বই থেকে নেয়া

মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৮)

‘তারা আমাকে বেশ কিছু বিকল্প লোভনীয় প্রস্তাব দিলো’

স্টাফ রিপোর্টার

৯ এপ্রিল ২০২১, শুক্রবার, ১০:৩২ পূর্বাহ্ন

এরপর দু’দিন কেবলমাত্র হয়রানি এবং নির্যাতন ছাড়া নতুন করে কোনোরকম জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো না। তাদের একই রকমের প্রশ্ন, একই ধরনের হুমকি, অপদস্থ করা ও নির্যাতনমূলক আচরণ অব্যাহত রইলো পুরোপুরিভাবে। ১৬ই এপ্রিল মধ্যরাতে আবার হাজির হলো সেই পলিটিক্যাল টিম। তারা আমাকে এবার অনেক তোষামোদ করে বেশ কিছু বিকল্প লোভনীয় প্রস্তাবও দিলো। কিন্তু আমি ছিলাম একেবারে অনমনীয়। আমি যখন স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলাম যে, কোনোদিন আর কোনো সেনা শাসনকে সমর্থন জানাবো না, তারা আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেল। আমার নির্ঘুম রাতের পালা চলতে লাগলো একই রকমে। ক্ষুধার পরিমাণ ক্রমশ কমে এলো ন্যূনতম পর্যায়ে। যতটুকু দূষিত পানি আমাকে সরবরাহ করা হলো তা ছিল কোনোরকমে কেবল ওষুধ গলাধকরণ করার জন্য যথেষ্ট। প্রতিদিন আমার নিত্যসহচর হয়ে রইলো ইঁদুর, পিঁপড়া আর তেলাপোকার ঝাঁক। আমার অব্যাহত চিন্তার ব্যাঘাত ঘটিয়ে মাঝে মাঝে ভেসে আসছিল টিকটিকির সুতীক্ষ্ণ টিক টিক আওয়াজ- যেন পর্দার অন্তরাল থেকে তারা আগামী দিনগুলোর জন্য সতর্ক সংকেত অনবরত দিয়ে যাচ্ছিল।
১৭ই এপ্রিল সারা রাত একবিন্দু আমি ঘুমাতে পারিনি। মশার সঙ্গে যুদ্ধ করে কোনোরকমে রাত কেটে গেলেও মনে মনে আমার মধ্যে এই ভেবে আশার সঞ্চার হচ্ছিল যে, চারদিনের রিমান্ড শেষে আগামীকাল আবার আমাকে কোর্টে নিয়ে যাওয়া হবে। আমি এই ভেবে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছিলাম যে, প্রিজন ভ্যান থেকে কোর্টরুমে নেওয়ার জন্য চোখের বাঁধন খুলে ফেলার পর আবার আমি আমার সেই অতি পরিচিত লোকজন, সেই মুক্ত আকাশ-বাতাস, রিকশা-ভ্যানের শব্দ ও স্বাভাবিক জীবন চলাচলের দেখা পাবো। আমার চারপাশে ভিড় করে থাকবে বন্ধুবান্ধব, আইনবিদ ও অন্যান্য শুভাকাক্সক্ষীরা। আমার মনে হচ্ছিল, এ হবে আমার জন্য এক পুনর্জন্ম, দেহ ও আত্মার এক অবর্ণনীয় অনুভূতি যা কেবল অনুভবই করা যায়, প্রকাশ করা যায় না।
১৮ই এপ্রিল। বাদবাকি সকালে ঘুম থেকে জেগে ওঠার আগেই আমি আমার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়েছিলাম। ইন্তাজ মিয়া দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে আমি ছিলাম বাইরে বের হবার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত। ইন্তাজ মিয়া তখন তার হাতে একটুকরো বাসি রুটি ও ময়লাযুক্ত একগ্লাস পানি নিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। তার জানা ছিল যে, আমাকে ওষুধ খেতে হবে। রুটিতে একটা কামড় দিয়ে আমি তাড়াতাড়ি ওষুধগুলো খেয়ে নিলাম এবং হাত চেপে ধরে তাকে বিদায় জানালাম। সে পা ছুঁয়ে আমাকে সালাম করলো, তবে কালো কাপড় দিয়ে আমার চোখ বেঁধে দিতে ভুললো না। তারপর সরু সিঁড়িপথ বেয়ে উপরে উঠে এলাম আমরা দু’জনে। ইন্তাজ মিয়ার সঙ্গে সেটাই ছিল আমার শেষ দেখা।
