বই থেকে নেয়া

মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে-২১

‘সরকারে আসার পর সবাই মনে করে, ক্ষমতা তাদের জন্য চিরস্থায়ী’

স্টাফ রিপোর্টার

১২ এপ্রিল ২০২১, সোমবার, ১০:০৮ পূর্বাহ্ন

মঙ্গলবার ১ মে ২০০৭ দিন ১৯
এখন আমি প্রতি একদিন পরপর শেভ করছি। চুলে রঙ মাখা বন্ধ করেছি। এতে সময়ের কিছু সাশ্রয় হয়েছে।
আজকাল ভীষণ রকম বিষণ্নতায় ভুগছি। মাঝে মাঝে আমান, আনা, হাসনা আর জোরাহর কথা ভেবে চোখের পানিতে বুক ভেসে যায়। আমার জন্য এ এক দারুণ যন্ত্রণাকর অনুভূতি।

আমার অনুভূতি আমি ভাষায় বোঝাতে পারবো না। দেশের জন্য এতকিছু করার পর আজ আমাকে জীবনের শেষপ্রান্তে এসে নিগৃহীতের জীবনযাপন করতে হচ্ছে। আমি জানি না আর কতদিন আমার আয়ু অবশিষ্ট আছে এবং আমি এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সফল হবো কি না। হয়তো আমার নীরবে মরে যাওয়াই হবে সকলের জন্য ভালো। জীবনের কোনো মূল্য নেই বলেই মনে হচ্ছে। সবকিছু ছেড়ে দিয়েছি আল্লাহ্র হাতে। আল্লাহ্ যা ভালো মনে করেন তাই করবেন।

আজ কেউ আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেনি। আমি অন্ততঃপক্ষে শহীদ এবং খোকনকে আশা করেছিলাম। গত ছয়দিন ওরা আসেনি। আমার কাছে এটা খুব ভালো ঠেকছে না। কারণ বাইরের পরিস্থিতিও খুব ভালো বলে মনে হচ্ছে না। আল্লাহ্ তাদের নিরাপদে রাখুন।

বুধবার  ২ মে ২০০৭  দিন ২০
আমি কিছুতেই ১৪ থেকে ১৮ই এপ্রিল রিমান্ডের সেই বিভীষিকাময় দিনগুলোর কথা ভুলতে পারি না। প্রায়ই মনে পড়ে ১৩ই এপ্রিল কীভাবে আমার বাড়ি সারারাত তল্লাশি করে আমাকে চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল অচেনা এক জায়গায় এবং গভীর রাত পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদ ও নির্যাতন চালানো হয়েছিল আমার ওপর।
কিন্তু ১৪ই এপ্রিল কোর্ট পুলিশ রিমান্ড মঞ্জুর করার পর আমাকে দু’চোখ বেঁধে কোর্টরুম থেকে সেই একই জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। প্রত্যেক দিন আমার ওপর ২-৩ দফা জিজ্ঞাসাবাদ করা হতো। দেওয়া হতো দৈহিক অত্যাচারের হুমকি। আমাকে ভয় দেখানোর জন্য শোনানো হতো পাশের ঘর থেকে ভেসে আসা প্রহাররত কারো যন্ত্রণাকাতর আর্তনাদ। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আসতো বিভিন্ন গ্রুপের লোকজন। এদের মধ্যে রাজনৈতিক একটি গ্রুপ অনেক বিষয়ের ওপর আমার পরামর্শ নিয়ে গেছে। রিমান্ডের শেষদিনে আমাকে একটি ভিডিও ক্যামেরার সামনে রেখে একটি টাইপ করা কাগজ পড়তে বাধ্য করা হয়। কাগজটিতে ছিল ওদেরই প্রস্তাবমতো লেখা স্বীকারোক্তি। রিমান্ডের পুরো প্রক্রিয়াটিই ছিল বেআইনি। সেই ভয়াবহ দিনগুলোর আতঙ্ক আমি কিছুতেই ভুলতে পারি না।
আমার স্টাফ শহীদ এবং আমেরিকাবাসী আমার এক ভাতিজা ফাহিম এসেছিল আমাকে দেখতে। ওদের সঙ্গে এসেছিল কবিরহাটের আমার দুই কর্মী শাহাবুদ্দিন ও তানসেন। সারাক্ষণ ওরা শুধু কাঁদছিল।
আজকাল আমার সঙ্গে দেখা করার ওপর অনেক বেশি কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। সপ্তাহে মাত্র একদিন এবং একসঙ্গে অনধিক পাঁচজন।

