মত-মতান্তর

স্বাধীনতার ৫০ বছর: গণতন্ত্র, সাম্য ও ধর্মীয় বৈচিত্র্যে খুঁজতে হবে ঐক্য

২৭ মার্চ ২০২১, শনিবার, ১১:২৪ পূর্বাহ্ন

বাংলাদেশের বিশিষ্ট গবেষক ও চিন্তাবিদ ড. সলিমুল্লাহ খান গত ১৩ মার্চ ‘’আহমদ ছফা: ২০ বছর পর’’ শীর্ষক এক মুক্ত আলোচনায় সারগর্ভ বক্তব্য পেশ করেন । সমকালীন সমাজ, সংস্কৃতি, দর্শন ও রাজনীতি নিয়ে পর্যালোচনা এবং কালজয়ী লেখক মহাত্মা আহমদ ছফার চিন্তার আলোকে গণতন্ত্র, সাম্য ও ধর্মীয় বৈচিত্র্যে দক্ষিণ এশিয়ার আধুনিকতম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ নেতৃত্ব দিতে পারে বলে আলোচনায় উল্লেখ করা হয় । বিলেতে ‘এথিক্স অব দি নেশন স্টেট’ পাঠচক্র গ্ৰুপের উদ্যোগে এই ভার্চুয়াল আলোচনায় যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী লেখক, সাংবাদিক, সমালোচকগণ অংশ নেন। ড. সলিমুল্লাহ খানের বক্তব্য অনুলিখন আকারে নিম্নে উপস্থাপন করা হলো।
 
এক:
ড. সলিমুল্লাহ খান তাঁর আলোচনায় বলেন, বাংলাদেশের ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলন ভারতের অনেকগুলো ভাষার আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করেছে । তার মধ্যে অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ূ, আসামসহ অনেক এলাকার কথা বলা যায়। এমনকি কাশ্মীরিরাও বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নতুন করে প্রেরণা লাভ করেছে। ভারতবর্ষ হচ্ছে বহু জাতির একটি মহাদেশ । মোঘল সাম্রাজ্যের আগে এখানে আরো বহু সাম্রাজ্য ছিল। ব্রিটিশের আগে এখানে মোঘলদের একমাত্র সাম্রাজ্য ছিল না। দক্ষিণ ভারতে চোলা সাম্রাজ্য, বিজয় নগর সাম্রাজ্য ছিল । সবশেষে ইংরেজ সাম্রাজ্য, যেটাকে আমরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বলি। এখানে ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পর তারা সাম্রাজ্যটাকে দুভাগে ভাগ করেছে। একটার নাম ভারত আর আরেকটার নাম পাকিস্তান। দুটো রিপাবলিক রাষ্ট্র হলো। কিন্তু দুটোতেই সাম্রাজ্য রয়ে গেল। অর্থাৎ ৪৭ সনে সমাধানের তৃতীয় যে পথ ছিল, যেটা আদিতে কেবিনেট মিশনও বলেছিল যে, পৃথক পৃথক অঞ্চলে পৃথক পৃথক স্বায়ত্তশাসিত রাজ্য হবে। তাহলে সারা ভারত একটা ফেডারেশন বা কনফেডারেশন হবে। কেবিনেট মিশন প্ল্যান হিসেবে যেটা পরিচিত। এটা কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ উভয়েই মেনে নিয়েছিল। সেটা থেকে যখন কংগ্রেস রিনেইগ করলো তখন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের জন্য চাপ দিলেন। পূর্ব বাংলায় পূর্ব ও পশ্চিম বাংলা মিলে স্বাধীন বাংলার যে আন্দোলন হচ্ছিলো, সেটা তখন পরাস্ত হলো । মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর কথায় ট্রানকেইটেড এন্ড মথ ইটেন পাকিস্তান তিনি পেয়েছিলেন। আহমদ ছফা বলেছেন, যে কারণে ভারত ও পাকিস্তান ভাগ হলো তাতে সমস্যার সমাধান হয়নি। ১৯৭১ সনে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সৃষ্টি সেটারই একটা আংশিক সমাধান ।
 
