বই থেকে নেয়া

মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১০)

ভুট্টো বিশ্রাম নিচ্ছেন বলে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেয়া হলো

স্টাফ রিপোর্টার

৩১ মার্চ ২০২১, বুধবার, ১১:০৪ পূর্বাহ্ন

আবার এক দীর্ঘ পথে শুরু হলো আমার যাত্রা। প্রত্যেকবার ভ্যানটি রাস্তার কোনো গর্ত পেরুনোর সময় ঝাঁকুনি দেয় আর আমার ডান কাঁধে প্রচণ্ড ব্যথা চাড়া দিয়ে ওঠে। তবে ভ্যানটি ক্রমশ মসৃণ রাজপথে উঠে আসার পর আমার বুঝতে অসুবিধা হলো না যে, ইতিমধ্যে আমরা গুলিস্তান এলাকা পার হয়ে এসেছি এবং এখান থেকেই নতুন ঢাকা শুরু হয়েছে। এরপর আমরা সরকারি কর্মকর্তাদের কার্যালয় সচিবালয় ভবন পার হয়ে পুরনো হাইকোর্ট ভবনের সামনে ডানদিকে মোড় নিলাম, তারপর সুপ্রিম কোর্ট ভবন পার হয়ে কাকরাইল মসজিদ ও রমনা পার্কের বামদিকে ও মন্ত্রীদের জন্য সুরক্ষিত ভবনগুলোকে ডানদিকে রেখে হেয়ার রোড ধরে এগিয়ে যাবে ভ্যানটি রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন সুগন্ধা’র দিকে। ১৯৬২ সালে ইংল্যান্ডের রাণী এলিজাবেথ বাংলাদেশ সফরে এলে রাত কাটিয়েছেন এই সুরম্য বাসভবনে এবং স্বাধীনতার পরে শেখ মুজিবুর রহমান তার সরকার পরিচালনার জন্য সুগন্ধা বলে পরিচিত এই ভবনকে তার অফিস হিসাবে ব্যবহার করেন। এর নামকরণ করেছিলেন গণভবন। এখানে ভ্যানটি ক্রমশ গতি কমিয়ে মোড় নিল বাঁদিকে ও পৌঁছে গেল বোধহয় হোটেল শেরাটনের কোণায়। হোটেলটির আগের নাম ছিল হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল এবং স্বাধীনতার আগে এটি ছিল ঢাকার একমাত্র আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হােটেল। আমার দুচোখ বাঁধা থাকলেও আমি মনে মনে ভ্যানটির প্রতিটি মুভমেন্ট অনুধাবন করতে পারছিলাম। ততক্ষণে বাহনটি জ্যামে আটকা পড়েছে। ভিআইপি রোডে ওঠার পর এই জ্যাম সবার কাছে একটি অতি পরিচিত অভিজ্ঞতা।
ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের কথা মনে হতেই আমার স্মৃতিতে ভেসে ওঠে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সূচনাকারী স্বাধীনতা সংগ্রামের ঠিক অব্যবহিত আগেকার কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বিশেষ করে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের কথা, যে রাতে পাক হানাদার বাহিনী নির্মমভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর।
সবেমাত্র শেষ হয়েছে দেশের সাধারণ নির্বাচন। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জাতীয় পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে বিজয়ী হয়েছে। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচন ছিল পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন। জেনারেল মুহম্মদ ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসনের অধীনে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে বিজয়ের পর শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ করার ঘোষণাও জারি করা হয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানের জেনারেলরা এই ঘটনাকে খুশি মনে মেনে নিতে পারেনি। অন্যদিকে শেখ মুজিবুর রহমানও বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ২৪ বছরের পাকিস্তানী শাসনের অবসান ঘটিয়ে তাদের চিরমুক্তির দাবি বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসন অর্জনের আকাক্সক্ষাকে পদদলিত করতে বিন্দুমাত্র আগ্রহী ছিলেন না। এই হোটেল থেকে বড়জোর ৩০০ মিটার দূরে রাষ্ট্রীয় ভবন সুগন্ধায় অবস্থান করে এ নিয়ে দেনদরবার চালাচ্ছিলেন