আমাকে নিচতলায় না রেখে উপরে কেন নিয়ে আসা হলো, এ ভেবে যখন আমার কাছে আশ্চর্য লাগছিল, সে মুহূর্তে আমার চোখ থেকে কালো কাপড় খুলে ফেলা হলো। আমাকে বসানো হলো একটা টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারে। আমার সামনে দাঁড়ানো ছিল একজন ক্যামেরাম্যান, হাতে মুভি ক্যামেরা তাক করা ঠিক আমার বরাবর। আমাকে বলা হলো, আমি যেন টেবিলের উপর রাখা টাইপ করা কাগজটা হাতে নিয়ে ক্যামেরার দিকে এমন ভঙ্গিতে তাকাই যেন মনে হয় আমি দর্শক-শ্রোতাদের উদ্দেশে কথা বলছি। আমি বললাম, এই কাগজে কী লেখা আছে। তা আগে আমি পড়ে নিতে চাই।
কিন্তু কাগজের লেখা পড়ার পর আমি যেন এক প্রচণ্ড আঘাত পেলাম। তারা আমাকে আমার সব দোষ স্বীকার করে নিয়ে আমি যে অপরাধ করেছি তার সব বর্ণনা দিয়ে স্বেচ্ছামূলকভাবে এমনভাবে একটা ভিডিও রেকর্ড করার প্রস্তাব দিচ্ছে যাতে মনে হবে অন্তরীণ থাকাকালে আমার সঙ্গে অত্যন্ত ভালো ব্যবহার করা হয়েছে এবং আমি স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে সবকিছু স্বীকার করে নিয়ে আমার বিবৃতি ভিডিওতে রেকর্ড করতে দিয়েছি। আমার মতো আইনজীবীর কাছে এ ধরনের শুধু বিবৃতি দেওয়া নয়, প্রমাণস্বরূপ তা রেকর্ড করতে দেওয়ার এ প্রস্তাবটি ছিল রীতিমতো অবাস্তব ও হাস্যকর।
ওদের প্রস্তাব আমি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে আবার আমার চোখ দু’টো বেঁধে ফেলা হলো। আবার উদয় হলো ঔদ্ধত অফিসারগুলো। অত্যন্ত রাগের সঙ্গে হুমকি দিয়ে তাদের একজন বললো, আমি যদি তাদের কথামতো কাজ না করি তাহলে আবার আমাকে রিমান্ডে এনে পুরনো সেই বন্দিঘরে রাখা হবে এবং তখন আমাকে বোঝানো হবে কাকে বলে শারীরিক অত্যাচার। ওরা সরাসরি আমাকে জানিয়ে দিলো যে, যতজনকে এখানে ধরে আনা হয়েছে তাদের সবাইকে ক্যামেরার সামনে বসে কাগজ পড়তে ও কাগজে সই দিতে বাধ্য করা হয়েছে। আমি যদি তাদের কথা না শুনি তাহলে আমাকে নিয়ে যা করার কথা বলা হয়েছে বাস্তবে তাই করা হবে ।
আমার স্নায়ুতন্ত্রীতে তখন ছড়িয়ে পড়েছে প্রচণ্ড আতঙ্ক ও বিস্ময়। নিজেকে বোধ হচ্ছিল পুরোপুরিভাবে অসহায় ও আত্মসমর্পিত। অন্ধকার পুঁতিগন্ধময় ঘরে ফেরা ও নির্যাতনের আতঙ্কে আমি শিউরে উঠছিলাম। দুই ঘণ্টার মধ্যে আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়া হবে কোর্টে। সেখানে আবার আমাকে রিমান্ডে নিয়ে যাওয়ার জন্য আবেদন করা হলে বিচারক বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে সেই রিমান্ড মঞ্জুর করবেন এবং আবার আমাকে ফিরিয়ে আনা হবে সেই নারকীয় অন্ধকূপে।
ভেতরে ভেতরে ক্রোধে-যন্ত্রণায় টুকরো টুকরো হয়ে গেলেও আমি ওদের প্রস্তাবে সায় দিলাম না এবং আমাকে দ্বিতীয়বার জোর না করার অনুরোধ জানালাম। তারা হুমকি অব্যাহত রাখলে আমি বললাম যে, আমি বিবৃতিতে সম্মত আছি, তবে সে বিবৃতি হতে হবে আমার নিজস্ব ইচ্ছা অনুযায়ী। তারা তখন দ্বিতীয় একটা বিবৃতির খসড়া নিয়ে এলো আমার কাছে। চোখের বাঁধন খোলা হলে সেটা পড়ে আবার আমি ক্যামেরায় তা রেকর্ডবন্দি ও তাতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানালাম। তৃতীয়বার খসড়া তৈরি করার পর আমার কাছে মনে হলো যে, এতে ঝুঁকির মাত্রা ততটা প্রবল নয়। এরপর ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আমি বিবৃতিটি রেকর্ড করতে দিলাম ও তাতে সই করলাম। আমি জানতাম যে, বিচারিক কোনো ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে নেওয়া হয়নি বলে এ ধরনের বিবৃতির প্রামাণিক মূল্য যৎসামান্য। কিন্তু রিমান্ড ও তৎপরবর্তী নির্যাতনের ভয়াবহতা আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখায় শেষ পর্যন্ত আমি তাতে রাজি হলাম। কারণ আমার কাছে এর আর অন্য কোনো বিকল্প ছিল না।