বৃহস্পতিবার ৩ মে ২০০৭ দিন ২১
আরেকটি গরম ও ভ্যাপসা দিন। এ সরকারে কী দশা হবে তা আমাদের সকলেরই জানা। খুব জলদিই এদের সময় ঘনিয়ে আসছে। অবসান হবে এদের রাজত্বের। সরকারের ক্ষমতায় আসার পর সবাই মনে করে যে, ক্ষমতা তাদের জন্য চিরস্থায়ী। আমরাও সবসময় এটাই মনে করতাম। কিন্তু বাস্তবে কোনো ক্ষমতাই চিরস্থায়ী নয়। সবই অতি সাময়িক।

এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, আমাদের সরকার সুশাসনে অনেকটা ব্যর্থ হয়েছে। শুধু তাই নয়, অনেক ক্ষেত্রে ছিল অব্যবস্থাপনা ও অপশাসনের নমুনা। মন্ত্রী ও নিজের দপ্তরকেন্দ্রিক লোকজনের বিভিন্ন রকমের দুর্নীতি প্রধানমন্ত্রী বন্ধ করতে পারেননি। তিনি হয়তো অনেক কিছু জানতেনই না। আজ গোটা জাতিকে তার মাশুল দিতে হচ্ছে।
কিন্তু দুর্নীতি এক ধরনের সংক্রামক ব্যাধি। কোনোদিন এটি সমূলে বিনষ্ট হবে না। দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের ব্যর্থতার সুযোগ নিয়ে কতিপয় জেনারেল দুর্নীতি উৎপাটনের নামে এবং তথাকথিত সংস্কারের ধুয়া তুলে বেসামরিক কিছু লোকের পৃষ্ঠপোষকতায় ক্ষমতা দখল করেছে। বেসামরিক এ সমস্ত মহলের সঙ্গে দেশের ব্যাপক জনগণের বিন্দুমাত্র যোগাযোগ বা সম্পর্ক নেই এবং গোটা জীবনে একবারও তারা নির্বাচিত হতে পারেননি। বেপরোয়াভাবে তারা রাজনীতিবিদদের তাদের টার্গেটে পরিণত করেছেন। কতজন রাজনীতিককে তারা সাজা দিতে পারবেন? এর ফলে কি দুর্নীতি বন্ধ হয়ে যাবে?

উপরন্তু, ওদের পরিচয় কী? কার ম্যান্ডেট অর্জন করেছে ওরা? কোথায় তাদের কাজের সাংবিধানিক স্বীকৃতি? ওদের জবাবদিহিতা কার কাছে?

আমার শিরদাঁড়ার ব্যথাটা ফিরে এসেছে। ১৯৯২ সালে এক জনসভায় যখন আমি মঞ্চে বসা ছিলাম, তখন সভার আয়োজন ভেঙে দেওয়ার জন্য কিছু ক্ষমতাসীন দলের সন্ত্রাসী মঞ্চের ওপর হামলা চালায়। এতে মঞ্চ ভেঙে যায় ও আমি আহত হই। সে ঘটনা থেকেই এই ব্যথার উৎপত্তি।

আজ কেউ আসেনি আমাকে দেখতে। বড় একা একা লাগছে।

শুক্রবার ৪ মে ২০০৭  দিন ২২
সর্বত্র দেখছি দুর্নীতির ছড়াছড়ি। সারা প্রশাসনের ভেতরে এই দুর্নীতি চলছে ব্যাপক হারে। কিছুসংখ্যক রাজনীতিবিদকে শাস্তি দিয়ে কতিপয় লোক হয়তো আত্মসন্তুষ্টি লাভ করতে পারে, কিন্তু এতে দুর্নীতি কোনোদিনই সমূলে উৎপাটিত হবে না। আসলে সিস্টেম এবং ইনস্টিটিউশনই হলো দুর্নীতিপরায়ণ। দুর্নীতি দূর করতে হলে প্রথমে এদের পরিশুদ্ধ করতে হবে।

