হয়, তবে সেটি সাবান ও গরম পানি দিয়ে খুব ভালোভাবে ধুয়ে ইস্ত্রি করে জীবাণুমুক্ত করার পর ব্যবহারের পরামর্শ দেন এই চিকিৎসক।

বিএনপিএস-এর জরিপের ফলাফলে বলা হয়, স্কুলের টয়লেটের ভেতরে বা কাছাকাছি সাবান-পানির কোনো ব্যবস্থা না থাকা, নিরাপদ পানির নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ না থাকা, টয়লেটের দরজা, ছিটকানি-তালা-ব্যক্তিগত গোপনীয়তার জন্য প্রাচীর ঠিকমতো না থাকা, টয়লেট পরিচ্ছন্নতার টেকসই ব্যবস্থার অভাব, পর্যাপ্ত আলো না থাকা, ঢাকনাযুক্ত কন্টেইনার, মাসিকের উপকরণ অপসারণের টেকসই ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে ৭৫ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থী মাসিকের সময় বিদ্যালয়ের টয়লেটে যায় না। আবার যারা যায়, উপযুক্ত পরিবেশের অভাবে তারা তাদের ব্যবহৃত কাপড় বা স্যানিটারি প্যাড বদলায় না। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা নারী প্রগতি সংঘ যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে ২০১৮ সাল থেকে ‘কালেক্টিভ ইনিশিয়েটিভস টু ইমপ্রুভ মিনসট্রুয়াল হেলথ (এমএইচ) সিচুয়েশন ইন বাংলাদেশ বাই এনগেজিং এনজিও’স, সিভিল সোসাইটি অ্যান্ড প্রাইভেট সেক্টর’ নামে একটি প্রকল্প পরিচালনা করছে। প্রকল্পটির পরিচালক নাসরিন বেগম বলেন, প্রতি ৬ ঘণ্টা অন্তর ব্যবহৃত ন্যাপকিন বা কাপড় পাল্টানো দরকার। তা না হলে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে, দেখা দিতে পারে নানা জটিল রোগ। কিন্তু জরিপের ফল অনুযায়ী স্কুলের পরিবেশ মাসিকবান্ধব নয়। তাই বাধ্য হয়েই বেশিরভাগ মেয়ে মাসিকের সময় স্কুলে যায় না। যা, মেয়েদের শিক্ষাক্ষেত্রেও বাধার সৃষ্টি করছে।

জরিপের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে বিএনপিএস বেশকিছু সুপারিশ করেছে। তারা বলছে, বয়ঃসন্ধিকাল, ঋতুস্রাব, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয়ের আঙ্গিকে মাধ্যমিক ও দাখিল পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তক ও পাঠদান, মাসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নের জন্য সঠিক এবং ব্যাপক তথ্যের সমপ্রসারণ এবং মাসিক অনুকূল সেবা প্রদানমূলক পরিবেশ তৈরি একান্ত প্রয়োজন। মাধ্যমিক স্কুল পর্যায়ে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শারীরিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও গার্হস্থ্য বিজ্ঞান বইয়ে বয়ঃসন্ধিকাল, ঋতুস্রাব, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয়গুলো আছে, তবে এক্ষেত্রে তথ্যের অপর্যাপ্ততা ও যুক্তিসিদ্ধ বিন্যাসের ঘাটতি রয়েছে। এ ছাড়া মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই। অন্যদিকে এ বিষয়ে ট্যাবু ও অসচেতনতার কারণে শিক্ষকরাও অনেক সময় পাঠদানের ক্ষেত্রে বিষয়গুলোতে এড়িয়ে যান। এসব ট্যাবু ভাঙতে পারলে মাসিক সংক্রান্ত এসব সমস্যা দূর হবে। এ জন্য সচেতনতা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই।
বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের উপ-পরিচালক শাহনাজ সুমী বলেন, এ বিষয়ে সরকারের সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে, সরকারের পলিসিও আছে কিন্তু সেগুলোর বাস্তবায়ন নেই। এ ছাড়া যারা এ বিষয়ে সার্ভিস প্রোভাইডার তাদের মধ্যে জেন্ডার সেনসিভিটি নেই বললেই চলে। ফলে পলিসিতেই সীমাবদ্ধ থাকে কার্যক্রম। তিনি বলেন, এ বিষয়ে পাঠ্যপুস্তকে খুবই সামান্য আছে, বিস্তারিত নেই। বিস্তারিত আলোচনা থাকলে মেয়েরা নিজেরাই সচেতন হয়ে নিজেদের সেইফটি নিশ্চিত করতে পারতো। শাহনাজ সুমী বিষয়টি বিবেচনায় সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
বর্তমান পরিস্থিতি পরির্তনের প্রশ্নে সিমাভি বাংলাদেশের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মাহবুবা হক কুমকুম বলেন, মাসিক নিয়ে সমাজের ট্যাবু ভাঙতে সবার আগে পরিবারকেই এগিয়ে আসতে হবে। একইসঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত পরিপত্র মেনে মাসিকবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি এবং এই বিষয়ে সংবেদনশীল হতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মনিটরিংও বাড়াতে হবে। এ ছাড়া মাসিক নিয়ে যেসব কুসংস্কার আছে, তা দূর করতে সরকারকেও কার্যকরী উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টা, উদ্যোগ ও কার্যকরী ভূমিকা ছাড়া পরিস্থিতি বদলানো সত্যিই কঠিন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status