বই থেকে নেয়া

মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৬)

‘তাদের রাজনৈতিক পরিকল্পনা ছিল, সেনাপ্রধানকে প্রেসিডেন্ট করা’

স্টাফ রিপোর্টার

৭ এপ্রিল ২০২১, বুধবার, ১১:১১ পূর্বাহ্ন

আমি তাদের বুটের আওয়াজ শুনতে পেলাম। তারা যখন টেবিলে আমার মুখোমুখি বসলো, আমি চেয়ার টানার শব্দও পেলাম। কেবল জানলাম না তারা কারা, কতজন কিংবা তারা গতকালের সেই একই টিমের একই লোকজন কিনা। একবারের জন্যও তারা তাদের র‌্যাংক সম্পর্কে কিছু জানায়নি বা কারো নাম উচ্চারণ করেনি। কাজেই তারা কিছু না বলা পর্যন্ত আমার অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। ফলে আমি কেবল ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত হচ্ছিলাম আর রাগ ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছিল আমার সারা দেহে। বস্তুতই আমি ছিলাম অনেক ক্লান্ত।
শরীরে এনার্জির বিন্দুমাত্রও আর অবশিষ্ট ছিল না। এর পরেও আমি নিজেকে যতটা সম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করলাম। কারণ, আমি জানতাম যে, ওদের সাথে তর্ক করতে গেলে আমাকে অপমান করা হবে। এমনকি মারধরও করা হতে পারে। আমি এখন তাদের পরিকল্পনা সম্পর্কে জেনে গেছি। তাদের রাজনৈতিক পরিকল্পনা হলো, সেনাবাহিনী প্রধানকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিষিক্ত করা, যা আগের রাতের টিমের সদস্যরা আমাকে জানিয়ে গেছে। এখন এই অফিসাররা আবার কী জন্য আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে যাচ্ছে তা আমার বোধগম্য হচ্ছিল না। আমি জানতাম যে, আমাকে সাধারণ কোনো পুলিশ রিমান্ডে আনা হয়নি- আনা হয়েছে টর্চার রিমান্ডে। কাজেই আমার সাথে কী রকম আচরণ করা হতে পারে সে ব্যাপারে আমার অন্য কোনো সন্দেহ ছিল না।
“তাহলে এ নিয়ে আপনি কোনো চিন্তা করেছেন?” “কিসের চিন্তা?” “আপনার লুকানো টাকা পয়সা কোথায় রেখেছেন তার কথা। এ ব্যাপারে কাল আপনাকে সময় দিয়েছিলাম।” গতরাতে তরুণ যে অফিসারটি আমাকে পিটুনী দেওয়ার ব্যাপারে হুমকি দিচ্ছিল, তার গলার আওয়াজ থেকে স্পষ্টভাবে আমি তাকে শনাক্ত করতে পারছিলাম। আজ গলার আওয়াজ থেকে তাকে আরো বেশি অধৈর্য বলে মনে হচ্ছিল। তার সিনিয়র অফিসাররা গতরাতে আমার সাথে কী রকম ভদ্র আচরণ করেছে সে ব্যাপারে বোধহয় বিন্দুমাত্রও সে জানতে পারেনি।
“আমার লুকানো কোনো টাকা নেই। আমি চোরাচালানি কিংবা মজুতদারি করি না। আমি একজন পেশাদার আইনজীবী এবং কেবলমাত্র আইন ব্যবসায় ছাড়া অন্য কোনো ব্যবসার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আর্থিকভাবে অন্য কোনো উৎসের বা সূত্রের সাথে আমি জড়িত নই।” আমি কথা শেষ করার আগেই আরেকজন বেয়াদব অফিসার উচ্চস্বরে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “আপনার সব ধনী ক্লায়েন্টদের খবর কী?”
“তাদের সম্পর্কে আপনারা কী জানতে চান?”
“তারা আপনার জন্য যেসব টাকা পয়সা সরিয়ে রেখেছে- সে সব আমরা জানতে চাই।”
“গত পাঁচ বছর মন্ত্রী থাকাকালে আমার কোনো ক্লায়েন্ট ছিল না কিংবা আমার কোনো আইন ব্যবসাও ছিল না। ইতিমধ্যে আমি বুঝে ফেলেছি যে, আসলে অফিসারদের হাতে আমাকে জিজ্ঞেস করার মতো তেমন কোনো তথ্য ছিল না। যৌথবাহিনীর কাছে আমার লুকানো টাকা সম্পর্কিত কোনো বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য ছিল না এবং তারা আসলে অন্ধকারেই ঘুরে বেড়াচ্ছিল। কাউকে কেবলমাত্র হয়রানি করে নিজেদের বিকৃত মনোবাসনা চরিতার্থ করতে গিয়েই আমার মতো একজনকে তারা খামোখা অপদস্থ করে চলেছে। আদালত পুলিশ রিমান্ড মঞ্জুর করেছে যাতে করে পুলিশ আমার বিরুদ্ধে আমার বাসায় মদের খোঁজ পাওয়া সম্পর্কিত বিষয়ে প্রশ্ন করতে পারে। কিন্তু আমাকে কোনো পুলিশের অধীনে পুলিশ স্টেশনে আনা হয়নি। সেনাবাহিনীর লোকজন চোখবাঁধা অবস্থায় আমাকে এমন সব প্রশ্ন জিজ্ঞাসাবাদ করছে যার সাথে আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই এবং আমাকে এমন এক জায়গায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে যেখানে পুলিশের কোনো কর্তৃত্ব নেই। আসলে জায়গাটা ছিল ডিফেন্স ফিল্ড ইন্টেলিজেন্সের একটা টর্চার সেন্টার।
