বই থেকে নেয়া

সাহস হলো না লন্ডন যাবো এটা ভাবার

আসিফ নজরুল

২৫ মার্চ ২০২১, বৃহস্পতিবার, ১১:৫১ পূর্বাহ্ন

আমি এসএসসি পরীক্ষা দেই ১৯৮০ সালে। রেজাল্ট বের হলে আব্বা এসে জানালেন দ্বিতীয় বিভাগে পাস করেছি। খুব মন খারাপ করলাম। একটু বোধহয় কেঁদেছিলামও। স্কুলে প্রায় সব ক্লাশে ফার্ষ্ট হয়েছি। আমার স্কুল (ওয়েষ্ট এন্ড হাই স্কুল) তখন নামকরা স্কুল ছিল। অংকে জুনাইদ স্যার, ইংরেজীতে রশীদ স্যার আর বাংলায় আশরাফ স্যারসহ বহু খ্যাতিমান শিক্ষক ছিলেন সেখানে। সেখানকার ফার্ষ্ট বয় হয়ে কেন আমি দ্বিতীয় বিভাগ পাবো?
আমরা তখন থাকতাম পুরানো ঢাকার লালবাগে। নানার একটি একতলা বাড়িতে। আমার গৃহশিক্ষক ছিলেন আমার বড় ভাই। কি কারণে জানিনা, তাকে ডাকতাম ভাইসাব বলে। তিনি শিক্ষক হিসেবে নির্দয় প্রকৃতির ছিলেন। তার কাছে বসে ক্লাশ সিক্স থেকে আমাকে রাত দশটা পর্যন্ত পড়তে হতো। ঘুমে ঢলে পড়ে গেলে মার খেতাম, খারাপ রেজাল্ট করলে মার, পড়া না পারলে মার। কিন্তু আমার এসএসসি-র রেজাল্ট শুনে তিনি মারলেন না, তিরস্কারও করলেন না। তার বরং সন্দেহ হলো। আব্বা আমার রেজাল্ট জেনেছেন রাস্তায় একজন শিক্ষকের কাছ থেকে শুনে। তার মনে হলো আমার জন্য এই রেজাল্ট স্বাভাবিক। ফলে কষ্ট করে আর বোর্ড অফিসে গেলেন না জানতে।
আমার বড় ভাই গেলেন। বকশীবাজারের বোর্ড অফিস থেকে ফিরে এসে জানালেন, আমি আসলে প্রথম বিভাগ পেয়েছি। খুশী মনে ফুটবল খেলতে চলে গেলাম। বুড়িগঙ্গার বুক ঠেলে ওঠা কামরাঙ্গিচরে তখনো মানুষের বসতি শুরু হয়নি সেভাবে। সেখানে খেলতে খেলতে চরের বন্ধুদের রেজাল্ট জানালাম। পড়াশোনা নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই তাদের। ফলে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া হলো না।  
দু’দিন পরে ঘুরতে গেলাম পুরানো ঢাকায় আমলীগোলায় খালাম্মার বাসায়। সেখানে গেলে খালুর শিকার করা বকের মাংশ খাওয়া যায়, বড় বারান্দায় ফুটবল খেলা যায়, ক্যাসেট প্লেয়ারে বনিএম আর এ্যাবার গান শোনা যায়। কিন্তু সেদিন গিয়ে দেখি আমার আড়াই বছরের বড় খালাতো ভাই রেগে আছে আমার উপর। সে কয়েকবার ফেল করে ক্লাশ নাইনে পড়ছে তখনো, আর আমি ম্যাট্রিক পাস করে ফেললাম! এই ‘অপরাধে’ কুন্ঠিত হয়ে কিছুক্ষন এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ালাম। আমার সাথে খেলার মুড নেই তার। চলে আসবো যখন, দেখি বড়ঘরের খাটের উপর পুরানো পত্রিকা।
পেপারটা জুড়ে এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্টের খবর ছাপা হয়েছে। তখন বিজ্ঞান বিভাগে ২০ জন আর মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগে ১০ জন করে সেরা ছাত্রের তালিকা বের হতো। তাদের বলা হতো ষ্ট্যান্ড করা ছাত্র। আমি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছিলাম উদয়ন স্কুলে। পাশে সীট পড়েছিল তখনকার দেশসেরা বিদ্যালয় সরকারী ল্যাবরেটরী স্কুলের ছাত্রদের। ঠিক পাশে ছিল টিটু (এ.এইচ.এম. আহসান, এখন অতিরিক্ত সচিব) আর তার সামনে সুজা (কাজী শরীফ কায়কোবাদ, এখন মেজর জেনারেল)। তাদের জ্ঞানীভাব আর চালচলন দেখে তখনি মুগ্ধ হয়েছিলাম। মানবিক বিভাগের তালিকা খুজলাম তাদের নাম দেখার জন্য। যা ভেবেছিলাম তাই। ঢাকা বোর্ডে প্রায় চল্লিশ হাজার ছাত্রের মধ্যে সেরা দশে আছে তারা। টিটু চার নম্বরে, আর সুজা ঠিক তার পরে।
এমন সোনার টুকরো ছেলেদের পাশে বসে পরীক্ষা দিয়েছিলাম ভেবে পুলকিত হলাম। তালিকায় ল্যাবরেটরী স্কুলের আর কার নাম আছে দেখতে দেখতে দশ নম্বরে এসে চোখ আটকে গেল। মানবিক বিভাগে দশ নম্বর সেরা ছাত্রের নাম মো: নজরুল ইসলাম, স্কুল: ওয়েস্ট এ্যন্ড হাই স্কুল, রোল: ঢাকা ৩০৮২ ! আমার নাম, আমার স্কুল, রোল নম্বরটাও আমার। তাহলে এটা আমি!
বিমুঢ় হয়ে পত্রিকার তালিকাটা দেখি বারবার। এটা সত্যি কিনা কাউকে জিজ্ঞেস করা দরকার। মুখ তুলে দেখি খালাতো ভাই আগুন চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। স্কুল জীবনে খুব দুর্বলদেহী ছিলাম। টিফিন টাইমে কাছেই তাদের বাসায় গিয়ে ভাত খেয়ে আসতাম। আমাকে দেখলে খালাম্মা পড়াশোনা নিয়ে গঞ্জনা দিতো তাকে। রেগে গিয়ে সে একবার আমাকে মারতে মারতে স্কুল পর্যন্ত তাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল। ক্ষুধার যন্ত্রনায় কয়েকদিন পর সেখানে আবারো যাওয়া শুরু করি। সে চোখে পাকিয়ে তাকিয়েছিল। ভয়ে তার নামে কোন নালিশ দেইনি। সেও আমাকে এরপর আর ফুটবল খেলার সময় ছাড়া আর মারেনি। কিন্তু মনে হলো, আজ যদি রেজাল্টের কথা বলি তাহলে মেরে ভর্তা বানিয়ে ফেলবে।