প্রিজন ভ্যান থেকে বের হওয়ার পর উপস্থিত শত শত লোকের তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে কড়া পুলিশ প্রহরারত অবস্থায় আমাকে ও আমাকে ঘিরে রাখতে আগ্রহী আইনজীবী ও দর্শকদের উচ্ছ্বাসধ্বনির মধ্য দিয়ে আদালত অভিমুখে নিয়ে যাওয়া হলো। একজন আইনজীবী জানালেন যে, গত চারদিন ধরে জাতীয় পত্রিকাগুলোতে অনবরতভাবে আমার সমস্ত কীর্তিকাহিনী ছাপা হচ্ছে ও বলা হচ্ছে যে, আমি যৌথবাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদের সময় সেগুলো সম্পর্কে স্বীকারোক্তি দিয়েছি। আমাকে যে সব প্রতিবেদন দেখানো হলো সেগুলোর সবক’টিই ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা। এভাবেই সামরিকরা জনসাধারণের চোখে রাজনীতিবিদদের হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য এ রকমের উদ্যোগ নিয়ে থাকে। নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য রাজনীতিবিদদের চরিত্রহননে সামরিকদের এ এক অতি সাধারণ কৌশল। একজন কারাবন্দি হিসেবে এ ধরনের রিপোর্টের কোনো জবাব দেওয়া, কোনো প্রতিবাদ জানানো কিংবা নিন্দা করার কোনো উপায় আমার তখন ছিল না। এ ছিল রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে যৌথবাহিনীর এক ধরনের একতরফা প্রপাগান্ডা, যার মাধ্যমে সেনাপ্রধান তার শাসনের যৌক্তিকতা প্রদর্শনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তবে বাদীপক্ষ আর যাইহোক, আমাকে আরেকবারের জন্য রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন জানায়নি। ফলে আদালত আমাকে জেলে পাঠাবার নির্দেশ দেয়। তাতে আমি আপাতভাবে এক নতুন মুক্তির আনন্দ অনুভব করি ।
পাঁচদিনের এই ভয়ঙ্কর সময়ে আমি এটাও বুঝতে পেরেছিলাম যে, রাজনীতিবিদদের ওপর এই অত্যাচার, নির্যাতন এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলাকে ধ্বংস করে ক্ষমতা দখল করার এই প্রক্রিয়ায় সমগ্র সেনাবাহিনী জড়িত ছিল না। শুধুমাত্র সেনাপ্রধান ও তার দোসর কয়েকজন জেনারেল এবং তাদের অধীনস্ত অল্পসংখ্যক অফিসার এর সঙ্গে জড়িত ছিল এবং নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করার জন্য তারা সেনাবাহিনীর নাম ব্যবহার করে দেশে এবং বিদেশে এই জাতীয় প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তিই শুধু নষ্ট করে চলেছে।

(চলবে...)

আরো পড়ুন-
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৪)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৫)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৬)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৭)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৮)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৯) 
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১০)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১১)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১২)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৩)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৪)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৫)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৬)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৭)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status