পাকিস্তানের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান। মুজিব ও ইয়াহিয়া খানের মধ্যে দেনদরবার যখন প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে এবং শেখ মুজিব যখন শান্তিপূর্ণভাবে তার দেশের জনগণের প্রাণের দাবি একটি কনফেডারেশনের অধীনে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন অর্জনের প্রায় দ্বারপ্রান্তে উপনীত, ঠিক সেই সময়ে শক্তিশালী জেনারেলরা জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে জোটবেঁধে ঘুরে দাঁড়ালেন। জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তান পিপলস পার্টি থেকে ৮৫টি আসনে বিজয়ী হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে ‘এক দেশে দুই প্রধানমন্ত্রীর দাবি তুলে বললেন যে, শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের এবং তিনি স্বয়ং পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন। তাঁর আসল উদ্দেশ্যই ছিল দেনদরবারে অচলাবস্থা সৃষ্টি করে ইয়াহিয়া খান ও শেখ মুজিবের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সমঝোতার পথ অবরুদ্ধ করে দেওয়া। মুজিব-ইয়াহিয়ার আলোচনা ব্যর্থ হয়ে যায় এবং শান্তিপূর্ণভাবে দেনদরবার ও সমস্যা সমাধানের আকস্মিক পরিসমাপ্তি ঘটে। স্মৃতিতে উজ্জ্বল এই দিনগুলোকে আমার কাছে মনে হচ্ছিল এই সেদিনকার ঘটনামাত্র, আমি স্বয়ং যার একজন জলজ্যান্ত সাক্ষী। বিকালের মধ্যে শেখ মুজিব যখন তার ধানমণ্ডির বাসায় বসে খবর পেতে থাকলেন যে, পাকিস্তানী বাহিনী তার নির্বাচনী বিজয়কে নস্যাৎ করার লক্ষ্যে গোলাবারুদ ব্যবহার করে জনগণের উপর আক্রমণ করতে যাচ্ছে, তখন তিনি আমার সামনেই তার ঘনিষ্ঠজনদের নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে বলেন এবং যার যা সম্বল তা নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নিতে বলেন।
হোটেলটি তখন ছিল বিদেশী সাংবাদিকে পরিপূর্ণ। এরা সকলেই ছিলেন উত্তেজনাপূর্ণ, দ্রুত পরিবর্তনশীল ঘটনাবলীর শেষ দৃশ্য দেখার জন্য উন্মুখ । গত দুই বছরে বাঙালিদের সমান অধিকার আদায়ের একটি আন্দোলন কীভাবে এক স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তার প্রতিটি পর্যায় তারা গভীর অভিনিবেশ সহকারে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। সন্ধ্যা নাগাদ ইয়াহিয়া খান তার জেনারেলদের হাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের ভার দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলেন। আমি যখন প্রায় ৪০ জন বিদেশী সাংবাদিকের কাছে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করছিলাম ঠিক সেই সময়ে একজন হোটেলের কর্মকর্তা এসে হোটেলের প্রবেশ মুখে একটি ব্ল্যাকবোর্ডে একটা সতর্কবাণী দিয়ে সাদা চক দিয়ে ইংরেজিতে লিখে গেলেন “অতিথিরা হোটেলের ভেতরেই অবস্থান করবেন। নিরাপত্তা রক্ষার্থে বাইরে যাওয়া নিষেধ।” এতে উপস্থিত বিদেশী সাংবাদিকেরা এক ভয়াবহ দুর্যোগের আভাস পেলেন। আমরা সবাই উঠে গেলাম ১০ তলায়। পশ্চিম ও উত্তর দিকে খোলা একটি স্যুইটে অবস্থান নেওয়ায় শহরের এক-অর্ধাংশ আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম। এ সময় আমরা উপর থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম কালো রঙের একটি মার্সিডিজসহ আরে দুটি গাড়ি হোটেলে প্রবেশ করলো ও মার্সিডিজ থেকে নেমে আসলেন জুলফিক আলী ভূট্টো। তড়িঘড়ি করে তিনি হোটেলে প্রবেশ করলেন। খবর নিয়ে জানলাম যে, তিনি ১১ তলায় প্রেসিডেন্ট স্যুইটে রাত কাটাবেন। পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে খোলা স্যুইট থেকে তিনি শহরের অপর অর্ধাংশ দেখতে পাচ্ছিলেন। ভূট্টো সেখানে গেছেন শুনে সাংবাদিকেরা সকলে ভিড় করলেন তার দরজায়। কিন্তু সেখান থেকে তাদের জানিয়ে দেওয়া হলো যে, ভূট্টো বিশ্রাম করছেন এবং কারো সাথে কথা বলবেন না। সবার মুখের উপর বন্ধ করে দেওয়া হলো ঘরের দরজা। একজন সিনিয়র সাংবাদিক
