শেষের পাতা

হতাশা, বাড়ছে খুন-আত্মহত্যা

কাঁদছে যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ কমিউনিটি

কূটনৈতিক রিপোর্টার

৭ এপ্রিল ২০২১, বুধবার, ৯:৩৮ অপরাহ্ন

হতাশা থেকে খুন ও আত্মহত্যার ঘটনা বেড়ে চলায় উদ্বিগ্ন যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ কমিউনিটি। বিশেষ করে টিনেজারদের মধ্যে এই অসুস্থ প্রবণতা অভিভাবকদের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলছে। স্বপ্নের দেশে পাড়ি দিয়েও নানা কারণে হতাশায় নিমজ্জিত পরিবারগুলো এখন রীতিমতো কাঁদছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে তাদের সেই কান্নার আওয়াজ আসছে বাংলাদেশেও। অতি সম্প্রতি টেক্সাস এবং মিশিগানে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ৭ জনের মৃত্যুর ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে থাকা বাংলাদেশিদের মধ্যে উদ্বেগ ছড়িয়েছে। তারা নেট দুনিয়ায় এসব ঘটনা শেয়ার করছেন। সেখানে ভিন্নরকম মন্তব্য বা প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। ঘটনাগুলোকে মর্মান্তিক উল্লেখ করে বাংলাদেশ কমিউনিটি বলছে, সামাজিক ওই ব্যাধি রোধে পরিবারগুলোকে সচেতন হতে হবে। বৈশ্বিক চিন্তা, বিত্ত- বৈভবের নেশায় মত্ত না হয়ে পরিবারকে সময় দিতে হবে, বিশেষ করে উঠতি সদস্যদের মন বুঝতে হবে। মরদেহ উদ্ধারকারী পুলিশ সদস্যরাও তরুণদের মর্মস্পর্শী এহেন কাণ্ডে হতবাক। ঘটনাগুলোকে তারাও ‘মর্মান্তিক’ বলছেন। আর সমাজ বিজ্ঞান এবং মনোবিজ্ঞান বিষয়ে গবেষণা কর্মে নিয়োজিতরা বলছেন, অভিবাসী পরিবারগুলোর সন্তানদের এসব ঘটনা দীর্ঘ মেয়াদে অভিবাসনের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। গত রোববার যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের অ্যালেন শহরে বসবাসরত বাংলাদেশি একটি পরিবারের ছয় সদস্যের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। মা-বাবা, বোন ও নানিকে হত্যার পর ওই পরিবারের দুই সন্তান আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যার আগে পরিবারের সদস্যদের হত্যার বর্ণনা দিয়ে দুই ভাই ‘সুইসাইড নোট’ লিখে যায়। এক ভাই ইনস্টাগ্রামে সেই নোট প্রচারও করে। সেই সূত্রে পুলিশ নিশ্চিত যে, ভ্রাতৃদ্বয় চরম হতাশায় ভুগছিল। পরিবারকে লজ্জা ও কষ্ট থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য দুই ভাই সবাইকে হত্যা করে নিজেরা আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে বলে সুইসাইড নোটে উল্লেখ করে গেছে। রোববার লাশ উদ্ধারের পর ঘটনার নানা দিক অনুসন্ধানে পুলিশি তদন্ত অব্যাহত আছে। স্থানীয় সংবাদ মাধ্যম জানায়, রোববার রাত একটার দিকে নগরীর পাইন ব্লাফ ড্রাইভ এলাকার একটি বাড়ি কর্ডন করে পুলিশ। ওই পরিবারের এক বন্ধু ফোন করে পরিবারের কোনো সদস্যদের না পেয়ে ‘কিছু একটা ঘটেছে’ সন্দেহে পুলিশে খবর দেন। পুলিশ বাড়ির দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে ছয়জনের লাশ দেখতে পায়। বন্দুকের গুলিতে তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে নিশ্চিত হয় পুলিশ। ঘটনাস্থল থেকে ব্যবহৃত বন্দুকও উদ্ধার করা হয়। মারা যাওয়া ব্যক্তিরা হলেন- ১৯ বছর বয়সী যমজ ভাইবোন ফারহান তৌহিদ ও ফারবিন তৌহিদ, বড় ভাই তানভীর তৌহিদ (২১), মা আইরিন ইসলাম (৫৬), বাবা তৌহিদুল ইসলাম (৫৪), তানভীর তৌহিদের নানি আলতাফুন্নেসা (৭৭)। অ্যালেন পুলিশের বরাতে সংবাদ মাধ্যম জানায়, দুই ভাই চারজনকে হত্যার পর নিজেরা আত্মহত্যা করে বলে মনে হচ্ছে। মানসিক বিষণ্নতা থেকে মুক্তি পেতে তারা এই কাজ করেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা পাওয়া গেছে। পুলিশ বলছে, ঘটনার আগে ফারহান তৌহিদ ইনস্টাগ্রামে একটি দীর্ঘ ‘সুইসাইড নোট’ পোস্ট করে। এতে  সে লিখে, আমি নিজেকে এবং আমার পরিবারকে হত্যা করছি। ফারহান আরো লিখে কীভাবে সে নবম শ্রেণি থেকে মানসিক হতাশার বিরুদ্ধে লড়াই করছে। তার বড় ভাইও হতাশার সঙ্গে লড়াই করছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে ইনস্টাগ্রাম পোস্টে ফারহান লিখে- ভাই বলেছে, আমরা যদি এক বছরে সবকিছু ঠিক করতে না পারি, তবে আমরা নিজেদের ও পরিবারকে হত্যা করবো। নিজেরা আত্মহত্যা করলে পরিবার লজ্জায় পড়বে। তাই লজ্জা ও কষ্ট থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য অন্যদের হত্যা করে নিজেদের আত্মহত্যার কথা সুইসাইড নোটে উল্লেখ রয়েছে বলে পুলিশের বরাতে জানায় মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলো। সুইসাইড নোটে হত্যার পরিকল্পনার কথাও লেখা রয়েছে বলে জানানো হয়। মরদেহ উদ্ধারকারী অ্যালেন পুলিশের সার্জেন্ট জন ফেলটিকে বলেন, তিনি ২১ বছর ধরে শহরটিতে আছেন। এমন দুঃখজনক ঘটনার মুখোমুখি আগে কখনো হননি। পুরো ঘটনাকে মর্মান্তিক বলে উল্লেখ করেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, গত শনিবার কোনো এক সময় মর্মান্তিক এ ঘটনা ঘটে। পুলিশ এ ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু জানায়নি। মেডিকেল পরীক্ষা এবং সুরতহাল রিপোর্টের পর ঘটনার দিনক্ষণ সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যাবে। ওই পরিবারের পরিচিত দিলারা হাসান বলছিলেন, এমন কোনো ঘটনা এই পরিবারে ঘটতে পারে বলে তা তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। বাইরে থেকে পরিবারটিকে সুখী বলেই মনে হয়েছে তার। টেক্সাসে বসবাসরত অপর প্রবাসী মিজান রহমান বলেন, সব সময় হাসিখুশি থাকা পরিবারটিতে এমন ঘটনা ঘটতে পারে বলে তিনিও বিশ্বাস করতে পারছেন না। বাংলাদেশি কমিউনিটির জন্য ঘটনাটি মর্মান্তিক বলে উল্লেখ করেন তিনি। জানা গেছে, ঘটনার শিকার পরিবারটির কোনো নিকটাত্মীয় ওই এলাকায় না থাকায় বাংলাদেশি এসোসিয়েশন অব নর্থ টেক্সাস লাশ দাফনের ব্যবস্থা করছে। এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট হাশমত মোবিন গণমাধ্যমকে জানান, ময়নাতদন্তের পর মরদেহ স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হবে। মেডিকেল এবং পুলিশি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে স্থানীয় সময় বুধবার