বই থেকে নেয়া

মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৭)

'সেই বিকালের দেখা আর কোনোদিনই মেলেনি'

স্টাফ রিপোর্টার

৮ এপ্রিল ২০২১, বৃহস্পতিবার, ১১:২৩ পূর্বাহ্ন

জরুরি অবস্থা ঘোষণার অব্যবহিত পরে রাজনীতিবিদদের গণগ্রেপ্তারের পর পরিস্থিতি অনেকটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, সরকার দ্রুত নির্বাচনের জন্য কোনো পদক্ষেপ নেবে না, বরং সেনাবাহিনী প্রধান তার অভিলাষ পূরণ করার লক্ষ্যে নিজের ক্ষমতা সুসংহত করার সবরকম পদক্ষেপ নেবেন। আসলে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল এই সেনাবাহিনী প্রধানেরই উদ্যোগে। আমি তখন হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটির দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের অধীনে গবেষণার কাজে জার্মানি যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। বাংলাদেশেস্থ জার্মান রাষ্ট্রদূত ফ্রাংক মাইয়েকের সহযোগিতায় বার্লিনে আমার পরিচিত সেই প্রখ্যাত ফাউন্ডেশন ফ্রেডারিক ইবার্টি স্টিফটুং তাৎক্ষণিকভাবে সাড়া দিয়ে আমাকে একটি ফেলোশিপ গ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানায় এবং আমার গতবারের জেলখানায় থাকাকালীন শুরু করা বইটি শেষ করার জন্য সবরকমের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করে। এর আগে ১৯৭৬, ১৯৮০ এবং ১৯৯৬ সালে তিনটি পর্যায়ে আমার তিনটি বই লেখার জন্য তারা ফেলোশিপসহ একই রকমের সুযোগ-সুবিধা আমাকে দিয়েছিল।
দুইপক্ষের তরফ থেকে এ নিয়ে আনুষ্ঠানিকতা সারতে প্রায় দুই মাস সময় লেগে যায়। ইতিমধ্যে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি লক্ষ্য করে আমি ইউনিভার্সিটিতে যোগ দেওয়ার দিনক্ষণ চূড়ান্ত করার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থাকাকালীন অবস্থা থেকে পরিচিত প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দীন আহমেদের কাছে ফোনে জিজ্ঞেস করি আমার দেশের বাইরে যাওয়ার ব্যাপারে কোনোরকম নিষেধাজ্ঞা আছে কি না। আমি জার্মানিতে একটা ফেলোশিপে যাচ্ছি শুনে তিনি বরং খুব খুশি হলেন। তিনি জানালেন যে, আমার দেশের বাইরে যাওয়ার ব্যাপারে কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা নেই। যথারীতি তিনি আমার যাত্রার জন্য শুভ কামনাও করলেন। আমি তাকে ফোন করার পর স্বরাষ্ট্র সচিব জনাব আব্দুল করিমও আমার কাছে ফোন করে প্রধান উপদেষ্টার দেওয়া নিশ্চয়তাকে আরেকবার কনফার্ম করলেন। এতে নিশ্চিন্ত হয়ে আমি ফাউন্ডেশন, ইনস্টিটিউট, অধ্যাপকবর্গ এবং হাইডেলবার্গের অন্যদের কাছে আমার যাত্রার দিন-তারিখ চূড়ান্ত করে বার্তা পাঠালাম।
যাত্রার ১০ দিন আগে আমি জার্মান রাষ্ট্রদূতকে আমাদের বাসায় একটি সৌজন্যমূলক ডিনারের দাওয়াত দেই এবং বিদায়ের প্রাক্কালে তিনি আমার যাত্রার জন্য শুভকামনা জানান। পরদিন আমি আবার ফখরুদ্দীনকে ফোন করে আবারও আমার যাত্রার চূড়ান্ত দিনক্ষণ সম্পর্কে তাকে জানাই। তিনিও অত্যন্ত সন্তুষ্টচিত্তে আমার নিরাপত্তা নিশ্চিত করে শুভযাত্রা কামনা করেন। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হওয়া সত্ত্বেও ফখরুদ্দীন নিজেই তার ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন না। তার সঙ্গে আলাপের ঘণ্টাখানেক পর স্বরাষ্ট্র সচিব আবদুল করিম আমাকে ফোন করে বলেন যে, প্রধান উপদেষ্টা আমাকে পরামর্শ দিয়েছেন আমি যেন আপনার দেশ ত্যাগের ব্যাপারে ফিল্ড ইন্টেলিজেন্সের ডাইরেক্টর জেনারেলকে জিজ্ঞেস করি। আমি সাথে সাথে ডাইরেক্টর জেনারেলের সঙ্গে যোগাযোগ করলে অত্যন্ত ভদ্রতার সঙ্গে তিনি আমাকে জানান যে, আমি যেন সেদিন বিকালেই তাকে আবার ফোন করি। কিন্তু সেই বিকালের দেখা আর কোনোদিনই মেলেনি। জেনারেল আমার ফোন আর একবারের জন্যও রিসিভ করেননি। আমি আমার আশঙ্কার কথা না জানিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য হাসনাকে পরামর্শ দিলাম। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে, আমার নির্ধারিত যাওয়ার এক সপ্তাহ আগে হাসনা লন্ডনে চলে যায়। হাসনা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি কতিপয় অপরিহার্য কারণ দেখিয়ে আমার যাত্রার পরিকল্পনা বাতিল করে দেই এবং আনুষ্ঠানিকভাবে ওদের রাষ্ট্রদূতসহ জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে অবহিত করি। এক সপ্তাহ পরে দেশের সব কাগজে বিশাল হেডলাইনে আমার গ্রেপ্তারের খবর প্রচারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে তারা আমার কতিপয় অপরিহার্য কারণের মূল রহস্য সহজে আবিষ্কার করতে পারলেন। আমাকে যেদিন আমার বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। সেদিন হাসনা সেখানে থাকলে আজ পর্যন্ত তাকে বোধহয় জেলের ভেতরেই বাস করতে হতো।