তিনি  বলেন, ভারত উপমহাদেশে যখন মুসলিম শাসন চালু ছিল, সেটাও হাজার বছর হয়নি। প্রথমে একটা ধারণা পোষণ করা হতো যে, বাঙালিরা মানে শুধু হিন্দুরা। এখনো অনেকে তাই মনে করেন। কিন্তু বাঙালি মুসলমানরা যে প্রচুর বাংলা লিখেছেন তার ইতিহাস অনেকে জানে না অথবা চাপা দেয়া হয় । যেমন শাহ মোহাম্মদ সগীর পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইউসুফ জুলেখা লিখেছেন। ইউসুফ জুলেখা অনেকেই লিখেছেন। এরকম আমরা শুধু আলাওল বা দৌলত কাজীর কথা জানি। তাঁরা সপ্তদশ শতাব্দীর লোক। কিন্তু তাদের আগেও তিনশ বছর ধরে এখানে বাংলায় মুসলমানরা অনেক ধর্মীয় উপাখ্যান থেকে বেরিয়ে এসে প্রণয় উপাখ্যান  লিখেছেন। যেমন ইউসুফ জুলেখার কাহিনী । এটা প্রণয় উপাখ্যানও আবার এতে সেমিটিক ধর্মীয় ঐতিহ্য রয়েছে। আমরা যতটুকু জানি যে, বৌদ্ধ ধর্মের ভেতর দিয়ে বাংলা সাহিত্যের বিকাশ হয়, যেমন চর্যাপদ । তারপর বাংলা সাহিত্য বিকাশে মুসলমানরাও অংশ গ্রহণ করেছেন । ঊনিশশ শতাব্দীতে আধুনিক বাংলা সাহিত্য বিকাশে খ্রিষ্টানরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন । যেমন বাইবেল অনুবাদ, উইলিয়াম কেরি ইত্যাদি। সেদিক দিয়ে দেখা যায় যে, বাংলা সাহিত্য নানা ঐতিহ্য দিয়ে তৈরী হয়েছে। প্রথমে বৌদ্ধ, তারপরে ব্রাম্মন ও মুসলমান পরবর্তীকালে খ্রিস্টান এবং অন্যদের উপাদান এতে আছে।
 
দুই:
তিনি বলেন, আজ যাদেরকে আমরা সম্প্রদায় বলি, এই সম্প্রদায় কথাটি তখন চালু ছিল না। এই সম্প্রদায়কে তখন জাতি বলা হতো। হিন্দুদের মধ্যে স্মার্থ, বৈষ্ণব এগুলো সম্প্রদায়। হিন্দু আর মুসলমানকে দুই সম্প্রদায় বলা হতো না। সেটা বলা হলেতো একটা জাতি থাকতে হবে। এগুলো আলাদাভাবে জাতি বলা হতো। আবার পুরনো বাংলা ভাষায় দেখবেন নারী জাতি, পুরুষ জাতি বলা হয়েছে। তাই জাতি একটা জটিল শব্দ। এখন আমরা বাঙালি জাতি বলছি তখন সেভাবে বলতো না। হিন্দু এবং মুসলমান যদি দুই জাতিও হয়ে থাকে, তাহলে তাদের বিকাশের মাত্রা সমান ছিল না। ভুলভাবে হলেও মনে করা হতো মুসলমানরা শাসক জাতি ছিল ৭০০ বছর। যেভাবেই হোক মোঘল সম্রাটদের সাথে আমাকে এক করে দেখা হতো। আমিতো বাংলার প্রজা। সেই হিসাবে হিন্দু মুসলিমের মধ্যে বিকাশে একটা পার্থক্য দেখা গেছে। তবে মোঘল সময়ে কর্মক্ষেত্রে হিন্দু মুসলিম হিসেবে কোনো পার্থক্য ছিল না। যেমন মোঘল প্রশাসনে দেখা যাবে যত উচ্চ মঞ্চব্দার আছেন তাদের মধ্যে ইরানি, আফগানি, তুর্কী আছেন এবং ভারতীয় হিন্দু রাজপুতরাও সমানে সমানে আছেন। এই পার্থক্যটা ইংরেজ আমলে তৈরী হলো। ইংরেজ আমলে এই পার্থক্যের ফল হলো যে, অন্তত একশ পঞ্চাশ বছর এগিয়ে থাকলো যারা জমিদারি এবং ব্যবসার মধ্যে ছিল। এরাই হলো বাংলাদেশে নতুন গঠিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়। যারা পিছিয়ে ছিল তাদের বলা হয় মুসলিম সম্প্রদায়। তাদের মধ্যে আবার বাংলায় দুই ভাগ ছিল। উর্দু ভাষী মুসলিম এবং বাংলা ভাষী মুসলিম। এই যে ফরিদপুরের নবাব আব্দুল লতিফ যিনি বললেন যে, উচ্চ শ্রেণীর মুসলমানদের ভাষা হচ্ছে উর্দু আর নিম্ন শ্রেণীর মুসলমানদের ভাষা হচ্ছে বাংলা। সেটা কবে বলছেন? ১৮৮০'র দিকে। এই জন্য বলা যায় যে, সম্প্রদায়ের বিকাশে একটা পার্থক্য আছে । আইডিওলিজম বাদ দিয়ে বস্তুবাদী বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে যে অসম বিকাশ সেখান থেকে একটা দ্বন্দ্ব শুরু হলো। সেইজন্য ব্রিটিশরা ১৮৫৭ সনের বিদ্রোহের পরে এটাকেই মূলধন করলো।
 
