অনলাইন

‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ থেকে উঠতি তারকা, বাংলাদেশের দীর্ঘ যাত্রা

১২ এপ্রিল ২০২১, সোমবার, ৮:৪৮ পূর্বাহ্ন

পঞ্চাশ বছর আগে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশের রাস্তাগুলোতে পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক নিহত শিক্ষার্থী ও বুদ্ধিজীবীদের লাশ পড়ে ছিল। পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের সন্ধানে হলগুলো তন্ন তন্ন করে খুঁজেছিল। ঢাকা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম অংশ, দেশটি ছিল পাকিস্তান- এমন একটি জাতি যা ধর্ম দ্বারা ঐক্যবদ্ধ, ভাষা দ্বারা বিভক্ত এবং ভারতীয় ভূখণ্ড থেকে পরস্পর ১,৩০০ মাইল দূরত্ব বিচ্ছিন্ন ছিল। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সহিংসতার মাধ্যমে পৃথক হয়েছিল। বিশ্বের সবচেয়ে মারাত্মক গ্রীষ্মম-লীয় ঘূর্ণিঝড় ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তানকে বিধ্বস্ত করে, এই প্রদেশে বিরক্তির উদ্রেক হয় যেটি বছরের পর বছর ধরে নিজেকে অবহেলিত মনে করে আসছিল এবং পাকিস্তানি ফেডারেশনের মধ্যে থেকে আরো বেশি অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন চাইছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনে নিউ ইয়র্কভিত্তিক লেখক সলিল ত্রিপাঠীর এক নিবন্ধে আরো বলা হয়:

১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের ১৭২টি আসনের মধ্যে স্বায়ত্তশাসন প্রার্থী আওয়ামী লীগ দুটি আসন বাদে সবক’টিতেই জয়লাভ করে। পশ্চিম পাকিস্তান (আজকের পাকিস্তান) করাচির ফেডারেল এসেম্বলিতে ১৩৮ জন সদস্য পাঠায়, যার অর্থ আওয়ামী লীগ অবিভক্ত পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং তার নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে বেসামরিক সরকার গঠনের জন্য আমন্ত্রণ জানানো উচিত ছিল। কিন্তু পাকিস্তানকে শাসন করা জেনারেলরা সেটি ভাবলেন না। বেসামরিক নাগরিকদের প্রতি গভীর সন্দেহ পোষণ করে এবং পাকিস্তানের প্রতি বাঙালিদের আনুগত্য সম্পর্কে অনিশ্চিত হয়ে তারা আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদদের সঙ্গে দীর্ঘ এবং হতাশ করা আলোচনা চালান। ৭ই মার্চ শেখ মুজিব তুমুল উত্তেজনাপূর্ণ বক্তব্য রাখেন, যেখানে তিনি স্বাধীনতা ছাড়া সবকিছুই ঘোষণা করেন। পূর্ব পাকিস্তানিরা ফেডারেল সরকারকে সহযোগিতা বন্ধ করে দেয়; প্রতিদিনই মিছিল ও প্রতিবাদ চলতে থাকে। শ্রমিকরা চট্টগ্রাম বন্দরে কাজ বন্ধ করে দেয়।
২৫শে মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইট শুরু করে যা ছিল জনবিক্ষোভের বিরুদ্ধে এক নৃশংস দমন, শীর্ষস্থানীয় আওয়ামী লীগ রাজনীতিবিদদের গ্রেপ্তার এবং বাঙালি বিচ্ছিন্নতাবাদকে সমর্থন করার অভিযোগে যে কাউকে লক্ষ্য করে গণহত্যা। সে সময়কার Dacca-য় অবস্থানরত যুক্তরাষ্ট্রের প্রবীণ কূটনীতিক আরচার ব্লাড পররাষ্ট্র দপ্তরে বার্তা
পাঠান যে, পাকিস্তান গণহত্যা চালাচ্ছে। তবে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের অধীনে হোয়াইট হাউসের অন্যান্য অগ্রাধিকার ছিল: মাও সেতুংয়ের চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের দুর্দান্ত খেলায় পাকিস্তান ছিল ইচ্ছুক সহযোগী, দেশটি মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের চীনে গোপন সফরে সহায়তা করেছিল। নিক্সন এবং কিসিঞ্জার দু’জনই পাকিস্তানি নেতা ইয়াহিয়া খানকে পছন্দ করেছিলেন, যিনি সমস্যা সমাধানে দৃঢ়সংকল্প দেখিয়েছিলেন।

