বই থেকে নেয়া

লন্ডন হাউজ

আসিফ নজরুল

২৯ মার্চ ২০২১, সোমবার, ১২:৩৫ অপরাহ্ন

লন্ডনে আমি পৌছাই ১৯৯৪ সালের ১৬ সেপ্টেম্বরে। যাত্রার শুরুটা ছিল ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ-এ। দিল্লিতে সেই প্লেন যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিকল হয়ে যায়। বেশ কয়েকঘন্টা পর আমাদের তুলে দেয়া হয় এয়ার কানাডাতে।
বিমানে তখন ধুমপায়ীদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা ছিল। ব্যাপক পানাহার আর সিগারেট খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়লাম। মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে অবিশ্বাস্য মনে হল সবকিছু। সত্যি আমি লন্ডন চলেছি! মনে হলো যেন সাত সমুদ্র তের নদী পারের কোথাও।  

আমার এর আগে বিমান ভ্রমন ছিল মাত্র কলকাতা পর্যন্ত। ফলে দিল্লী থেকে লন্ডন জার্নি মনে হলো অনন্ত কিছ্।ু লন্ডনের হিথ্রো এয়ারপোর্টে নামি ক্লান্তি নিয়ে। হিথ্রো-র চোখ ধাধানো গ্ল্যামার দেখে অবশ্য ক্লান্তি দুর হয়ে যায়। তবে মনের মধ্যে একটা জিনিষ সারাক্ষন খচখচ করতে থাকে। আমার ভিসার ওপর ব্রিটিশ দূতাবাসের ঝানু কর্মকর্তা নামের বানান ভুল লিখেছে। নজরুলের আর-এর জায়গায় লিখেছে জেড, ফলে সেটা হয়ে গেছে নজ্জুল। এ্যমবেসীতে যাওয়ার পর তারা জেড-এর উপর ওভাররাইট করেছে। সেটা কি অক্ষর তা ঠিকমতো বোঝাও যায়না। এখন এটা নিয়ে কোন ঝামেলা হলে?যদি তারা ধরে নেয় কাটাকাটিটা আমি করেছি!

প্লেনে ওঠার কয়েকদিন আগে এটি দেখে হতবিহবল হয়ে ছুটে গিয়েছিলাম শহীদুল্লাহ খান বাদল ভাই এর কাছে। তিনি একশটা দেশ ঘুরা মানুষ, বলেছেন আমার কোন সমস্যা হবে না। তারপরও আমার আশঙ্কা দূর হয়না। প্রৌঢ় ইমিগ্রেশন অফিসারের সামনে এসে ভিসার ভুল হরফের ওপর আঙুল চেপে রাখি। কোমল করে হাসি। সেই হাসি একটুও স্পর্শ করে না তাকে। কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করে আমার আগমনের কারণ।

তার এই কাঠিন্য থাকে না বেশিক্ষণ। আমি কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে এসেছি। সেজন্য বোধহয় ভুল বানানও চোখে পড়ে না তার। কাস্টমস পার হয়ে এরাইভাল লাউঞ্জের দিকে যেতে যেতে আমার বিচলিত ভাব কেটে যায় পুরোপুরি। এরাইভাল লাউঞ্জের দুপাশে সারিসারি মানুষ দাঁড়িয়ে।  কারো কারো হাতে ছোট প্ল্যাকার্ডের মতো। আমার ঠিক সোজাসুজি বিশালদেহী একজন কালোমানুষ। তার হাতে লাল রঙের প্ল্যাকার্ড। সেখানে কিছু একটা লেখা। আমি তা পড়ার চেষ্টা করতে করতে লাগেজ ঠেলি স্যামুয়েল, আম্মান, জর্ডন। এর মানে কি? কালোমানুষ প্রায় খেঁকিয়ে ওঠে- আর য়্যু স্যামুয়েল?

আমি তাকে পাত্তা দেই না। এয়াপোর্টের একটা ডিপার্চার গেইট দেখে মহাউৎসাহে সেখানে যাই। বের হয়ে ‘হ্যালো লন্ডন’ বলে লম্বা একটা শ্বাস নিবো, হঠাৎ মনে হলো হীমশীতল একটা চাদর জড়িয়ে ধরেছে আমার সারা শরীর। আমার পড়নে একটা মোটা সোয়েটার, তারপরও এমন শীত অবিশ্বাস্য মনে হল। তাড়াতাড়ি পিছু হটে এয়ারপোর্টে ঢুকে যাই।

লন্ডনে এসে প্রথমে উঠতে হবে জেমস হোটেল নামে একটা হোটেলে। ক্যাবে করে সেখানে রওয়ানা দিলাম। রাস্তায় ক্যাব চালককে বললাম: হ্যালো, হাউ আর ইউ? সে হেসে কি যেন বললো। কি যেন জিজ্ঞেসও করলো। আমি আন্দাজ করে করে কথা বলতে লাগলাম। আমি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, লন্ডনে এসেছি পিএইডডি করতে-এটাও ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজীতে বোঝানোর চেষ্টা করলাম। তাকে খুব একটা ইমপ্রেসড্ মনে হলো না।