ড. সলিমুল্লাহ খান বলেন, হিন্দু মুসলিমের মধ্যে যেহেতু পার্থক্যটা আছে এটাকে তারা এক্সপ্লয়েট করলো । তখন হিন্দুরা প্রথম স্বদেশী আন্দোলন শুরু করলো। তার দেখাদেখি মুসলমানরা শুরু করলো খেলাফত আন্দোলন । ঐ সময়টাতে ব্রিটিশরা পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করলো। ১৯১৯ সনের প্রথম নির্বাচনে পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা হলো। একে আমরা বলি সেপারেট ইলেক্টরেট। মুসলমানরা শুধু মুসলমান ক্যান্ডিডেটদের ভোট দিবে। অন্যরা সাধারণ যার নাম ছিল জেনারেল সিট। এই প্রস্তাবটা এসেছিলো ১৯০৯ সন থেকেই । ভারত শাসন আইনে প্রথম কার্যকরী হয় ১৯১৯ থেকে । এটাও আমাদের ইতিহাসের একমাত্র কাহিনী নয়। এটা ১৯৩৫ সনে চললো। ১৯৫২ সনের পর থেকেই পূর্ব বাংলার সমস্ত প্রগতিশীল দল আওয়ামী লীগসহ তারা দাবি করলো  যে, যৌথ নির্বাচন দিতে হবে। হিন্দু মুসলিম সবাই একসাথে এমপি নির্বাচিত করতে চাইলো । সেটাই সফল হতে হতে ১৯৫৪ পার হয়ে গেল। ১৯৫৪'র নির্বাচন পৃথক নির্বাচন হয়েছিল। ৭০ সনের নির্বাচনটা প্রথম যৌথভাবে হয়েছে ।
 
আমাদের দেশে ধর্ম নিরপেক্ষতার একটা ভুল ব্যাখ্যা দেয়া হয়। এক পক্ষ ব্যাখ্যা করছেন ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে নাস্তিকতা। তার থেকে মধ্যখানে আরেকটি ব্যাখ্যা দেয়া হয় ইহজাগতিকতা বলে। মানুষকে ফাঁকি দেয়ার কিছু নাই। আমাদের এখানে ধর্ম নিরপেক্ষতা কথাটা কিভাবে এসেছে সেটা বুঝতে হবে। ৫৪'র নির্বাচনের আগে শেরে বাংলা একে ফজলুল হক দাবি তুলছিলেন যে, আমরা এখন পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থাটা বাদ দেই হিন্দু মুসলমান একসাথে নির্বাচন করি। তখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, পাকিস্তান হওয়ার আগে আপনারাইতো পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘ঈসার দিনে ঈসা আর মুসার দিনে মুসা।  তখন অবহেলিত বঞ্চিত পশ্চাদপদ মুসলমানের জন্য এটা দরকার ছিল। আমরা যখন এক হয়ে গিয়েছি। পাকিস্তানের সাথে লড়তে হবে এখন আমাদের ঐক্য দরকার।‘ হিন্দু মুসলিমসহ সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে স্বাধীনতার জন্য লড়েছে এবং পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা বাদ দিয়ে যৌথ নির্বাচন প্রথা চালু করেছে। ধর্মের বৈচিত্রের মধ্যেই আমাদের ঐক্য । এটা হচ্ছে আমাদের ধর্ম নিরপেক্ষতার সারকথা। ফ্রাগমেটিক কথা।
 
তিন:
সলিমুল্লাহ খান বলেন, রাজা রামমোহন রায়, ঈশরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অনেকের কথা আমরা জানি। আমাদের সমাজের দুঃখ্য হচ্ছে ঊনিশশ শতকে রাজা রামমোহনের শিষ্যদের মধ্যে একজনও অবর্ণ হিন্দু পাবেন না। মানে তফসিলী হিন্দু পাবেন না। কারণটা কি? এটা ছিল উচ্চবর্ণ সমাজের নবজাগরণ। শুধু হিন্দু মুসলমান বলছি না, হিন্দুবর্ণ সমাজের মধ্যে উচ্চ বর্ণের। কিন্তু মুসলিম সমাজে এরকম কোনো নেতার উদ্ভব হয়নি কেন? লেখক কিছু উদ্ভব হয়েছে। যেমন রূপ জালাল যিনি লিখেছেন বেগম নবাব ফয়জুন্নেছা, তিনি লাকসামের মানুষ। তিনি বঙ্কিমের চেয়ে চার বছরের বড়, বেগম রোকেয়ার জন্মের চার বছর আগে তাঁর রূপ জালাল বই বের হয়েছে। ওই রকম বই হিন্দুরাও লিখতে পারে নাই। এটার কথা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে পাবেন না। তিনি মীর মোশাররফ হোসেনের সিনিয়র, বঙ্কিমের সিনিয়র। বাঙালি মুসলমানরা বাঙলা লিখতো না, কথাটা ঠিক নয়। কথায় আছে, দশচক্রে ভগবান ভূত। প্রচার হয়েছে বাঙালি মুসলমানরা বাংলা ভাষাকে ঘৃণা করেছে। আসল সত্য হলো মুসলমানরা বাংলা ভাষাকে ঘৃণা করে নাই। বাঙালি মুসলমান বাংলাই বলতো সবসময়। কিন্তু কিছু কিছু নেতা নবাব আব্দুল লতিফ, সৈয়দ আমির আলী, হোসেন শহীদ সরওয়ার্দী এরা উর্দুভাষী ছিলেন। সমাজের রূপান্তর বুঝার জন্য এই দ্বন্দগুলি জানতে হবে।
 
