বই থেকে নেয়া

মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৫)

‘আবার বন্ধ প্রকোষ্ঠে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ভাবতেই গা শিউরে উঠলো’

স্টাফ রিপোর্টার

৬ এপ্রিল ২০২১, মঙ্গলবার, ১০:১৯ পূর্বাহ্ন

মাথার উপর মুহুর্মুহু সাইরেন বাজতে থাকলেও আমাদের প্রিজন ভ্যানটি মৃদু লয়ে চলছিল। সেই ঘটনাবহুল ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনে গিয়ে ভ্যানটি মোড় নিলো ডানদিকে। তারপর অনেকদূর যাওয়ার পর এক ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে কখনো অতি আস্তে, কখনো বা জোরে, কখনো বিকট শব্দে, কখনো নিঃশব্দে উঁচু-নিচু লয়ে যাচ্ছিল। চারদিকের অসংখ্য কোলাহল, বিকট হর্নের আওয়াজ ভেদ করে ভ্যানটি খানিক অগ্রসর হচ্ছিল আমি তখন একরকম জড়তা কাটাবার জন্যেই পা দুটো সামনের দিকে বাড়িয়ে অঙ্গ সঞ্চালন করার সময় পা দুটো কোথাও স্পর্শ না করাতে বুঝতে পারলাম যে, আমার আশপাশে আপাতত কেউ নেই। ভ্যানটিতে আমি একা এবং ভ্যানের অপর প্রান্তে শুধু দাঁড়ানো কয়েকজন পুলিশ।
আমাকে আবার সেই বন্ধ প্রকোষ্ঠে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এটা ভাবতেই আমার গা শিউরে উঠলো এবং মনে হলো আমার শিরার গতিও ক্রমশ অচেতন হয়ে যাচ্ছে। আমার মনে হচ্ছিল এবারকার অবস্থা হবে আগের চাইতেও ভয়াবহ, সামনে পেছন থেকে আসবে উপর্যুপরি লাঠির আঘাত, আমাকে অর্ধনগ্ন করে অবিরত চড়, কিল, ঘুষি ও থাপ্পড় মারা হবে; অচেতন হয়ে গেলে রক্তাক্ত মুখ ও দেহে ঠাণ্ডা পানির ঝাপটা দেওয়া হবে। চেতনা ফিরে এলে আবার আমার উপর একই ধরনের অত্যাচার চালিয়ে আমাকে অচেতনাবস্থায় নিয়ে যাওয়া হবে অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের সাথে এরা এই একই ধরনের আচরণ করছে এবং এটা তাদের কাছে একরকম দৈনন্দিন রুটিনের পর্যায়ে চলে গেছে। আগেরবার মাত্র এক রাতে এরা অতদূর অবধি এগোয়নি, তবে এবার চার রাতে তারা যে আমার উপর অবর্ণনীয় অত্যাচার চালাবে সে নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না। এসব কল্পনা করেই আমি একরকম ঘেমে উঠলাম। জবাবদিহিতাবিহীন একটা সরকারে ক্রোধ, ক্ষমতার উৎসজাত না হয়ে বরং ক্ষমতাই ক্রোধের উৎস হয়ে পড়েছে, এ ভাবনা আমাকে আতঙ্কিত করে তুললো। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম যে, এবার ভ্যানটি চলছে অপ্রশস্ত একটা গলিপথ দিয়ে। বুঝতে পারলাম যে, রাস্তাটি হলো অসমতল, এবড়োথেবড়ো। চাকাগুলো গড়িয়ে গড়িয়ে চলছে ভাঙাচোরা ইট-কাঁকরের উপর দিয়ে, কখনো বা হেলে পড়ছে। ডানে অথবা বাঁয়ে। একসময় এর গতি কমে এলো এবং একটা শক্ত ঝাঁকি দিয়ে। মনে পড়লো কেউ একজন হাত ধরে আমাকে সাহায্য করলো ভ্যান থেকে নেমে আসতে। তারপর চারধাপ সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আমাকে মোড় ঘুরানো হলো বামদিকে, তারপর আবার ফেরানো হলো ডানদিকে। এরপর স্বল্প পরিচিত জায়গাটি অতিক্রম করে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো ছোট্ট একটা ঘরে। আমার চোখ বাঁধা কাপড় খুলে ফেলা হলো। দিনের তীব্র আলোর সাথে ভারসাম্য করতে গিয়ে আমি চোখ খুলতে একটু সময় নিলাম। কিন্তু চোখ খুলে দেখলাম যে, দিনের আলোর কোনো অস্তিত্ব সেখানে নেই। দেখলাম আমাকে নিয়ে আসা হয়েছে অন্ধকার ও পুঁতিগন্ধময় সেই পুরনো ঘরটিতেই। সেই একই লোক, পরে যার নাম জেনেছি ইন্তাজ মিয়া, বিরস মুখে আমাকে অভ্যর্থনা জানালো। “আপনাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। একটু বিশ্রাম করুন, বলে আমার ব্যাগটাকে ধপ করে মেঝেতে ফেলে সে চলে গেল। আমার খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে কোনো শব্দ সে উচ্চারণই করলো না। কোনো ম্যাট্রেস বা বালিশবিহীন সেই কাঠের চৌকিটিতে আমি কিছুক্ষণ বসে রইলাম। আমি অনুমান করতে পারছিলাম বাইরে এখন পড়ন্ত অপরাহ্ন।