পকেট ভর্তি কমনওয়েলথ স্কলারশীপের যাত্রা প্রস্তুতির জন্য দেয়া পাউন্ড-স্টারলিং। জেমস হোটেলের সামনে নেমে দশ পাউন্ড বকসিসও দিলাম তাকে। সে অবাক হয়ে তাকালো। আমি টেক ইট ফ্রেন্ড বলতে বলতে অকারণে হাসতে লাগলাম। সে হাও ধরনের একটা অদ্ভ’ত শব্দ করে আকাশে দু’হাত ছুড়ে দিল। তারপর তা গ্রহন করলো।

ভারী ব্যাগ কোনমতে টেনেটেনে জেমস হোটেলে ঢুকলাম। রিসেপশন থেকে চাবি নিয়ে বহুকষ্টে দোতলায় রুমের দরজা খুলে ঢুকলাম। কবর সাইজের একটা রুম, অতিসরু একটা বেড, তার বুকের কাছে উপর থেকে ঝুলে থাকা অতিক্ষুদ্র টেলিভিশন। অবাক হয়ে দেখি এই রুমে আবার কোনমতে পেশাব-পায়খানা করার ব্যবস্থাও আছে একটা। নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস হলো না। এই আমার সাধের লন্ডন!

তখন বোধহয় মোবাইল ফোনের চল ছিল না। রিসেপশনে গিয়ে বিবিসির প্রডিউসার কাজী জাওয়াদ ভাইকে ফোন করি। তিনি বিচিত্রায় আমার কলিগ ছিলেন, আমাদের খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল দেশে থাকার সময়। কথা ছিল রাতে কাজ সেরে আমার অবস্থা দেখতে আসবেন তিনি। কিন্তু আমার ব্যাকুল ভাব দেখে তখনি রওয়ানা দেন নিয়ে যাওয়ার জন্য।  

জেমস হোটেলের রিসেপশনের মানুষটা লালমুখো, বিশাল দেহ। তাকে বলি এখনি চলে যাবো। সে ঘাও ঘাও করে কি যেন বলে। একটা কথাও আমি বুঝতে পারিনা। ক্ষিধায় পেট চোঁ চোঁ করছে। তাকে জিজ্ঞেস করতে গেলাম খাবারের কোন ব্যবস্থা আছে কিনা। সে আঙ্গুল দিয়ে হোটেলের ব্রুশিয়ারের একটা জায়গা দেখাল। বেড এ্যন্ড ব্রেকফাস্ট! ঘড়িতে দেখি বিকেল সাড়ে-চারটা বাজে। এখন কি তাকে আমার আজকের পাওনাটা ব্রেকফাষ্ট-টার কথা বলা যাবে? দেখি সে অবজ্ঞামিশ্রিত কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে আছে। গ্রাম থেকে লু্িঙ্গ পড়া ছোট চাচা এলে এভাবেই আমরা তাকিয়ে থাকতাম। আমি তো লুঙ্গি পড়িনি। তবু এই ব্যাটা এমন করে তাকিয়ে আছে কেন!

বাইরে গিয়ে দেখি তখনি সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে। বাতাসে হীমশীতল ভাব। কাছের একটা দোকান থেকে চকলেটের একটা বড় বার নিয়ে আসলাম। ব্ল্যাক-চকলেট! খেয়ে পুরো মুখ তেতো হয়ে গেল।  

এই নিষ্ঠুর, অচেনা আর দুর্বোধ্য জায়গা থেকে আমাকে বাচালেন কাজী জাওয়াদ ভাই।  রাতে তার বাসায় নিয়ে গেলেন। এরপর কয়েকদিন আমাকে ইংলিশ বানানোর চেষ্টা করলেন। এদেশে কারো দিকে অকারণে তাকানো মহা অপরাধ। লোকের সামনে গা চুলকানো আরো বড় অপরাধ। সর্দি হলে নাক টানা ছিঁচকে ধরনের অপরাধ। শুনতে শুনতে ঘাবড়ে যাই। রাতে ফোনে লন্ডনের স্কুলটিচার শামীম আজাদের বাণী চিরন্তনী: খুব সাবধানে থাকবে। এদেশে ক্যাচিং কোল্ড এ্যান্ড ফিলিং কোল্ড আর টু ডিফরেন্ট থিং।