মুদ্রাস্ফীতির হার ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর দাম প্রতিদিন বাড়ছে। এমনকি বিবিসিও বিষয়টি তুলে ধরে গতকাল এক সুদীর্ঘ অনুষ্ঠান প্রচার করেছে। রেডিও টুডে বিষয়টি নিয়ে একটা বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করেছে।

বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি ভয়াবহ। উন্নতির কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। প্রত্যেক দিন ৭-৮ বার বিদ্যুৎ চলে যায়। কোনো কোনো সময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুতের দেখা মেলে না।

দ্রব্যমূল্য এবং বিদ্যুৎ হলো দু’টো বিষয়, যার জন্য বিএনপিকে অব্যাহতভাবে সমালোচনার শিকার হতে হয়েছে। জরুরি অবস্থার ছত্রছায়ায় যে সরকার চলছে জনগণ তাদের নিয়ে কী ভাবে সেটা তারা অনুধাবন করতে পারে না। আশ্চর্যজনকভাবে ওরা সবসময় ভাবে জনগণ ওদের সঙ্গেই আছে। একবার জরুরি অবস্থা তুলে দিয়ে ওদের উচিত এই গ্রহণযোগ্যতা পরীক্ষা করা। এত আত্মবিশ্বাসী হলে এটা ওরা করছে না কেন? আসলে এরপর এক সপ্তাহ সরকার টিকে থাকতে পারবে না।

ব্যথা বাড়ছে। জেল ডাক্তার এসেছেন আমাকে দেখতে।
আমাকে কেউ দেখতে আসেনি আজ।

শনিবার ৫ মে ২০০৭ দিন ২৩
কোনো দেশই একটি রাজনৈতিক শূন্যতার মধ্যে বেশিদিন থাকতে পারে না। সাংবিধানিক ম্যান্ডেটবিহীন সামরিক বাহিনী সমর্থিত একটি সরকার কেবলমাত্র জরুরি অবস্থার ছত্রছায়ায় থেকে সেই শূন্যতা পূরণ করতে পারবে না।
এর আগে সেনাবাহিনী প্রধান তার বিভিন্ন বিবৃতি ও কর্মতৎপরতায় এমন একটা ধারণা দিয়েছিলেন যে, সেনাবাহিনী আরো সক্রিয় ভূমিকা রাখার চিন্তাভাবনা করছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অবস্থান করছে কেবলমাত্র একটি প্রক্সি সরকার হিসেবে এবং পর্দার অন্তরাল থেকে সেনাবাহিনীর অফিসারেরাই প্রধান প্রধান সিদ্ধান্তগুলো নিচ্ছেন। এখন পর্যন্ত সে অবস্থাই চলে আসছে। কিন্তু আর কতদিন এমন চলবে?

সেনাবাহিনী প্রধান মইনুদ্দীন একবার রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্মেলনে রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেছিলেন যে, বাংলাদেশে রাজনীতিতে কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে হবে। বিভিন্ন সময়ে সরকারের মুখ থেকে যে সব প্রস্তাব উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসকে দিয়ে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করা, ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে একটি জাতীয় সরকার গঠন করা। সশস্ত্র বাহিনী প্রধানের নেতৃত্বে একটি জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ গঠন করা, রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করে সেনাবাহিনী প্রধানকে সে স্থানে অভিষিক্ত করা এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে নবযাত্রার উদ্যোগ হিসেবে হাসিনা ও খালেদাকে দেশের বাইরে নির্বাসিত করা। অথচ এদের কোনোটাই শেষাবধি বাস্তবে পরিণত করা সম্ভব হবে না।

আমার শরীর ভালো লাগছে না। নতুন ওষুধে কিছুটা কাজ হচ্ছে বলে মনে হয়। কেউ আসেনি আমাকে দেখতে। ভুগছি একাকীত্বে।

(চলবে..)

আরো পড়ুন-
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৪)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৫)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৬)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৭)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৮)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৯) 
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১০)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১১)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১২)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৩)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৪)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৫)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৬)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৭)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৮)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৯)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২০)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status