দুই বছর আগে এই দিনটাতে ছিল আমার ছেলে আমানের বৌভাতের দিন। প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলের প্রশস্ত ব্যাংকোয়েট হলে আয়োজন করা হয়েছিল এক জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের। এতে দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল প্রায় দেড় হাজার অতিথিকে। যাদের মধ্যে ছিলেন রাজনীতিবিদ, মন্ত্রীবর্গ, রাষ্ট্রদূতগণ, অধ্যাপকম-লী, কবি-সাহিত্যিক, সম্পাদক, কলাম লেখক, চিত্রশিল্পী, পুরনো বন্ধু ও দু’পক্ষের আত্মীয়স্বজন। আমার কাছে সবচাইতে রোমাঞ্চকর ছিল হার্ভার্ড থেকে আমাদের বন্ধু প্রফেসর রডারিক ম্যাক ফারকার ও তার বান্ধবী, লন্ডন থেকে আলেকজান্ডার ডাফি ও কোলকাতা থেকে জাস্টিস সোহানলাল শরাফ ও তার স্ত্রী- যাদের সকলেই সুদূর পথ পাড়ি দিয়ে এসেছিল আমানের বৌভাতের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে আমাদের ধন্য করতে। আমাদের প্রতিবন্ধী পুত্র আমানকে মস ব্রাদার্সের কালো স্যুটে অত্যন্ত সুদর্শন লাগছিল। তার মায়ের পছন্দ অনুযায়ী কেনা এই স্যুটের সঙ্গে ছিল ম্যাচ করা শার্ট, সাদা ডিজাইন করা ফ্যাশনসই টাই, বুক পকেটে ছিল একটু ঝুলানো একটা সিল্কের রুমাল। কাপড় পরার ও সাজের এই ভঙ্গিটি আমানের খুবই পছন্দের। ব্যাংকোয়েট হলের প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে আমান অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছিল। তার পাশে ছিল লাল ও সোনালী কারুকাজ করা বিশেষভাবে বানানো জাঁকজমকপূর্ণ শাড়ি পরা একই রকম উজ্জ্বল, সুন্দরী ও প্রাণবন্ত জোরাহ্। কিছুক্ষণ পরেই তাঁর সমস্ত ব্যক্তিত্ব ও উচ্ছলতা নিয়ে অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এলেন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। প্রধানমন্ত্রীর পরে এলেন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ ও তার স্ত্রী। প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী আলাদা আলাদাভাবে উঁচু করে বানানো একটা প্লাটফরমে উঠে বর ও কনেকে আশীর্বাদ করলেন। চারদিকে মুহূর্তের মধ্যে ঝলসে উঠলো অসংখ্য ক্যামেরা ও ভিডিওর ফ্ল্যাশ লাইটের আলো। আশীর্বাদ অনুষ্ঠান শেষ হলে প্রধানমন্ত্রী ঘুরে ঘুরে আগত অতিথিদের সঙ্গে মাথা নেড়ে, মৃদু হেসে, কখনো বা দুয়েকটি বাক্য কুশলাদি বিনিময় করে তার জন্য নির্ধারিত আসনে গিয়ে বসলেন। ডিনার সার্ভ করার আগে ২০ জন সুদর্শন তরুণীর একটি আকর্ষণীয় দল নেচে গেয়ে অভ্যর্থনা জানালো বাংলা নববর্ষ এবং উপস্থিত অতিথিবৃন্দকে।
কিন্তু আজ করাল অন্ধকারের বাস্তবতায় কিছুক্ষণের মধ্যেই আনন্দময় সেই স্মৃতি মলিন হয়ে গেল। সন্ধ্যা আসার সঙ্গে সঙ্গে মৃদু আলোর ইলেকট্রিক বাতিটিকে বাইরে লাগানো একটি সুইচ টিপে জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। বাতির আবছা আলোয় আমি ঘরের সেই পুরনো অধিবাসীদের আবার আবিষ্কার করলাম- তবে তুলনামূলকভাবে এবার তারা সংখ্যায় ছিল কিছুটা কম। পিঁপড়া, তেলাপোকা ও ইঁদুরের সরব অস্তিত্ব আমি সহজেই টের পাচ্ছিলাম। রাত আসার সাথে সাথে মশককুলও রক্তের সন্ধান পেয়ে ক্রমশ সজাগ হতে শুরু করছিল।