জাওয়াদ ভাই-এর বাসায় ওঠার কারণে বিভিন্ন মানুষের দাওয়াতে যাওয়ার সুযোগ হলো। তারা ছিলেন বিবিসি বাংলা বিভাগের সাংবাদিক। উর্মি রহমান, আতিকুস সামাদ, আনিস আহমেদ, গোলাম কাদির, উদয় শংকর দাস- বন্ধুদের নিয়ে উনাদের একটা গ্রুপ ছিল তখন। তাদের আড্ডায় নানাবিষয়ে আলাপ হতো, হতো বিনোদনমুলক পরচর্চাও। দাওয়াত থেকে কোন মানুষ প্রস্থান করামাত্র তাকে নিয়ে আলোচনায় মেতে উঠতো অন্য কেউ কেউ।
তাদের দাওয়াতে মজার মজার খাওয়ার সুযোগ হলো। ভালো উপদেশও পাওয়া গেল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের একজন নামী শিক্ষক তখন পিএইচডি না করতে পেরে ফিরে গেছেন। তার কথা বলে সাবধান করতেন।
জাওয়াদ ভাই থাকতেন জোন ফোরে, আর্নোস গ্রোভে। টিউব স্টেশন থেকে দুরে একটা ছবির মতো সুন্দর বাসায়। পেছনে পেয়ার আর ফুল গাছের লম্বা বাগান। সেখানে তিনি বাগানের কাজ করতেন, মিহি রোদ পোহাতে পোহাতে তার সাথে গল্প করতাম। তার কঠোর নির্দেশ ছিল বাসার ভেতর সিগারেট খাওয়া যাবে না। লন্ডনে বাড়ীঘরের জানলা বন্ধ থাকে বলে সেটি খুব অনুচিতও ছিল। অল্পদিনের মধ্যে পেছনের বাগানে গিয়ে সিগারেট খাওয়া অভ্যাস করে ফেললাম।

কিছুদিন পর জাওয়াদ ভাই দেশে যাবেন কান্তা ভাবীসহ। তবে তিনি জানালেন আমি ইচ্ছে করলে থাকতে পারি তার বাসায়। কি বুঝে রাজী হলাম! কিন্তু তারা যাওয়ার পর আমার খুব খারাপ অবস্থা হলো। রাতে একলা বাসায় উপর নীচ করতে করতে পাগলের মতো লাগা শুরু করলো। একদিন রাতে টিভিতে হরর ছবি দেখে ভয়ও পেলাম খুব। ইংলিশ চেহারার ভ’ত কি এই ইংলিশ বাড়ীতে আসতে পারেনা আমাকে একা পেয়ে? খুব পারে। ভ’তের ভয়ে প্রতিজ্ঞা ভুলে একদিন সিগারেটও খেয়ে ফেললাম বাসার ভেতর।

জাওয়াদ ভাই ঢাকা যাওয়ার সময় আউটগোয়িং ফোন বন্ধ করে গেছেন। ফলে কাউকে ফোনও করতে পারিনা। তখনকার দিনে মোবাইল ফোন ছিল না, পে-ফোনের বিল ছিল খুব বেশী। তবু রাত-বিরেতে চেনা মানুষদের ফোন করতে বের হয়ে যেতাম। টিউব ষ্টেশন পর্যন্ত দশ/বারো মিনিট হেটে যেতাম দু-তিন মিনিট কথা বলার জন্য।
আর্নোস-গ্রোভ টিউবষ্টেশনের উল্টোদিকে ছিল একটা বাংগালী রেষ্টুরেন্টে। সেখানে গিয়ে পরিচয় হলো পুরানো ঢাকার খাজে দেওয়ানের ছেলে শোয়েবের সাথে। রেষ্টুরেন্টের সিলেটী মালিক তার শ্বশুর। শ্বশুর না থাকলে সে আমার সাথে মনখুলে গল্প করতো। একদিন দু:খ করে বললো সে তার বউয়ের বাংলা বুঝেনা, বউ তার ইংরেজী বুঝে না।
সেই হোটেলে একবার ঘটলো একটা দু:খজনক ঘটনা। সেখানে বসে পত্রিকা পড়ছিল একটা সাদা চামড়ার মানুষ। ছোটবেলায় চামড়ার গুদামে এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে কমন রুমে দেখতাম একটা পত্রিকা ভাগ করে পড়ছে মানুষ। সাদা চামড়ার টেবিলে ছড়ানো ছিটানো পত্রিকা। সেখান থেকে তাই একটা পাতা তুলে নেই অবলীলায়। সে সাথে সাথে উঠে দাড়ায়। চিৎকার চেচামেচি করে হুলস্থুল কান্ড বাধিয়ে ফেলে। হোটেলের মালিক এসে কোনমতে রক্ষা করে আমাকে।

এই রুক্ষ লোকালয়ে বেশিদিন থাকতে হয়নি আমাকে। অল্পদিনেই জাওয়াদ ভাইয়ের বাসা থেকে আমার ঠাঁই হয় এক অকল্পনীয় জগতে। ম্যাকলেনবার্গ স্কয়ারের লন্ডন হাউজে।

(আসিফ নজরুলের আলোচিত গ্রন্থ ‘পিএইচডির গল্প’ থেকে। এবারের বইমেলায় গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে বাতিঘর থেকে।)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status