“আপনার স্ত্রী এখন কোথায়?”
“তিনি লন্ডনে।”
“কী করছেন উনি সেখানে? কত টাকার মালিক উনি?”
“আমার যা আছে তাই।” সোজা জবাব দিলাম। “তার নিজস্ব কোনো রোজগার নেই।”
“কিন্তু উনি দু’টি এনজিও চালাচ্ছেন। বিদেশি দাতাদের কাছ থেকে প্রচুর টাকা পাচ্ছেন। ওনার নিজস্ব ব্যবসাও আছে। এই টাকা উনি জমা রাখছেন কোথায়?” প্রত্যেকবার প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে অফিসারদের একজনের গলার স্বর অন্যজনের চাইতে ক্রমশ চড়া হয়ে চলছিল। আমি বললাম, “উনার এনজিওগুলো নিতান্তই স্বেচ্ছাসেবী ধরনের এবং মূলত আমি নিজেই সেগুলোর অর্থায়ন করি। কোনো বিদেশি দাতারা সেগুলোর জন্য সাহায্য করে না এবং তার কোনো ধরনের ব্যবসাও নেই।” তখন ওরা অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল। “আপনার মাধ্যমে লোকজনের চাকরি দিয়ে এবং লোকজনকে বিভিন্ন জায়গায় বদলি করিয়ে উনি প্রচুর টাকা কামিয়েছেন।” আমি দৃঢ়স্বরে জানালাম, আমার টাকা-পয়সা ছাড়া আমার স্ত্রীর নিজস্ব কোনো টাকা-পয়সা নেই এবং তিনি একদিনও এ ধরনের কোনো কাজ করেননি। কিন্তু আমি অনুভব করতে পারলাম যে, আমার জবাব তাদের খুশি করতে পারেনি। একপর্যায়ে একজন অফিসার রুক্ষস্বরে হাসনাকে দোষারোপ করে বললেন যে, বিদেশে ওনার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও সম্পত্তি রয়েছে এবং খুব ঘন ঘন উনি দেশের বাইরে যান।
আমি বললাম, হ্যাঁ তিনি অনেক বাইরে যান, আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলোতে যাওয়ার জন্য সম্মেলনের পক্ষ থেকে সবরকম ব্যয়ভার বহন করা হয়। কোনো কোনো বছরে তিন থেকে চারবার পর্যন্ত তিনি বিদেশ গেছেন এবং সাধারণত বিশ্বের বড় বড় শহরগুলোতে। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে, কারণ এসব আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদানকারীদের সবরকমের পারিতোষিক পাওয়া চেক প্রথমে সেখানকার ব্যাংকেই জমা হয়। ওয়াশিংটন ডিসিতে তার নিজের নামে কেনা আমাদের একটা ছোট ফ্ল্যাট রয়েছে। আমার হাইডেলবার্গ, অক্সফোর্ড, হার্ভার্ড ফেলোশিপ এবং জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির ইলিয়ট স্কুলে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে পাওয়া টাকায় ফ্ল্যাটটি কেনা হয়েছে। কিন্তু আমার এসব জবাবে তাদের কাউকে সন্তুষ্ট বলে মনে হলো না। একজন প্রায় ক্ষিপ্তভাবে জিজ্ঞেস করলো “উনি ফিরে আসছেন কবে?” আমি সাহস সঞ্চয় করে বললাম, “আপনারা যতদিন দেশ চালাচ্ছেন ততদিন তিনি ফিরবেন না।” জবাব এলো, “সেক্ষেত্রে বাকি জীবন আপনাকে আপনার স্ত্রীকে ছাড়াই কাটাতে হবে।” ওর কথার ভঙ্গিতে ওরা সবাই নাটকীয়ভাবে হেসে উঠলো। “ফিরে আসলে আমরা উনাকেও আটক করতে যাচ্ছি।” দৃঢস্বরে একজন বললো।
“কীভাবে? ওর অপরাধ কী?”
“কোনো কারণ ছাড়াই আমরা তা করতে পারি।” সাফ জবাব বের হয়ে এলো আর এক অফিসারের কণ্ঠ থেকে।

(চলবে..)

আরো পড়ুন-
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৪)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৫)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৬)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৭)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৮)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৯) 
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১০)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১১)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১২)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৩)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৪)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৫)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৬)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status