পূর্ব পাকিস্তানে কর্তৃত্ব পুনর্বহাল করার চেষ্টা করতে গিয়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী মুসলমান, হিন্দু, খ্রিষ্টান কাউকে ছাড়েনি। অনেক বাঙালি পুরুষ এবং তরুণ সীমান্ত পেরিয়ে ভারত চলে যায়, যেখানে কেউ কেউ মুক্তিবাহিনী নামে একটি বিদ্রোহী বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল, যা ছিল স্বতন্ত্র এবং সুস্পষ্টভাবে ভারত সমর্থিত। প্রায় এক কোটি শরণার্থী যাদের মধ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ছিল হিন্দু, বাকিরা মুসলমান- সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে যায়, যে দেশ ছিল আরো বেশি জনবহুল তবে একইরকম দরিদ্র। পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা অব্যাহত ছিল এবং পরের মাসগুলোতে লক্ষ লক্ষ বেসামরিক লোক মারা যায়। পাকিস্তানি সেনারা হাজার হাজার নারীকে ধর্ষণ করে, তাদের মধ্যে অনেককে বারবার ক্যাম্পের ভেতরেও ধর্ষণ করে। তারা বহু লোককে অপহরণ করে, ধরে নিয়ে যায় এবং নির্যাতন করে যাদের তারা বিদ্রোহী সেনাবাহিনীর অংশ বলে সন্দেহ করেছিল। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে, পাকিস্তানের বিমান বাহিনী ভারতের বিমান ঘাঁটিতে আক্রমণ করে যা ভারতকে ওই যুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে অংশ নেয়ার বৈধ সমর্থন দেয় (একটি স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান তার বহু বছরের প্রতিদ্বন্দ্বীকে দুর্বল করে দেয়, যে কারণে ভারতের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ মানবতাবাদী বা নিঃস্বার্থ ছিল না)। ভারত দ্রুততার সঙ্গে কাজ শুরু করে দেয় এবং পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সেনারা দুই সপ্তাহের মধ্যে ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করে।

নিবন্ধে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি আখ্যা দেয়ার ঘটনা উল্লেখ করে বলা হয়:
একটি নতুন জাতি, বাংলাদেশ জন্মলাভ করে, তবে তার প্রত্যাশা কম থাকতে পারে না। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে এক বৈঠককালে যুক্তরাষ্ট্রের পলিটিক্যাল আন্ডার সেক্রেটারি উরাল এলেক্সিস জনসন তাৎক্ষণিক দেশটিকে ‘ইন্টারন্যাশনাল বাস্কেট কেস’ হিসেবে আখ্যা দেন। কিসিঞ্জার একমত হয়ে জবাব দিলেন: ‘হ্যাঁ, তবে শুধু আমাদের বাস্কেট কেস নয়।’
পঞ্চাশ বছর পর, অনেক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে প্রচুর অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতির পর, বাংলাদেশিরাই শেষ হাসি হাসছে। স্বাধীনতার পরপরই বাংলাদেশ খরার মুখোমুখি হয় এবং ঘূর্ণিঝড়গুলো বন্যাপ্রবণ দেশটির নদ-নদীর জন্য লাগাতার অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশটির রাজনীতিও বিভেদমূলক ছিল, প্রধানমন্ত্রী এবং পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি হওয়া শেখ মুজিবকে ১৯৭৫ সালে এবং ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে হত্যা করা হয়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার (শেখ মুজিবের কন্যা) প্রাণনাশেরও চেষ্টা করা হয়েছে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া (যিনি জিয়াউর রহমানের বিধবা স্ত্রী) এবং হাসিনার মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্র এবং ব্যক্তিগত। তারা একে অপরকে রাজনৈতিক সহিংসতার অনুমতি দেয়ার, দুর্নীতির জন্য উৎসাহিত করার এবং বারবার ধর্মঘটের মাধ্যমে অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেয়ার চেষ্টার অভিযোগ করেন। তবে ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং এরপর বিরোধী দলকে ধ্বংস করে দু’বার নির্বাচিত হয়েছেন। যে নির্বাচনগুলোকে পর্যবেক্ষকরা ব্যাপকভাবে ত্রুটিযুক্ত বলেছেন।

বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের প্রভূত উন্নতির প্রশংসা করে সলিল লিখেছেন:

তবুও, এ জাতীয় সরকার থাকা সত্ত্বেও, বাংলাদেশ বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়ন সূচকে বিস্ময়কর পারদর্শিতা দেখিয়েছে। প্রত্যাশিত আয়ু ৭২.৬ বছর, স্বাধীনতার সময়ের ৪৬.৬ থেকে যাকে বিশাল এক লাফ বলা চলে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুসারে, প্রায় সমস্ত বাংলাদেশি শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ করে, ১৯৮০ এর দশকের তুলনায় যা উল্লেখযোগ্য উন্নতি, যখন প্রায় এক তৃতীয়াংশ শিশুই প্রাথমিক শেষ করতো। বাংলাদেশের নারী সাক্ষরতার হার ৭২ শতাংশ যা ভারতের চেয়ে (৬৬ শতাংশ) বেশি এবং পাকিস্তানের (৪৬ শতাংশ) তুলনায় অনেক বেশি। প্রতি ১০০০ জনের মধ্যে ২৬ জনের মৃত্যু নিয়ে দেশটিতে শিশু মৃত্যুর হার ভারতের (২৮) এবং পাকিস্তানের (৬৭) চেয়ে কম। ১৯৭১ সালে জনসন এবং কিসিঞ্জার যখন তলাবিহীন ঝুড়ি দেখতে পেয়েছিলেন, তখন শিশু মৃত্যুর হার ছিল ১৫৮ জন। শ্রমশক্তিতে বাংলাদেশের নারীর অংশগ্রহণের হার আন্তর্জাতিক মান অনুসারে কম (৩৬ শতাংশ) তবে তা পাকিস্তানের (২১.৯ শতাংশ) এবং ভারতের (২১.৫ শতাংশ) চেয়ে বেশি। এবং প্রতি নারীর ২.০৪ ফারটিলিটি রেট নিয়ে বাংলাদেশ ভারতের ২.২২ এর নিচে নেমে গেছে। প্রজন্মের মধ্যে উচ্চ জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে দারিদ্র্যতা এক হয়ে গিয়েছিল, যেটিও আর থাকবে না।
এই সামাজিক অগ্রগতির অনেকটা কৃতিত্বই বাংলাদেশের নাগরিক সমাজকে দিতে হবে। বড় ঔষধ কোম্পানিগুলোকে ক্ষেপিয়ে কম দামে ওষুধ সাধারণ মানুষের নাগালে আনতে ১৯৮০’র দশকে ওষুধ নীতিতে জোর দেয়ার ক্ষেত্রে জাফরুল্লাহ চৌধুরী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তার অলাভজনক প্রতিষ্ঠান জনস্বাস্থ্য চমৎকার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ফজলে হাসান আবেদ ব্র্যাক নামে একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান করেছিলেন, যা শিশুদের স্বাস্থ্যের উন্নতির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে এবং আজ বিশ্বের বৃহত্তম উন্নয়ন সংস্থাগুলোর মধ্যে একটি। মুহাম্মদ ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংক দরিদ্র বাংলাদেশিদের জন্য ক্ষুদ্রঋণ দিয়েছিল যা তাদের রাষ্ট্রীয় বা উন্নয়ন সংস্থাগুলোর অনিশ্চিত সহায়তার উপর নির্ভর করার পরিবর্তে তাদেরকে উদ্যোক্তায় পরিণত করে। ২০০৬ সালে ড. ইউনূস তার উদ্ভাবনের জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন।

বাংলাদেশ এখন বিশ্বের শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে একটি। এক্ষেত্রে স্বল্প মজুরিই তার মূলধন। কারণ দেশটি খুব কমই তুলা উৎপাদন করে এবং টেক্সটাইল যন্ত্রপাতিও বাইরে থেকে আমদানি করতে হয়। দেশটি বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ডগুলোকে পোশাক সরবরাহ করে এবং এই খাতের ৪৪ লাখ শ্রমিকের বেশির ভাগই নারী। এমন একটি দেশে এটা অপরিসীম ক্ষমতায়নের ঘটনা যেখানে অন্যান্য কর্মসংস্থান খুব কম। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রর প্রায় ৮০ শতাংশই এই খাত থেকে আসে। বিদেশ থেকে প্রায় এক কোটি প্রবাসী শ্রমিক বার্ষিক রেমিটেন্স হিসেবে ১৫ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠান, যা জাতীয় আয়ের আরেকটি উল্লেখযোগ্য অংশ। গত অক্টোবরে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল অনুমান করেছিল যে ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ভারতকে ছাড়িয়ে যাবে। ঢাকায় কৌতুক করা হয় যে, সীমান্তে বাংলাদেশিদের অনুপ্রবেশ থেকে দূরে রাখতে ভারত তার সীমান্ত বরাবর যে কাঁটাতারের বেড়া গড়ে তুলতে চায় শিগগিরই সেটি বাংলাদেশে চাকরির সন্ধান করা ভারতীয়দের বাংলাদেশ থেকে তাড়াতে প্রয়োজন হবে।

