প্রথম পাতা

রপ্তানি নিয়ে আবারো শঙ্কা

এম এম মাসুদ

১১ এপ্রিল ২০২১, রবিবার, ৯:৪৮ অপরাহ্ন

মহামারি করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলা করে দেশের রপ্তানি খাত এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এর মধ্যে আবারো শুরু হয়েছে লকডাউন। করোনা সংক্রমণ রোধে ১৪ই এপ্রিল থেকে এক সপ্তাহের কঠোর লকডাউনের প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। ফলে রপ্তানি নিয়ে আবারো চরম শঙ্কার মধ্যে পড়ছে দেশের রপ্তানিমুখী শিল্প।

উল্লেখ্য, মাঝে রপ্তানি আয়ে ঘাটতি কিছুটা কমা শুরু করলেও গত ২ মাস ধরে আবার বাড়তে শুরু করেছে। ফলে চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত ৯ মাসে রপ্তানি আয়ে আবার ধাক্কা লেগেছে। এর মধ্যে ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোতে করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের সংক্রমণে লকডাউনের সীমা বাড়ানো হয়েছে। দেশেও দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে চলাচলে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এতে আগামীতে রপ্তানি খাতে আবারো বড় ধাক্কা লাগতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন উদ্যোক্তারা। এ ছাড়া তৈরি পোশাকের কার্যাদেশ বাতিলের আশঙ্কা করছেন তারা।

জানা গেছে, ২০২০ সালের শুরুতে চীন থেকে সারা বিশ্বে করোনার মহামারি ছড়িয়ে পড়ার পর মার্চ মাসে সেটা বাংলাদেশের রপ্তানি খাতেও আঘাত হানে। ওই সময় একের পর এক ক্রয়াদেশ বাতিল; নতুন ক্রয়াদেশ বন্ধসহ নানা সমস্যার সস্মুখীন হয়েছিল বাংলাদেশ। এমনকি রপ্তানির জন্য প্রস্তুত পণ্যগুলোও জাহাজিকরণ স্থগিত করেছিল বিদেশি ক্রেতারা। এক বছর পর আবারো বাড়তে শুরু করেছে মহামারির বিস্তার ও মৃত্যুহার। এতে শঙ্কা আরো বাড়ছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে জুলাই থেকে মার্চ এই ৯ মাসে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ও প্রবৃদ্ধি কোনোটাই অর্জন হয়নি। বরং ঘাটতির মাত্রা আরো বেড়ে যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৩ হাজার ২৭ কোটি ৯০ লাখ ডলার। এর বিপরীতে আয় হয়েছে ২ হাজার ৮৯৩ কোটি ৮৩ লাখ ডলার। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আয় কমেছে ১৩৪ কোটি ৭ লাখ ডলার বা ৪.৪৩ শতাংশ। এ ছাড়া গত অর্থবছরের একই সময় রপ্তানি আয় হয়েছিল ২ হাজার ৮৯৭ কোটি ৩৮ লাখ ডলার। সে ক্ষেত্রেও গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধি কমেছে ০.১২ শতাংশ। এদিকে একক মাস হিসাবে মার্চেও রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। এ মাসে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৪৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার। আয় হয়েছে ৩০৭ কোটি ৬০ ডলার। সেক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আয় কম হয়েছে ১০.৭৯ শতাংশ। গত ফেব্রুয়ারিতেও লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আয় কম হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে আয় হয়েছিল ৩১৯ কোটি ডলার। এক মাসে আয় কমেছে ১১ কোটি ৪০ লাখ ডলার।