তিনি বলেন, মুসলমান হওয়ার জন্য বাঙালিত্ব বাদ দেয়ার দরকার নাই। আবার বাঙালি হওয়ার জন্য মুসলমানিত্বও বাদ দেয়ার দরকার নাই । অন্যদিকে বাংলার সংস্কৃতি আর বাঙালি সংস্কৃতির মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। অনেক বাঙালি এটা বুঝতে পারে না। বাংলার সংস্কৃতি মানে বাংলাদেশে যে গাঢ়, হাজং, মগ, মুরং, চাকমা, সাঁওতাল আছে তাদেরকে বাদ দিয়ে নয়। ৭২ সনে আহমদ ছফা লিখেছেন, আমাদের শুধু হিন্দু মুসলমান সম্প্রীতি দিয়ে বাংলাদেশ ঘটতো না। আমাদের মধ্যে যারা অবাঙালি বলে এমনকি যারা উর্দুভাষী এদেশে থেকে যাবেন তাদেরকেও সম্পূর্ণ মানবিক মর্যাদা দিয়ে রাখতে হবে।  তাই বলা যায়, আহমদ ছফার মতো একটা লোকের দৃষ্টিভঙ্গি যদি বাংলাদেশ অনুসরণ করতো বাংলাদেশে এখন যে দূরাবস্থা হয়েছে তা হতো না।
 
চার:
সলিমুল্লাহ খান বলেন, বাংলাদেশের অনেক কিছু বাংলাদেশের একার উপর নির্ভর করে না। পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের ঘটনাবলি এখানে একটা প্রভাব তৈরী করে, এটা অস্বীকার করা যাবে না। অপরাধ যা হচ্ছে এটা সংঘটিত। এটার একটা বৈশ্বিক মাত্রা আছে। বৈশ্বিক মাত্রাটা কি? ব্রিটিশ আমলে চিরকাল ডিভাইড এন্ড রুলের শিকার হয়েছি আমরা । হিন্দু মুসলিম দ্বন্ধকে কেন্দ্র করে তারা তাদের প্রশাসনকে ক্রমশ বিলম্বিত করে করে ৪৭ সন পর্যন্ত এখানে শাসন করেছে। ৪৭ সনে এখানে দেশভাগ কেন মেনে নিলেন? ভারতের বিখ্যাত ইতিহাসবিদ দীপান চন্দ্র বলছেন শুধুমাত্র রক্তপাত এড়াবার জন্য কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ (তারা বলেন ইন্ডিয়ান ন্যাশনালিস্ট) এই দেশভাগের সিদ্বান্তটা মেনে নিয়েছেন। কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়। দেশভাগের পর রক্তপাত কমেনি বরং ক্ষেত্রবিশেষে বেড়েছে। বাংলাদেশের উদাহরণ যদি ভারতীয়রা অনুসরণ করে তাহলে ভারতে আরো কয়েকটি অংশ স্বাধীন হয়ে যেত । সেখানে অনেক ঘটনার ব্যালেন্স আছে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব বাড়ছে। ওখানে যখন ধর্মের প্রভাব বাড়ে, বিজেপিকরণ বাড়ে তখন এর একটা প্রভাব এদেশেও এসে পরে । ভারতের প্রধানমন্ত্রী এখানে আসবেন তিনি বিভিন্ন মন্দিরে যাবেন।  এটা পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই হচ্ছে এখানে। এজন্য বলছি বাংলাদেশে কি হবে এটা শুধু বাংলাদেশের মধ্যেই নির্ধারিত হয় না।
 
