বই থেকে নেয়া

পিএইচডির গল্প (২)

আল্লাহর ফয়সালা ছিল অন্যরকম

আসিফ নজরুল

২৬ মার্চ ২০২১, শুক্রবার, ১০:২১ পূর্বাহ্ন

আমি ছিলাম দরিদ্র পরিবারের সন্তান। অথচ ততোটা দরিদ্র হওয়ার কথা ছিল না আমাদের। বাবা বাংলাদেশ বেতারে প্রকৌশলী হিসেবে চাকরি করতেন। গর্ব করে নিজেকে বলতেন ফার্স্ট ক্লাস গেজেটেড অফিসার। তবু আমরা দরিদ্র জীবন যাপন করতাম বাবার অতি মিতব্যয়ী ও ভীতু স্বভাবের কারণে। সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তিনি টাকা জমা রাখতেন। সামান্য টাকায় চলতো ছয় ভাইবোন সহ আমাদের আটজনের পরিবার।
এমন একটা পরিবারেও ছিল নানা বৈষম্য। বড় ভাই অসাধারণ মেধাবী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সেজন্য তার ছিল ভিআইপি ধরনের মর্যাদা। সে আমার মায়ের অতিপ্রিয়, আর ছোটভাই বাবার। মেঝ বোন দেখতে দাদীর মতো, এজন্য বাবার কাছে ছিল তার স্পেশাল কদর। ছোট বোন আজন্ম অসুস্থ, তার স্থান ছিল তাই আলাদা। কুতকুতে চোখ, উঁচু হাড়ের গাল, বাটকু আর শীর্ণদেহী আমি ছিলাম মেঝ ছেলে। ভীতু, অন্তর্মুখী, নির্বিরোধী, অনুজ্জ্বল।
ক্লাস নাইনে ওঠার পর সেই আমিই নিজে উপার্জন করা শুরু করি। সারা বছর তখন মাত্র একটা ভালো কাপড় পেতাম, সেটা রোজার ঈদে। বেলবটমের যুগ বলে এক ঈদে খুব ঢোলা বেলবেটম পেলাম। বাটকু শরীরে প্রায় বুকের কাছে বেলবেটম পড়ে বের হলাম গলিতে। আমাকে দেখে চারিদিকে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। একে একে বহু ছেলেমেয়ে হাজির হলো।
বেলবটম প্যান্ট নিম্নমানের কাপড়ের বলে সেখানে কিরিচ বা ভাঁজ পড়েনি। ফলে তা ফুলে একদম গোল হয়ে আছে। বেশি চাল্লু ছিল যে ছেলেগুলো, তারা সেটা ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে, আর ‘প্যান্ট পরছস না লুঙ্গি’ বলে হাসাহাসি করে। মন খারাপ করে বাসায় ফিরলাম। কাপড় বদলে আগের বছরের হাফ-প্যান্ট পরলাম। একটু পর আব্বা এসে ধিক্কার দিলেন আমাকে। পরিষ্কার বাক্য তার, আজো মনে আছে। ‘নিজে কামাই কর, তারপর ফুটানগিরি করো।’
এঘটনার কয়েক মাস পর ‘কামাই’ করার সুযোগ এলো।  ভালো ছাত্র হিসেবে পোস্তার ডাকঘরের গলিতে আমার নাম ছিল। সেখানে বড়লোক মামার ভাড়াটে থাকতো আমাদের দুটো বাড়ির পাশে। বিউটি নামের তার ক্লাস ফাইভের কন্যাকে পড়ানো শুরু করলাম। বিউটি ছয় ভাইয়ের ছোট বোন। সেই ছয় ভাইয়ের তিনজন আমার খেলার সঙ্গী। তাছাড়া বিউটির মা আমার মা-এর খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তাকে পড়ানোর জন্য কতো টাকা পাবো বা আদৌ পাবো কিনা তা নিয়ে সন্দেহ ছিল। কিন্তু মাস শেষ হওয়ার সাথে সাথেই টাকা পেলাম। পঞ্চাশ টাকা, এখনকার হিসেবে প্রায় ১ হাজার টাকা। ১৯৭৮ সালের পঞ্চাশ টাকা আমার জন্য যথেষ্ট ছিল। সেদিন থেকে জীবনে কখনো আমি বাসা থেকে টাকা নেইনি। পড়েছি বিনা বেতনে স্কুলে, ঢাকা কলেজেও। টিউশনির টাকা পেতাম, স্কলারশিপের টাকাও পেতাম পরে।
পড়ানো আমার জন্য আশীর্বাদ ছিল আরেকটি বড় কারণে। পড়ানো হলে পড়তে হয়। যতো একঘেয়ে, দুর্বোধ্য আর নিরস হোক বিদ্যশিক্ষা করার একটা মন গড়ে ওঠে। ক্লাস নাইনে ওঠার পর থেকে আমাকে কেউ পড়াতো না, কেউ আমাকে পড়তেও বলতো না। কিন্তু একটা শিক্ষা মনে গেঁথে গিয়েছিল। আমরা সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম নেয়া মানুষ না। আমাদের মতো দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের পড়তে হবে। টিকে থাকতে হলে, সম্মান নিয়ে বাঁচতে হলে পড়তে হবে, ভালো রেজাল্ট করতে হবে।