জানা গেছে, গত বছর করোনার প্রভাবে বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়েছিল। এর প্রভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তখন বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকের প্রায় ৩৫০ কোটি ডলারের কার্যাদেশ বাতিল হয়ে যায়। এ ছাড়া অন্যান্য রপ্তানি খাতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এমনকি তৈরি পণ্যও বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব হয়নি। এসব কারণে তখন রপ্তানি আয় ভয়াবহভাবে কমেছে। গত বছরের এপ্রিলে রপ্তানি আয় কমেছিল ৮৫ শতাংশ। গত অর্থবছরে রপ্তানি আয়ে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ঘাটতি হয়েছে প্রায় ২৬ শতাংশ। এর আগের অর্থাৎ ২০১৮-১৯ অর্থবছরের তুলনায় বিদায়ী অর্থবছরে রপ্তানি আয় কম হয়েছে প্রায় ১৭ শতাংশ। তখন রপ্তানি আয়ে এত বড় পতন এর আগে দেখা যায়নি।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের মধ্যে তৈরি পোশাকের অবদান প্রায় ৮৪ শতাংশ। রপ্তানি আয় তৈরি পোশাক শিল্প খাত নির্ভর বলে এ খাতে আয় সামান্য কমে গেলেই পুরো খাতেই নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
বিজিএমইএ রপ্তানি তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি আয় কমেছে তৈরি পোশাক খাতে। এ সময় তৈরি পোশাক খাতে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৪৯৫ কোটি ৬ লাখ ডলার। আয় হয়েছে ২ হাজার ৩৪৮ কোটি ৭৯ লাখ ডলার। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আয় প্রায় ৬ শতাংশ কমেছে। এ ছাড়া ২০১৯-২০ অর্থবছরে একই সময় আয় হয়েছিল ২ হাজার ৪১০ কোটি ৩৭ লাখ ডলার। সেক্ষেত্রে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি কম হয়েছে ২.৫৫ শতাংশ। এর মধ্যে নয় মাসে এক হাজার ২৬৫ কোটি ডলারের নিটপণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময় ছিল এক হাজার ১৯৫ কোটি ডলার। এক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫.৮৫ শতাংশ। একই সময়ে ওভেন পণ্য রপ্তানি হয়েছে ১০৮৩ কোটি ডলারের, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১০.৮৩ শতাংশ কম।

উদ্যোক্তারা জানান, দেশের রপ্তানি খাতে আরো একটি ধাক্কা আসন্ন। এ নিয়ে শঙ্কিত তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকরা। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, জাপান, ইতালি, কানাডা, স্পেনে লকডাউন চলছে। যে কারণে রপ্তানি কমেছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পোশাক শিল্পের ওপর।

বিকেএমইএ সূত্র জানায়, করোনার প্রথম ও দ্বিতীয় ধাক্কায় কিছু আদেশ স্থগিত হয়েছিল। কিন্তু পরে ক্রেতারা সেগুলো পুনরায় দেন। গত সেপ্টেম্বরের পর পরিস্থিতি আবারো খারাপ হয়ে যায়। করোনার প্রভাবে বিক্রি না হওয়ায় ক্রেতাদের কাছে আগের পণ্য মজুত রয়ে গেছে। এ অবস্থায় আগামীতে রপ্তানি আদেশ আরো  আশঙ্কাজনক হারে কমে যেতে পারে।

ইপিবির প্রতিবেদন বলছে, তৈরি পোশাক ছাড়াও অন্য খাতগুলোতেও রপ্তানি আয় কমেছে। হিমায়িত খাদ্য খাতে চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪২ কোটি ৩৯ লাখ ডলার। আয় হয়েছে ৩৬ কোটি ৭৭ লাখ ডলার। আয় কমেছে ১৩.২৫ শতাংশ। এ ছাড়া গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধি কমেছে ৮.৬৬ শতাংশ।
কৃষিপণ্য রপ্তানিতে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৭৯ কোটি ২ লাখ ডলার। আয় হয়েছে ৭৪ কোটি ৬৭ লাখ ডলার। কমেছে ৫.৫ শতাংশ।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সহসভাপতি ও বাংলাদেশ এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, করোনার প্রভাবে গত বছর রপ্তানি আয়ে ধস নেমেছিল। তা আমরা কাটিয়ে ওঠার দিকে যাচ্ছিলাম। এখন দেশসহ বিশ্বজুড়ে করোনা পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাওয়ার কারণে রপ্তানি আয়ে আবারো শঙ্কা দেখা দেবে বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, লকডাউনের কারণে বহুবিদ সমস্যা দেখা দিতে পারে। রপ্তানি আদেশ বাতিল হতে পারে। সেই চাপ উদ্যোক্তাদের সামলানো কঠিন হবে। এ ছাড়া আগামী ঈদে শ্রমিকদের বেতন-বোনাস নিয়ে সমস্যা দেখা দিতে পারে। পাশাপাশি শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে পোশাক শিল্পকে লকডাউনের বাইরে রাখতে হবে। কারণ, এ শিল্পে করোনা সংক্রমণের হার খুব কম।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status