অপরাধের একটা এজেন্ট আছে যাদেরকে আমরা অপরাধী বলি। অপরাধের কিছু সহযোগী একম্প্লিস আছে । ভারতে যা ঘটে তার প্রভাব বাংলাদেশে হয়। যেমন বাবরি মসজিদের ঘটনা আমরা জানি। তাসলিমা নাসরিনের বই ভারতে লক্ষ্য লক্ষ্য কপি অনুবাদ হলো কেন? বাংলাদেশে তাসলিমা নাসরিন তার লজ্জা বা অন্যান্য বইয়ে যে অভিযোগটা করেছেন সেগুলো ভারতে উড়িষ্যার মুখ্যমন্ত্রী নন্দিনী সতপতির মতো বিদূষী মহিলাও অনুবাদ করেছেন। এটা বিজেপি লক্ষ লক্ষ কপি ফ্রি বিলি করেছে। ভারতের যেকোন জায়গায় আপনি ইংরেজি ও হিন্দিতে লজ্জা দেখতে পাবেন। কারণটা কি? কারণ আছে। বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতন এটা প্রচার হলে ভারতে মুসলিম নির্যাতন সহনীয় হয়ে উঠে। এইজন্য বলছি ভারতে যা ঘটে তার একটা স্লীপ ওভার ইফেক্ট এসে পরে বাংলাদেশে । সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের ক্ষেত্রে এটাও একটা কারণ। আমি বলবো বৈশ্বিক ঘটনা বা ভারতের ঘটনা প্রধান ব্যাপার নয়। প্রধান ব্যাপার আমাদের। আমরা যদি হাজার বছরের সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে থাকি তাহলে এতগুলো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এখানে হলো কেন? সাহিত্যের মধ্যেও এর প্রকাশ ঘটে কেন? এইজন্য বলি আমাদের এসব অঞ্চলে সবসময় সাপ্রদায়ক দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছে। তবে স্বতঃস্পুর্ত দাঙ্গা হয় নাই। পূর্ব বাংলা সেদিক থেকে অনেক ভাল। ১৯৪৬ সনে নোয়াখালীতে যে দাঙ্গা হয়েছিল, তাতে সর্বোচ্চ ৩০০ লোক মারা গিয়েছিল। মহাত্মা গান্ধী যেখানে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু কলকাতাতে কতলোক মারা গিয়েছিল এবং বিহারে কত মারা গিয়েছিল? যেখান থেকে আমরা বিহারি সমস্যা পেয়েছি । এই কথাগুলো বাদ দিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার কথা ব্যাখ্যা করা যাবে না।
 
তিনি বলেন, একাত্তরে আমাদের অঙ্গীকার ছিল যে, আমরা পৃথক নির্বাচন থেকে যৌথ নির্বাচনে যাব। সত্তরের নির্বাচন প্রথম যৌথ নির্বাচন হয়। আইয়ুব খান এটা মেনে নিয়েছিলেন। তারপর সত্তরে এটা বাস্তবায়ন হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা একটা দেশ স্বাধীন করেছিলাম যেখানে কোনো বিভেদ থাকবে না। এই বিভেদ এখন বাড়াবার চেষ্টা হচ্ছে । এটা আশ্চর্যের ব্যাপার। ধর্মের কারণে কারো উপর আক্রমণ হবে, বাংলাদেশে এটা অভূতপূর্ব ঘটনা। এরকম ঘটনা আগে ঘটেনি। আগে যেরকম ঘটতো যেমন মসজিদের সামনে বাজনা বাঝানো, গরু কাটা নিয়ে। সেগুলো সংঘটিত আন্দোলন ছিল। গো-রক্ষিণী সভা, ইংরেজের প্রেরণায় ১৮৮০ দশক থেকে ভারতে ঘটিত হয়েছিল। তার থেকে আন্দোলন শুরু হয়েছিল। এখনো ভারতে সেটি হচ্ছে। আমাদের দৃষ্টিকে একটু প্রসারিত করতে হবে। ভারত এবং বাংলাদেশ প্রতিবেশী এবং ঘনিষ্ট রাষ্ট্র। কিন্তু আমাদেরকে যে মানুষ হিসেবে ভারত ট্রিট করে না এটা বলার সাহস হচ্ছে না কেন?  আমরা এখন নিউ কলোনিয়ালের যুগে আছি। এটা অস্বীকার করার উপায় নাই। কিন্তু মনে রাখতে হবে আমরা লড়াই করে স্বাধীন হয়েছি, রক্ত দিয়ে স্বাধীন হয়েছি। এখানে অনেক ষড়যন্ত্র হচ্ছে এবং হবে এটা হয়তো বন্ধ রাখা যাবে না। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে আমাদের আশপাশে যা ঘটে সবটাই আমাদের প্রভাব বিস্তার করে এবং ভারতীয়রা যেভাবে নিউ কলোনিয়াল ওয়েতে আমাদের ট্রিট করছে, আমাদের বাজারে বলেন, আকাশ সংস্কৃতিতে বলেন, সীমান্তে বলেন স্বাধীন দেশ হিসেবে এটা কেউ কারো সাথে করে না।
 