 লেখাপড়ার পেছনে আরেকটা তাড়না ছিল আমার আম্মা। তিনি পুরানো ঢাকার এক রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে। পড়াশোনা করতে ভালোবাসতেন। কিন্তু ধর্মীয় অজুহাত দেখিয়ে ক্লাস ফাইভ পাস করার পর তার পড়াশোনা বন্ধ করে দেয়া হয়। কয়েক বছর পর বড়লোক এক ব্যবসায়ীর (আমার খালুর ভাই) সাথে তার বিয়ে ঠিক হলো। কিন্তু তিনি প্রতিজ্ঞা করেন শিক্ষিত কাউকে ছাড়া বিয়ে করবেন না। জেদ করে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিলেন। বিয়ে ভেঙে গেল, খালুর চক্ষুশূলে পরিণত হলেন তিনি।
তাকে বোঝানোর চেষ্টা করা হলো। তিনি মুখ গোমড়া করে রইলেন। অবশেষে মাসখানেক পর আরেকজন পাত্রের খবর এলো। পাত্র কুমিল্লার হোমনা থানার মিঠাইভাঙ্গা গ্রামের, নাম মো. নূরুল ইসলাম। পাত্র হতদরিদ্র কৃষক পরিবারের, দেখতেও ভালো না তেমন। কিন্তু তিনি শিক্ষিত। আম্মার মামার বাসায় জায়গীর থেকে পড়াশোনা করছেন। কোন একটা স্কুলে শিক্ষকতাও করছেন তখন। শোনামাত্র রাজি হলেন আম্মা।  তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হলেও আব্বাকে মেনে নিলো নানার পরিবার।  
 ষোল বছর বয়সে এমন জেদ কেন করেছিলেন আম্মা? স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার গলিতে বসে কি স্বপ্ন দেখতেন তিনি? আম্মাকে জিজ্ঞেস করতাম। তিনি বলতেন, তার ছেলেমেয়েরা শিক্ষিত হবে শুধু এটাই ছিল তার স্বপ্ন। তার মেয়েরা পড়তে চাইলে কেউ বাধা দিবে না এটাই ছিল তার আশা। ছোটবেলায় তার পড়াশোনা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল এটা বলতে বলতে বৃদ্ধ বয়সেও তিনি কেঁদে বুক ভাসাতেন।
আমার বোনরা পড়াশোনা করেছিলেন। বাধা দেয়া দূরের কথা, আব্বা নিজেই বরং তাদের পড়াতেন। তারা তেমন মেধাবী ছিলেন না। তবু দুজনই কষ্ট করে স্নাতক পাস করেছেন। বোনদের মধ্যে প্রখর মেধাবী ছিল সবার ছোটবোন লিলি। ভাইবোনরা সবাই প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতাম তাকে। সে জন্মেছিলো হৃদপিন্ডে অনেকগুলো ফুটো নিয়ে। ডাক্তার বললো অপারেশন করলে ঝুঁকি আছে। তবু সে অপারেশন করতে চাইলো। সাড়ে দশ বছরের মেয়ের জেদ, ধুঁকে ধুঁকে বাঁচতে চায় না সে। তার ওপেন হার্ট সার্জারি হলো ১৯৮৪ সালের অক্টোবরে। করলেন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে কয়েক মাসের জন্য আসা জাপানি ডাক্তার। অপারেশন সাকসেসফুল!
প্রশান্ত মনে আমরা টেলিভিশনে একদিন সকাল-সন্ধ্যা সিরিজ নাটক দেখছি। হঠাৎ শুনি তার অবস্থা খারাপ। বড় বোন আর আম্মা দিনরাত হাসপাতালে থাকতেন। এবার বাসা তালা দিয়ে আমরা সবাই গেলাম। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের বেঞ্চে কাটলো কয়েকটা দিন। অপারেশনে যাওয়ার আগে করিডোর ধরে হেঁটে গিয়েছিল আমার ছোট বোনটা। সেই শূন্য করিডোরে তাকে খুঁজি বারবার। তিনদিন পর নিষ্প্রাণ তাকে আইসিইউ থেকে বের করে আবার রাখা হলো সেখানে। ১৯৮৪ সালের ২রা নভেম্বর সেদিন। আমরা নিয়ে এলাম তাকে। তার মৃত্যুসংবাদ বিশ্বাস হলো না আমাদের। সংসারে প্রথম মৃত্যু, সেটা কেন সবচেয়ে ছোট্ট, সবচেয়ে কোমল মানুষটার?  
তাকে সাদা একটা চাদরে ঠেকে রাখা হলো বাসার বারান্দায়। তার পাশে বসে রইলাম। ভেজা সেই চাদর জড়িয়ে রাতে ঘুমালাম। ভোররাতে দেখি আমাকে ডাকছে সে। বাইরে কুয়াশার আবছায়া, দূরে আজানের শব্দ, শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে আমার। আজিমপুরে এসে দেখি তার ছোট্ট কবর মেখে আছে ভোরের শিশির আর কোমল বাতাসে।
আমার বোনটা মারা যাওয়ার পর তার চিঠি পাওয়া যায় হাসপাতালের বিছানার নিচে । হয়তো খুব অপ্রাসঙ্গিক তা। তবু তার প্রথম অংশটা হুবহু তুলে দিচ্ছি এখানে।