রক্তক্ষয়ী জন্ম, প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং তার প্রথম কয়েক বছরে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি বিবেচনায় এসবই ব্যতিক্রমী অগ্রগতি। জাতিসংঘ ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে বলেছে, বাংলাদেশ তার স্বল্পোন্নত দেশের মর্যাদা থেকে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন করেছে। এটাই এই দেশের জন্য একটি অর্জনÑ বিশেষত এর পরিশ্রমী নাগরিকদের- যাদের গর্বিত হওয়া উচিত।

মূলত সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম বাংলাদেশে যখন ‘ইসলামিজম’ বৃদ্ধি পাচ্ছে- একটি ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দল বিরোধী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সাথে জোটবদ্ধ হয়েছে, অন্য ইসলামপন্থি সংগঠনগুলো নিয়মিতভাবে ইসলামী আইন জারির দাবি করে। অনেক বাংলাদেশিই ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি বদ্ধপরিকর। ১৯৭৫ এবং ১৯৯০ এর মধ্যে স্বৈরশাসকরা ধারাবাহিকভাবে ইসলামী আইন প্রবর্তন করে। শেখ হাসিনার দল, নামধারী ধর্মনিরপেক্ষ আওয়ামী লীগ, ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম বহাল রেখে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারে সংবিধান সংশোধন করেছে।

মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলোর দাবিসমূহ সরকারের জন্য মারাত্মক চ্যালেঞ্জ এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর পর্যায়ক্রমে হামলা হচ্ছেÑ এমন মন্তব্য করে সলিল লেখেনঃ সম্প্রতি, ২৮শে মার্চ, কট্টরপন্থি ইসলামপন্থি গোষ্ঠীর সদস্যরা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশের ৫০তম বার্ষিকী উদ্যাপনে যোগ দেয়ার প্রতিবাদ জানানোর সময় হিন্দু মন্দিরে হামলা চালায়।

এমনকি হাসিনা প্রশাসন যেমন ধর্মীয় মৌলবাদী হামলাকে হ্রাস করতে চেয়েছিল, তেমনি ধর্মনিরপেক্ষ, উদার জনসাধারণের প্রতি তার সমর্থনও দুর্বল ছিল। যখন মৌলবাদীরা মুক্তচিন্তার, নাস্তিক এবং যুক্তিবাদী ব্লগার, লেখক এবং প্রকাশকদের আক্রমণ করেছিল (কমপক্ষে ১১ জনকে ২০১৩ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে হত্যা করা হয়ে) তখন তাদের বলা হয়েছিল তারা যাতে নিজেদের লেখার ব্যাপারে সতর্ক থাকেন এবং আক্রমণাত্মক বা স্পর্শকাতর বিষয়ে না লেখেন। বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি লেখক এবং ব্লগার এখন প্রবাসে নির্বাসিত।