পাঁচ:
সলিমুল্লাহ খান বলেন, আহমদ ছফার স্টার্টিং পয়েন্ট থেকে আমরা যদি বুঝি তাহলে গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে কি হয়েছে তার কিছুটা পরিমাপ করা যাবে । এটাকে বলে পয়েন্ট জিরো। ৭২ সনে আমরা বলবো ইংরেজিতে যদি বলি উই স্টার্টেড ভেরি ব্যাডলি। আজ ৫০ বছরে বাংলাদেশ কতটুকু ম্যাচুর হয়েছে এ কথা বুঝার জন্য বলছি, অনেকে বলছেন আমরা অর্থনীতিতে এই অগ্রগতি সেই অগ্রগতি অর্জন করেছি। প্রাক্তন পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ সাহেব কয়েকদিন আগে একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন শার্ট বেছে, জামা বেছে কোন দেশ শিল্পায়িত দেশ হয় না। শিল্পায়নের মূল কথা হচ্ছে তার অর্থনীতির দুই তিন শাখার মধ্যে পরস্পর নির্ভরতা থাকতে হবে। অর্থাৎ ডাইভারসিটি থাকতে হবে। আমরা যে মনোক্রপ অর্থনীতির মতো মনোপ্রডাক্ট অর্থনীতি করে বসেছি। মোট রপ্তানি আয়ের শতকরা ৭৫ থেকে ৮০ ভাগ একটিমাত্র শিল্প থেকে আসে। এটা নিয়ে দেশ উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে এটা স্রেফ মানুষকে ফাঁকি দেয়া।
 
 
এই যে অনেকগুলো কথা জনগণকে বলা হচ্ছে, আমি মেনে নিচ্ছি তথ্য নিয়ে তর্ক করবো না। তবে কোন ধরণের উন্নতি হচ্ছে তা নিশ্চয় আলোচনা করা অন্যায় হবে না। দেখবেন যে, এটা হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারের উপর নির্ভরশীল ইউরোপ আমেরিকাতে শার্ট বেছার উপর নির্ভরশীল অর্থনীতি। তাতে যে পরিমান কর্মসংস্থান হচ্ছে, আমাদের বলা হচ্ছে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের বিস্ময়। নিউ ইয়র্ক টাইমস প্রবন্ধ লিখছে - আমরা সব বিমোহিত হচ্ছি। কিন্তু তলায় কি? তলায় হচ্ছে মানুষের কাজ। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, তলায় যেটা লক্ষ্য করার বিষয় আমাদের লেখাপড়ার কি হচ্ছে? যেটাকে আমরা কোয়ালিটি বলি। সবাই বলছেন আমাদের লেখাপড়ার বিস্তার হয়েছে। অনেকে বলছেন বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার যথেষ্ট প্রসার হয়েছে । এখন গুনগত উন্নতি করা দরকার। অনেকে আবার প্রবন্ধ লিখে বলছেন শিক্ষার গুনগত মান বৃদ্ধি করা দরকার। শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি করলে নাকি গুনগত মান বেড়ে যাবে। এটার ভালমন্দ বিচার করার আগে বলছি, আমরা কোথা থেকে কোথায় এলাম। শিক্ষার পরিমাণগত বৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে, তাহলে প্রশ্ন হলো নিরক্ষরতা কি দূর হয়েছে? বলা হয় শতকরা ৭৪ জন স্বাক্ষর দিতে পারছে। তাহলে বাকি ২৬ জন কি অপরাধ করেছে। গুনগত যে মানের কথা বলা হচ্ছে তা খারাপ হচ্ছে কেন? একটা দেশের মানুষের শিক্ষা ব্যবস্থা ও নৈতিকতা যদি এতো অধোগতি হয় তাহলে কিছু প্রশ্ন রয়ে যায়। এতো উন্নতির যে কথা বলা হচ্ছে; লেখাপড়ার মধ্যে এবং অর্থনীতির মধ্যে যদি এতো ফারাক হয়, তাহলে কোথায় যেন গরমিল রয়েছে।
তিনি বলেন, অনেকেই বলে থাকেন বাংলাদেশ দেশটি নতুন। পাকিস্তান হবার পর অনেকে বলতো পাকিস্তান একটি শিশু রাষ্ট্র। তাহলে বাংলাদেশ কি রাষ্ট্র হয়েছে এখন? কিশোর রাষ্ট্র! যুবক রাষ্ট্র! বাংলাদেশতো মনে হয় এখন মাদক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। যে বয়সে বাচ্চারা মাদক গ্রহণ করে, ৫০ বছরে এসে আমরা মাদকসেবী হয়ে গেলাম! অনেকে বলেন আমাদের শিল্পায়ন দূরের কথা মাদকায়ন হয়েছে। আমাদের প্রাণপনে জিজ্ঞাসা করা উচিত এই রূপান্তরটা হলো কি করে? যে দেশ জন্মে বলেছিলো আমরা সাম্য বা সমাজতন্ত্র করবো। বুঝে বলি বা না বুঝে বলি, জাতীয় প্রয়োজনে বলি বা আন্তর্জাতিক চাপেই বলি। একটা শব্দতো উচ্চারণ করেছিলাম। সেটা আজকে কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
 