আমি একটা মেয়ে। আমার নাম লিলি। আমার বয়স সাড়ে দশ বৎসর। আমার জীবনে কোন আনন্দ নেই। আমি মুখে প্রকাশ করি না, আমাকে দেখলে মনে হয় না আমার মনে অনেক দুঃখ। শুধু একটি কারণের জন্যই। আমার জন্ম থেকেই একটা মারাত্মক রোগ আছে। সেটা হলো হার্টের রোগ এবং এটা অপারেশন না করলে হয়তো আমি মরে যাবো, না হলে লেখাপড়া শিখতে পারবো না। এছাড়াও আমার মনে অনেক দুঃখ আছে। আমিও হয়তো জানি না আমার অপারেশন হলে আমি ভালো হবো কিনা। তবে আমার মনে একটা সান্ত¡না আছে আমার অসুখ সারবেই। না হলে আমার বেঁচে থেকে কি লাভ। এর চাইতে মরে যাওয়া অনেক অনেক ভাল- এটা ভেবেই আমি অপারেশন করতে রাজি আছি। যদি আল্লাহ আমার হায়াত দেন তাহলে আমি বাঁচবোই এবং ইনশাল্লাহ ভাল হয়েই বাঁচবো।

আমার বোনটা বাঁচেনি। আল্লাহর ফয়সালা ছিল অন্যরকম।

(আসিফ নজরুলের আলোচিত গ্রন্থ ‘পিএইচডির গল্প’ থেকে। এবারের বইমেলায় গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে বাতিঘর থেকে। তৃতীয় পর্ব আগামীকাল।)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status