খুব কাছেই আমি আরেকজনের আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছিলাম। আমি মনে মনে ভাবছিলাম, হয়তো আরেকজন রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী কিংবা সিভিল সার্ভেন্টকে মারধর করে এমন সব অভিযোগের উপর তাদের স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা চলছে যে সব অভিযোগের সাথে তাদের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। আমার সামনে বসা একজন আরেকজনের কাছে বলে চলছিল যে, আর্তনাদটি আসছিল একজন ব্যবসায়ীর গলা থেকে, ওরা জানতে চাইছিল তার কাছে কত টাকা আছে কত রকম ব্যবসায়ের সাথে সে জড়িত এবং ‘গরীবদের জন্য হাসপাতাল’ বানিয়ে দিতে সে কী পরিমাণ ক্যাশ টাকা সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দিতে রাজি আছে। “ইতিমধ্যে আমরা ৫০০ কোটি টাকার বেশি আদায় করেছি এবং ৫৫টি অত্যন্ত দামি গাড়ি এ উদ্দেশ্যে বাজেয়াপ্ত করেছি।” অন্য একজন বললো। “আসলে আমাদের চিফ চাচ্ছেন দুর্নীতিবাজ এসব রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের অবৈধ পথে রোজগার করা সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে।” অভিমত প্রকাশ করলো অপরজন। তার কণ্ঠস্বর ছিল আক্রমণাত্মক। এদের মধ্যে আরেকজনকে কিছুটা নরম বলে মনে হলো। নিচুস্বরে বললো, “আমি এসব ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।” সে বোধহয় আমি সামনে বসে আছি বলেই এ প্রসঙ্গে আর বেশিদূর এগোতে চাইলো না। একরকম হঠাৎ করেই তারা একসাথে উঠে দাঁড়ালো। একজন বললো, “এ নিয়ে পরে আপনার সাথে কথা বলবো।” কিন্তু সেদিন তারা আর আমার সাথে দেখা করতে ফিরে আসেনি।
আমাকে ফিরিয়ে নেওয়া হলো সেই আগের ঘরে, কবুতরের খাঁচার মতো সেই পুঁতিগন্ধময় বদ্ধঘরে ঢুকিয়ে আমার চোখের বাঁধন খুলে নেওয়া হলো। একাকী সেই বদ্ধঘরে আমি তখন ভীত বিপর্যস্ত এবং শারীরিকভাবে পুরোপুরি কাহিল। চারদিকে অসংখ্য পোকামাকড়ের ছড়াছড়ি। তাদেরকে এই মানব সঙ্গীর তুলনায় অনেক স্বাধীন, স্বচ্ছন্দ ও পরিতৃপ্ত বলে মনে হলো। ঘরের ভাঙা মেঝে ও দেয়ালের স্যাঁতসেঁতে ভাব দেখে আরেকবারের মতো শিউরে উঠলো আমার গোটা শরীর। আরো তিনদিন আমাকে এই অন্ধকূপে বাস করতে হবে- এটা ভেবেই আমি একরকম অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়লাম- এমনকি আমার দেহে প্রাণ আছে কি নেই সেটা আমি ঠিকমতো অনুভব করতে পারছিলাম না।
১৯৮২ সালের ১৪ই নভেম্বরের কথা। মাত্র এক সপ্তাহ আগে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবির্ভূত হয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া। আমারই উদ্যোগে রাজনীতিতে উৎসাহী হয়ে তিনি গিয়েছিলেন তাঁর প্রয়াত স্বামী জিয়াউর রহমানের মাজারে। এক সপ্তাহ পর এই দিনে জেনারেল এরশাদের সরকার জিয়ার মাজার প্রান্তরে খালেদা জিয়ার জন্য সমাবেশ সংগঠিত করা ও এরশাদবিরোধী স্লোগান তোলায় আমাকে গ্রেপ্তার করে ঠিক এরকম একটি বন্দিশালায় এনে রেখেছিল। এক রাতে সেখানে আমার উপর যে অত্যাচার ও নির্যাতন চালানো হয় তা ছিল আমার কাছে একটা দুঃস্বপ্নের মতো। কিন্তু এবারের নির্যাতনের তুলনায় তা ছিল নিতান্তই তুচ্ছ। অবশ্য সে সময় সেই নির্যাতিত হবার পেছনে একটা সুমহান রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল। কারণ আমি তখন সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে দেশকে গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সোচ্চার ছিলাম, যার ফলে কোনো নির্যাতন বা অত্যাচারকেই আমি পরোয়া করিনি। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এবার আমি বন্দি হয়েছি এমন সব বর্বর লোকজনের হাতে যারা দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিকে ধ্বংস করা ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে এগিয়ে আসেনি। এক কথায় এদের হাতে নির্যাতিত হওয়ার বিষয়টি ছিল আমার কাছে একেবারে অর্থহীন।