জানাজা শেষে তাদের দাফন হতে পারে বলে জানান তিনি। হাশমত মোবিন বলেন, প্রায় ২২ বছর আগে ডিভি ভিসায় তৌহিদুল ইসলাম আমেরিকায় আসেন। তৌহিদুল ইসলামের জন্ম ও বেড়ে ওঠা পুরান ঢাকায়। পরিবার নিয়ে প্রথম দুই বছর নিউ ইয়র্কে ছিলেন। ২০ বছর আগে তারা টেক্সাসে স্থানান্তর হন। প্রথমে তথ্য-প্রযুক্তিতে কাজ করলেও সমপ্রতি সিটি ব্যাংকের ভালো পদে কাজ করছিলেন তৌহিদুল। ডালাস ও আশপাশের নগরীতে বসবাসরত প্রায় ২০ হাজার বাংলাদেশির প্রতিনিধিত্ব করে বাংলাদেশি এসোসিয়েশন অব নর্থ টেক্সাস। হাশমত মোবিন জানান, কমিউনিটির নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি ওই পরিবারকে জানতেন। ঘনিষ্ঠ লোকজন তৌহিদুল ইসলামের পরিবারকে আদর্শ বাংলাদেশি পরিবার বলেই মনে করতেন তিনি। অ্যালেন পুলিশ জানিয়েছে, ২২ বছর বয়সী তানভীর তৌহিদ আইনসম্মতভাবে সমপ্রতি আগ্নেয়াস্ত্র ক্রয় করেছিলেন। শাওন আহসান নামের এক প্রবাসী জানান, তিনি পরিবারটিকে এক দশকের বেশি সময় থেকে জানেন। গত রোববার তিনি তৌহিদুল ইসলামকে ফোন করে কোনো সাড়া পাননি। ফিরতি কোনো ফোনকল না পেয়ে কিছুটা উদ্বিগ্ন ছিলেন। সোমবার কমিউনিটি মারফত সংবাদটি পাওয়ার পর তিনি ঘটনাস্থলে আসেন।
মিশিগানে নাবিলের পরিবারে শুধুই বিলাপ: এদিকে টেক্সাসের ঘটনার একদিন আগে মিশিগানে ঘটে আরেক মর্মস্পর্শী মৃত্যুর ঘটনা। স্থানীয় বাংলাদেশীরা জানান, হ্যামট্রামিক সিটির লামকিন স্ট্রিটের একটি বাড়িতে ২রা এপ্রিল শুক্রবার আনুমানিক বিকাল ৪টার দিকে প্রতিবেশীরা গুলির শব্দ এবং চিৎকার শুনতে পান। পরক্ষণেই পুলিশের উপস্থিতি এবং পরিবারের সদস্যদের জবানিতে ঘটনার প্রকাশ ঘটে। তাতে জানা যায়, ওই বাড়ির আলমাস খানের ১৩ বছর বয়সী ছেলে নাবিল খান বাবার লাইসেন্স করা পিস্তল দিয়ে মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেছে। তার আত্মহত্যার কারণ এখনো অজানা। তবে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে পুলিশ ধারণা করছে গেমে আসক্তি থেকে ডিরিলি হয়ে কিংবা হতাশা থেকে এমনটি হতে পারে। নাবিল হ্যামট্রামিক মিডিল স্কুলের ৮ম শ্রেণির ছাত্র। হ্যামট্রামিক সিটিতে অবস্থিত আল-ইসলাহ হিফজ মাদ্রাসার পার্টটাইম ছাত্রও সে। তার পৈতৃক নিবাস সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার আটঘর গ্রামে। একমাত্র ছেলে নাবিলের করুণ এই মৃত্যুতে তার মা-বাবা পাগলপ্রায় অবস্থায় রয়েছেন। তার লাশকে ঘিরে শোকাহত পরিবার ও স্বজনদের করুণ বিলাপের একটি ভিডিও পাওয়া গেছে। কমিউনিটির নেতারা বলছেন, ওই পরিবার তো বটেই পরিচিতজনদের মর্মস্পর্শী ঘটনাটি ছুঁয়ে গেছে। কেন এমনটি হলো, কিসের হতাশা বা অতৃপ্তি থেকে ছেলেটি আত্মহননের পথ বেছে নিলো? সেটা ভেবে কূল পাচ্ছেন না কেউই। এ অবস্থায় সোমবার দুপুরে নাবিলের প্রতিষ্ঠানে নামাজে জানাজা শেষে ট্রয় সিটির হোয়াইট চ্যাপল সিমেট্রিতে তার দাফন সম্পন্ন হয়েছে। করোনার মধ্যেও জানাজা এবং দাফনে নাবিলের স্বজন এবং বিপুল সংখ্যক প্রতিবেশী অংশ নেন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status