ছয়:
ভারত বহু ধর্মের, বহু ভাষার, বহু নৃতাত্বিক গোষ্ঠীর মহাদেশ। সেখানে বাংলাদেশ যে রাষ্ট্রের কাঠামো হয়েছে - দুই পর্যায়ে, ৪৭ সনে একবার ভারত ভাগ করে পাকিস্তানের অংশ হয়েছি আমরা। এটা ইতিহাসের খাতিরে স্বীকার করতে হবে। আহমদ ছফা বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস বইয়ে এই কথাগুলো ভ্রুন আকারে তুলেছেন যে, বাংলাদেশ হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার আধুনিকতম রাষ্ট্র। কোন অর্থে আধুনিক? এটা ভারত উপমহাদেশের প্রধান যে সমস্যা, যে কারণে ৪৭ সনে দেশ ভাগ হয়েছিল, যে কারণে পাকিস্তানের সাথে লড়াই করে রক্তের বিনিময়ে, রক্ত দিয়ে চিন্তা করে আমাদের স্বাধীন হতে হয়েছে । এটা হলো দি ন্যাশনাল কোয়েস্টন।
 
ইংরেজ গভর্ণর স্যার ফ্রেডারিক বারুজের ভাষায় পূর্ব বাংলা ছিল নিছক একটা রুরাল স্ল্যাম। একটিও পাটকল ছিল না পূর্ব বাংলায়। সব পাটকল ছিল কলকাতায়। দু'একটা গ্লাস ফ্যাক্টরি আর তাড়ি বানানোর দোকান ছাড়া এখানে উল্লেখযোগ্য কোনো ইন্ডাস্ট্রি ছিল না। ১৯৪১ সনের আদম শুমারি অনুসারে জনসংখ্যার স্বাক্ষরের সংখ্যা ছিল শতকরা ৬ জন। এই যে পশ্চাদপদ একটি দেশ, তারা মনে করেছিল আমরা থাকতে পারবো না।  নেহেরু ১৯৬২ সালেও চিঠি লিখেছেন ওরা থাকতে পারবে না। ওরা চলে আসবে। কিন্তু কি অদ্ভূত রসায়নে আঙ্গুর যেমন মদ হয়ে যায়, তো আমরা একটা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে এখনো ঠিকে গেলাম। কিন্তু মনে রাখবেন আমাদের ঠিকে থাকাটা গ্যারান্টেড নয়। পৃথিবীর কেউ আপনার ইন্সুরেন্স বীমা করে নাই যে, আপনি এক হাজার বছর ঠিকে থাকবেন। রাষ্ট্র অতীতে পরিবর্তিত হয়েছে। হাজার বছর ধরে ভারত উপমহাদেশে কত রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে। বাংলা, বিহার উড়িষ্যা এক দেশই ছিল। গৌতম বৌদ্ধ যেখানে জন্মেছিলেন ওটা বৃহত্তর বাংলার অংশ ছিল। সম্রাট অশোক যেখান থেকে শাসন করতেন ভারতের সেই রাজ্য কিন্তু বাংলার অংশ ছিল। দীনেশ চন্দ্র সেন বৃহৎ বঙ্গ বইতে এসব নিয়ে অনেক ভাল লিখেছেন। আহমদ ছফা দীনেশ চন্দ্র সেনের একজন ভক্ত ছিলেন। তাই আহমদ ছফার চিন্তারও একটা সূত্র অর্থাৎ জিনিওলোজি আছে। এটা শুদ্ধ না অশুদ্ধ আলোচনা না করলে আমরা বুঝবো কি করে? আজ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিদায়ের একটা দিন আমরা উদযাপন করতে পারি না কেন?  আমরা যদি বলি ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ নিয়ে একটু আলোচনা করো, মীর নেসার আলী ওরপে তিতুমীর ফরায়েজী আন্দোলন বলে জাতীয় ক্যালেন্ডারে একটি জায়গা দাও । তাদের নামে শুধু একটা হল করে রাখলে দায় কি পুরিয়ে যায়? তখন তারা চুপ করে থাকে। যে দেশে কোনো আলোচনাই করা যায় না। সেদেশে মুক্তি কি করে হবে?
 
সলিমুল্লাহ খান তাঁর আলোচনায় বলেন, ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হয়েছে। কিন্তু তার সীমান্ত নির্ধারিত হয়েছে সেই ৪৭ সনের ১৪/১৫ আগস্ট। এর আগের বছরের ভোট যদি না হতো তাহলে আসাম থেকে করিমগঞ্জ বাদ দিয়ে সিলেট সাব ডিভিশন পাকিস্তানে আসতো না। ভারত মহাদেশে জাতি সমস্যার যে অসমাপ্ত সমস্যা, সেটার একটা সমাধান বাংলাদেশ দেখিয়েছে । এটা আহমদ ছফার একটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। আহমদ ছফার যেকোন লেখাতে এসেছে যে, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে আধুনিকতম রাষ্ট্র। এই দেশ আমাদেরকে আরো নৈতিকভাবে নেতৃত্ব দিতে পারতো। এজন্যই বাংলাদেশে গণতন্ত্র দরকার। এজন্যই বাংলাদেশে ধর্মীয় বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য খোঁজতে হবে। এটাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। সাম্রাজ্যবাদীরা যে ভুল করেছে, সে ভুল করা যাবে না।
 