তবে এর চাইতে বিরক্তিকর ও আতঙ্কজনক ব্যাপার ছিল পাশের ঘর থেকে ভেসে আসা আর্তনাদ ও গোঙানীর শব্দ। আমি নিজের কাছেই জিজ্ঞেস করলাম, ওদের কি মানুষের উপর নির্যাতন চালানো ছাড়া অন্য কোনো কাজ নেই? এসব কথা ভাবতে গিয়ে নিজেকে আরো দুর্বল ও অবসন্ন মনে হচ্ছিল। আমার জন্য তখন সবচেয়ে প্রয়োজন ছিল একটু পানি। শুধু পিপাসা নিবারণের জন্য নয়, ওষুধ খাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণের পানি। জীবন রক্ষাকারী এই ওষুধগুলো যেখানেই যাই আমার ব্যাগে করে সঙ্গে নিয়ে যাই। গত দুদিনের টানাপড়েনে আমার ওষুধ নেওয়ার নিয়ম ভঙ্গ হয়েছে। জীবন বাঁচানোর জন্য হাইড্রোকোরটিজন স্টেরয়েড এবং থাইরক্সিন প্রতিদিন নিয়মিত সেবন করতে হয় আমাকে। ১৯৮৮ সালে আমি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ঢাকায় ডাক্তাররা নানা রকমের পরীক্ষা করে বলেছিলেন যে, আমি চিরদিনের জন্য অন্ধ হয়ে যেতে পারি। পরামর্শক্রমে আমি জরুরিভিত্তিতে লন্ডনে চলে যাই। ৭৫ বছর বয়সের বিশ্বের একজন খ্যাতনামা নিউরো সার্জন প্রফেসর লিন্ডজে সাইমন কুইন স্কোয়ারের ন্যাশনাল হাসপাতালে আমার মাথার খুলি উন্মুক্ত করে সাত ঘণ্টা ধরে এক অপারেশন করে পিটুইটরি টিউমার বের করে আমার দৃষ্টিশক্তি নিশ্চিত করেন। এর পর থেকে গত ২০ বছরে আমি প্রতিদিন একই ওষুধ সেবন করে আসছি। আমার হরমোন সিস্টেমের সাথে ব্যালেন্স করতে গিয়ে বৃস্টল ইউনিভার্সিটির প্রফেসর স্ট্যাফোর্ড লাইটম্যান প্রতিবছর একটি বিশেষায়িত রক্ত পরীক্ষার ভিত্তিতে সেই সব ওষুধের মাত্রা পুনঃনির্ধারণ করে দেন। ২০০৭ সালের আগস্ট মাসে আমার গ্রেফতারের পর আমার স্ত্রীর কাছে লেখা একটি চিঠিতে তিনি বলেছিলেন যে, কোনো মাত্রাতিরিক্ত শারীরিক বা মানসিক চাপ আমার স্বাস্থ্যের জন্য বিশেষভাবে ক্ষতিকারক হবে।
বেপরোয়া হয়ে দরজায় কয়েকবার করাঘাত করার পর বাইরে থেকে তালা খোলার শব্দ পাওয়া গেল। কিন্তু পুরো দরজাটা খুললো না। সামান্য ফাঁক হয়ে থাকা দরজার ওপাশে ইন্তাজ মিয়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। আধা ঘুম চোখে জিজ্ঞেস করলো আমি কিছু চাই কিনা। আমি জানালাম, আমার একটু পানি প্রয়োজন। পরমুহূর্তে আবার দরজা বন্ধ হয়ে গেল। আমি ব্যাগ টেনে নিয়ে চৌকিতে বসলাম ও ব্যাগ থেকে প্রয়োজনীয় ওষুধ বের করে খাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে সে কিছু শুকনো খাবার ও ময়লা একটি অ্যালুমিনিয়াম গ্লাসে করে এক গ্লাস পানি নিয়ে এলো। আমি কোনো বাছবিচার না করে খাবারটুকু খেয়ে নিলাম এবং ওষুধ খাওয়ার জন্য যতটুকু পানি প্রয়োজন চোখ বন্ধ করে ততটুকু পানি নিয়ে সেটা গলায় ঢেলে ইন্তাজ মিয়াকে ধন্যবাদ জানালাম। তারপর ইন্তাজ মিয়া জানালো, আমাকে তার সাথে যেতে হবে; কারণ, ‘ওরা’ আমার সাথে কথা বলার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি একটা মশারী জোগাড় করা সম্ভব কিনা জিজ্ঞেস করলে ইন্তাজ মিয়া লজ্জিতস্বরে বললো যে, সেটা সম্ভবপর নয়। আবার কাপড় দিয়ে বাঁধা হলো আমার চোখ। তারপর শক্ত করে এক হাত ধরে খুব সম্ভবত সেই একই পুরনো ঘরে নিয়ে গিয়ে একই শক্ত কাঠের টুলের উপর বসানো হলো আমাকে। আমার সামনে তখন সেই ভারি টেবিল। কেবলমাত্র ঘরের ঘ্রাণটুকু ছাড়া বাকি সবকিছুই আমার কাছে পরিচিত বলে মনে হচ্ছিল।
    
(চলবে.. )

আরো পড়ুন-
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৪)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৫)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৬)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৭)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৮)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৯) 
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১০)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১১)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১২)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৩)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৪)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status