সরকারবিরোধী মতের উপর কঠোর হয়ে নেমে পড়েছে। সাম্প্রতিককালে উগ্রপন্থা এবং অশ্লীলতা রোধে ২০১৮ সালে পাস করা কুখ্যাত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন জারি করেছে তবে এটি অনলাইনে ‘আক্রমণাত্মক বা ভীতিকর’ বলে কিছু পোস্ট করা যেকোনো ব্যক্তিকে কারাগারে পাঠাতে কর্তৃপক্ষকে সহজ সুযোগ করে দেয়। ২০১৮ সালে বিখ্যাত ফটোগ্রাফার এবং লেখক শহিদুল আলমকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের আওতায় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং কারাগারে নির্যাতন করা হয়েছিল। ১০৭ দিন কারা হেফাজতে থাকার পর তাকে জামিনে মুক্তি দেয়া হয়েছে। গুমের ঘটনাও চলছে। ফটোসাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল ২০২০ সালে ৫৩ দিনের জন্য নিখোঁজ হয়েছিলেন এবং এখনো তিনি অভিযুক্ত। লেখক মুশতাক আহমেদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্টের কারণে গ্রেপ্তার হন, ছয়বার তার জামিন প্রত্যাখ্যাত হয়। কি ঘটেছিল সে ব্যাখ্যা পাবার আগেই তিনি কারা হেফাজতে মারা যান। প্রখ্যাত কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। সম্প্রতি জামিনে মুক্তি পেয়ে তিনি অভিযোগ করেছেন তাকে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়েছিল।

হংকংভিত্তিক এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন এর মতে, বাংলাদেশ সরকার প্রধানমন্ত্রী, তার পরিবার, সরকারি দুর্নীতি এবং আরো অনেকের সমালোচনা করার জন্য ২০২০ সালে কমপক্ষে ১৩৮ জনকে আটক করা হয়েছে। সমালোচনা করা সম্পাদকরা রাষ্ট্রদ্রোহিতা এবং মানহানির অভিযোগে অন্তর্বর্তী মামলা মোকদ্দমার সম্মুখীন হতে পারেন। বাংলাদেশি গণমাধ্যম এ বছর আল জাজিরায় সম্প্রচারিত একটি বিতর্কিত ডকুমেন্টারি প্রচার না করার এটাও একটা কারণ হতে পারে। ওই ডকুমেন্টারিতে অভিযোগ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশি সেনাবাহিনীর প্রধান আজিজ আহমেদ যিনি হাসিনার ঘনিষ্ঠ, বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িত। তথ্যচিত্রটি নিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ তার সামাজিক অগ্রগতি এবং অর্থনৈতিক পারফরম্যান্সের জন্য আন্তর্জাতিক অনুমোদন চায়। কিছু কৃতিত্ব সরকারের প্রাপ্য, তৃণমূল সংগঠনগুলোর আরো বেশি প্রাপ্য। তবে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সম্পর্কিত দেশটির রেকর্ডে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় অবনতি হয়েছে এবং এর কর্তৃত্ববাদী মোড় শেষ পর্যন্ত দেশটির উন্নয়নের ক্ষেত্রে হুমকিস্বরূপ হতে পারে। বাংলাদেশ এই স্বীকৃতি দিলে ভালো করবে যে রাজনৈতিক দমন অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথ সুগম করবে না কিংবা বৃহত্তর নাগরিক অধিকার অর্থনৈতিক বিকাশের পথে বাধা সৃষ্টি করবে না, যেমনটি ভারতীয় নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন দেখিয়েছেন। যারা অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে তাদের সমাজকে দমন করেন। তারা সোভিয়েত, চাইনিজ বা সিঙ্গাপুরীয় যে-ই হোন না কেন, এমনটি করেন কারণ তারা ক্ষমতার জন্যই এসব করেন, অন্য কিছুর জন্য নয়।

ঢাকার রায়েরবাজারে একটি স্মৃতিসৌধ রয়েছে যা একাত্তরের ডিসেম্বরে সেসব শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে নির্মিত যাদের ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে পরাজিত পাকিস্তানি বাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করেছিল, যারা নতুন জাতি গঠনে ভূমিকা রাখতে পারতেন। স্মৃতিসৌধটিতে বাংলাদেশি লেখক আসাদ চৌধুরীর একটি কবিতা রয়েছে যাতে নিহতদের উদ্দেশ্যে একটি প্রশ্ন করা হয়েছে: ‘তোমাদের যা বলার ছিল
বলছে কি তা বাংলাদেশ?’ ৫০ বছর পর প্রতিক্রিয়াটি মিশ্র। একাত্তরে যারা মারা গিয়েছিলেন তাদের একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, গণতান্ত্রিক জাতির স্বপ্ন ছিল যেখানে দরিদ্রদের জীবন উন্নতি হবে এবং মানবাধিকারকে সম্মান জানানো হবে। সেই স্বপ্নগুলো বাস্তবে রূপ দিতে হলে বাংলাদেশকে আরো অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে, চৌধুরীর কবিতাটি সে কথাই মনে করিয়ে দেয়।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status