দেশের যে পরিবর্তন হয়েছে অনেকে বলেন বর্তমানে বিদ্যমান রোগের সমাধান কি? আহমদ ছফা বলেছেন, যখন আমরা বিরক্ত হই সমাজের উপর তখন আমরা পেছনে ফিরে যাবো না, সামনে যাবো? সামনে যাওয়াটা কঠিন। কিন্তু পেছনে যাওয়াটা সহজ। আমাদের মানুষজন ধার্মিক। তাই ধর্মকে বাদ দেয়ার চেষ্টা করাও ভুল। পাকিস্তান আমলে শাসকরা ধর্মকে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরার হাতিয়ার হিসেবে যেভাবে ব্যবহার করেছেন সেভাবে ব্যবহার করার চেষ্টাকে আহমদ ছফা বলেছেন প্রতিক্রিয়াশীলতা। তাই এই দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উদাহরণ এবং ধর্মীয় বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করতে পারলে এটা অন্যান্য বড় দেশগুলো অনুসরণ করতে বাধ্য হবে।
 
সাত:
তিনি বলেন, ইংরেজি ভাষার প্রতি কোনো বিরোধ নাই। কিন্তু বাংলা ভাষায় যদি সাহিত্য তৈরী না হয়, তাহলে প্রাণ আসবে কোথা থেকে। বাংলা ভাষা অরক্ষিত হয়েছে অযোগ্যদের হাতে। সমাজের সর্বত্র যে, দুর্নীতির সর্বগ্রাসী বিচরণ এটি তার প্রমাণ। আহমদ ছফা লিখেছেন, ‘ফরাসি লেখক আলফাস দোদের একটি গল্পের কথা মনে পড়ছে। ফরাসিরা যুদ্ধে মার খেয়েছে, গল্পের নায়ক খুবই আশাহত হয়ে পড়েছে, আরেকজন তাঁকে উপদেশ দিচ্ছে ফরাসি সাহিত্য পড়ার। তার মানে ফরাসি সাহিত্যের মধ্যে এমন কিছু প্রাণদায়িনী উপকরণ রয়েছে, যার প্রভাবে নায়ক যুদ্ধে পরাজয়ের হতাশা কাটিয়ে উঠতে পারবে। পুরোপুরি না হোক, আংশিকভাবেও যদি আমাদের জাতি এই মনোভাব আয়ত্ত করতে না পারে, তাহলে বলতে হয় আমাদের বর্বর-দশা এখনো কাটেনি।‘
 
আহমদ ছফা ১৯৯৭ সনে বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস বইয়ের প্রথম প্রকাশের ২৫ বছর পর যে ভূমিকা লিখেন; সেখানে তিনি বলেন কি করে বাংলাদেশের এতো পরিবর্তন হলো? আহমদ ছফার বক্তব্য হলো ‘বাংলাদেশের সমাজটি হাজার বছরের, কিন্তু রাষ্ট্রটি ২৫ বছরের (১৯৯৭ সনে বলেছেন) । তাই দুটিকে গুলিয়ে ফেলা যাবে না। আহমদ ছফা বলেছেন, ‘বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির বয়স পঁচিশ বছর (১৯৯৭ সনে লিখেছেন) কিন্তু বাংলাদেশি সমাজের বয়স হাজার বছর। সামাজিক সংকটগুলো সামাজিকভাবেই আমাদের সমাধান করতে হবে। সমাজের সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর বিবেকবান দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষদের একটা সত্য অনুধাবন করার সময় এসেছে, আমাদের সকলকে দেশে পাশাপাশি বসবাস করতে হবে। ভালবাসা দিয়ে এবং ভালবাসা পেয়ে বেঁচে থাকার একটা মিলিত কৌশল আমাদেরই উদ্ভাবন করতে হবে। অবশ্যই সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের দায়দায়িত্ব এতে অনেক বেশি।‘
ড. সলিমুল্লাহ খান বলেন, আহমদ ছফা রাজনীতির একটা সংজ্ঞা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, মানুষকে ভালবাসা দিয়ে এবং ভালোবাসা পেয়ে একসাথে থাকার নামই রাজনীতি। আজকে সেখান থেকে কত দূরে চলে গেছি আমরা । আমাদের দেশের রাজনীতিতে পরস্পরকে শত্রু বা জানের দুশমন মনে করা হচ্ছে। এর চেয়ে দূর্ভাগ্যজনক আর কিছু হতে পারে না। বাংলাদেশে আহমদ ছফার নীতি ফলো করা হলে অনেক কিছু এগিয়ে নেয়া যেতো। আহমদ ছফা ছিলেন আসলেই মহাজাগতিক চিন্তাবিদ। চিন্তার সূত্রপাত তিনি করেন।
 
অনুলিখন: ড. এম মুজিবুর রহমান
লন্ডন প্রবাসী। সাবেক সহকারী অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status