পরদিন ১৬ এপ্রিল সকালে আমাকে আবার সেই একই জায়গায় নিয়ে যাওয়া হলো এবং ওরা একই কায়দায় আবার আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলো। টুলের ওপর বসামাত্র শুরু হলো তাদের সেই যন্ত্রণাকর জিজ্ঞাসাবাদের পদ্ধতি। তবে এবার সরাসরি আক্রমণ চালানো হলো আমার স্ত্রী হাসনাকে লক্ষ্য করে। হাসনা হলেন একজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষিত মহিলা, ১৯৯২ সালে পরিবেশ বিষয়ক রিও বিশ্ব শীর্ষ সম্মেলনে গ্লোবাল ৫০০ পদকপ্রাপ্তা। সামরিক বাহিনীর সদস্যদের কাছে তার কোনো যোগ্যতা কিংবা কৃতিত্বের এক পয়সারও মূল্য ছিল না। হাসনা যে আমেরিকায় শিক্ষকতা করেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের পড়িয়েছে, পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের কন্যা, ১৯৭১ সালে জাতিসংঘে কর্মরত অবস্থায় মার্কিন সিনেটর এডোয়ার্ড কেনেডিকে নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে প্রচারণায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে, অক্সফোর্ডের একজন ফেলো, বেশ কয়েকটি পুস্তকের রচয়িতা, বিশিষ্ট একজন পরিবেশবিদ এবং জাতীয় সংসদের দুবার সরাসরিভাবে নির্বাচিত একজন সাবেক সদস্য- এসব নিয়ে এদের মধ্যে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা ছিল না কিংবা তারা এর কোনো পরোয়াও করেনি। এদের কাছে হাসনার পরিচয় ছিল তিনি আমার স্ত্রী, আমার মতোই একজন ‘দুর্নীতিবাজ’ এবং যে করেই হোক আমার সাথে তাকেও ধ্বংস করতে হবে। ইতিমধ্যে অনেক স্ত্রীকেই তারা স্বামীদের সঙ্গে অভিযুক্ত করে কারাগারে এনেছে। এ ছিল এক নতুন ধরনের অনাচার। এর আগে, এমনকি ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাহিনীকেও এ ধরনের অত্যাচারের উদাহরণ টানতে দেখা যায়নি। ভাগ্য খারাপ হলে হাসনাকে হয়তো আজকে অন্যান্য ‘দুর্নীতিবাজ’ রাজনীতিবিদদের স্ত্রীদের মতো অভিযুক্ত হয়ে চোর কিংবা বারবনিতাদের সঙ্গে সাধারণ কয়েদিদের সেলে অন্ধকার প্রকোষ্ঠের মেঝেতে ইটের বালিশে শুয়ে দিন কাটাতে হতো। আমার একবার মনে হয়েছিল, যদি সত্যিই এটা হতো যে, দুজনই ‘দুর্নীতিবাজ’ হিসেবে কারাবন্দি হয়েছি তাহলে এ পৃথিবীতে এভাবে বেঁচে থাকার চাইতে একসঙ্গে আত্মহত্যা করাই বরং শ্রেয়তর হতো। কিন্তু অত্যন্ত সৌভাগ্যক্রমে আমি গ্রেপ্তার হওয়ার এক সপ্তাহ আগে হাসনা চলে গিয়েছিল দেশের বাইরে- মহান আল্লাহ আমাদের দু’জনকেই রক্ষা করার জন্য তার কৃপাদৃষ্টি বর্ষণ করেছেন।

(চলবে..)

আরো পড়ুন-
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৪)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৫)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৬)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৭)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৮)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৯) 
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১০)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১১)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১২)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৩)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৪)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৫)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status