টিপ্পনি কেটে বললেন, “উনি সন্ধ্যা উপভোগ করার জন্য রয়েল স্যালুট ও বরফের টুকরা নিয়ে মদ্যপানে বসেছেন।” একটা হাসির রোল পড়ে গেল। “আমি বাজি ধরতে পারি তোমার কথা ঠিক”, মৃদু হেসে বললেন আরেকজন ।
এক ঘণ্টা পার না হতেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের রাত্রিনিবাস সুগন্ধা থেকে বের হয়ে এলো কামান ও অত্যাধুনিক অন্যান্য মারণাস্ত্রসজ্জিত সামরিক জিপ ও ট্রাকের এক বিশাল বহর। হোটেলের পাশ দিয়ে ভিআইপি রোডে বাঁদিকে মোড় নিয়ে বহরটি সোজা চলে গেল পিজি হাসপাতালের দিকে। সেখান থেকে ডানে মোড় নিয়ে এগিয়ে গেল বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার দিকে। আমার আশঙ্কা হলো যে, এরা এগিয়ে যাচ্ছে শেখ মুজিবের বাড়ির দিকে। আতঙ্কিত হয়ে আমি যখন দ্বিতীয়বারের মতো শেখ মুজিবের বাসায় ফোন করে আবার জানাবার চেষ্টা করলাম যাতে করে তিনি নিরাপদ স্থানে চলে যান, কিন্তু ততক্ষণে তার বাসার টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে। উত্তর দিকে অর্থাৎ ক্যান্টনমেন্টের দিক থেকে অস্ত্রসম্বলিত ট্রাকের আরেকটি বহর এসে থামলো ঠিক আমাদের হোটেল ভবনের পশ্চিম দিকের সড়কসঙ্গমে। সাথে সাথে হোটেলের সাংবাদিকেরা ছবি তোলা ও সংবাদ সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে এদিক-সেদিক ছুটোছুটি শুরু করলো। এ নাটকীয় উত্তেজনায় সবাই টান টান। ট্রাকে আসা সেনাদল এবার ট্রাক থেকে নেমে সরু গলিপথ ধরে রাস্তার ভেতরের জনপ্রিয় ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা দি পিপল-এর অফিসের দিকে এগিয়ে গেল এবং “আল্লাহু আকবার”, “পাকিস্তান জিন্দাবাদ” শ্লোগান দিতে দিতে পত্রিকার অফিসে হামলা চালালো। সাফল্যের সাথে সেখানে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে সেনাবহর নিয়ে ট্রাকটি আবার পূর্ববর্তীদের অনুসরণ করে একই রাস্তা ধরে এগিয়ে গেল সামনের দিকে। ইতিমধ্যে চারদিকে শুরু হয়ে গেছে রকেটের হামলা। আগ্নেয়াস্ত্রের কান বধির করা গর্জন, শহরের চারদিক থেকে ভেসে আসছে গোলাবারুদ বিস্ফোরণের আওয়াজ, আগুনের লেলিহান শিখার নিচে তখন দাউ দাউ করে জ্বলছে ঢাকা শহর এবং ক্রমশই তার পরিধি আরো বেড়ে চলছিল। ভোর প্রায় তিনটার দিকে এয়ার ফোর্সের একটা বাস এসে থামলো হোটেলের দরজায়।
বাসটি থেকে নেমে এলো একজন বিমানবাহিনীর অফিসার। দড়াম করে হোটেলের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে সে ঘোষণা করলো, বিদেশী সব সাংবাদিককে বহিষ্কার করা হয়েছে এবং দশ মিনিটের মধ্যে নিজেদের জিনিসপত্র গুছিয়ে তাদের বাইরে অপেক্ষমাণ বাসে আরোহণ করতে হবে। সেই তরুণ অফিসার আমাকে চিনতে পেরে কানের কাছে মুখ নিয়ে ইংরেজিতে নিম্নস্বরে জানালো, “বড় পাখিটিকে খাঁচায় ভরা হয়েছে।” আমি তাৎক্ষণিকভাবেই তার সাংকেতিক বার্তা বুঝে ফেললাম । অর্থাৎ শেখ মুজিব তাদের হাতে এখন বন্দী।

(চলবে...)

মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৪)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৫)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৬)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৭)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৮)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৯)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status