মানে মানে কেটে পড়ি। আমলীগোলা থেকে আমাদের বাসা পোস্তা-য় (ওয়াটার ওয়ার্কস রোড) হেঁটে আসতে লাগতো আধাঘণ্টা। হেঁটে আসতে আসতে রাস্তার পাশের সাইনবোর্ড পড়তাম। কয়টা সাইনবোর্ড ‘সুনীল আর্ট’ আর কয়টা আলীজানের সেটা গুনতে গুনতে আসতাম। পানিফল নিয়ে পুরানো বাসার রকে বসা ফেরীওয়ালা, উকুন বাছতে থাকা মহিলা আর অলস মানুষের আড্ডা দেখতাম। লোভী চোখে তাকাতাম বেবী আইসক্রীমের গাড়ী, চটপটিওয়ালার দোকান আর ফুলে ফুলে ওঠা ‘গুলগুলা’ ভরা হোটেলের কড়াই-এর দিকে।
সেদিন আশেপাশে না তাকিয়ে উড়তে উড়তে পার হলাম কিল্লার মোড়, মোচর ঘুড়ে মজিদগঞ্জ তারপর শাহী মসজিদের পাশ দিয়ে পোস্তার মোড়। পোস্তার পোষ্ট অফিসের পাশে অতি সরু গলিতে আমাদের বাসা। পোষ্টঅফিসের পাশে চামড়ার গুদামে বিনা পয়সায় পেপার পড়তে যাই মাঝে মাঝে। সেখানে গিয়ে হাতেপায়ে ধরে আগের দিনের পত্রিকা বের করলাম। দেখি সেই পত্রিকাতেও ষ্ট্যান্ড করা লিষ্ট আছে। সেখানেও ছাপা হয়েছে আমার নাম। মো. নজরুল ইসলাম। স্কুল: ওয়েষ্ট এ্যন্ড হাই স্কুল।
বাসায় এসে মিনমিন করে এই সংবাদ দিলাম সবাইকে। আমার বোনরা সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো। বড় ভাই একটু অবাক হলো। কাউকে খুব একটা খুশি মনে হলো না। তবে বিকেলে বাবা একসের মিষ্টি আনলেন পাড়ার দোকান থেকে। রেজাল্টের জন্য নাকি অন্য কারণে বোঝা গেল না। একসাথে সাদা রঙ্গের দুটো মিষ্টি পেলাম। আমাদের দু:খী ও চরম মিতব্যায়ী পরিবারে এটাও ছিল একটা ঘটনা।
একবছর পর আমার মামাতো ভাই এসএসসি পরীক্ষা দিল। সে আমার ২৬ দিনের বড়। ধনবান পরিবারের সন্তান। ছোটবেলায় ঈদে মামার বাড়িতে গেলে আজিমপুরের সাগর সম্ভারে নিয়ে যেত, ঠান্ডা কোকা কোলা খাওয়াতো। বিনিময়ে সারাবছর তার লেজুড়ের মতো হয়ে থাকতাম। ক্লাশ নাইনে ওঠার পর আমি টিউশনি শুরু করি। পঞ্চাশ টাকা মাসে পেতাম। কোক খাওয়ার ছ্যাবলামো কমলো আমার। কিন্তু তার প্রতি ভক্তি না।
মামাতো ভাইও প্রথম বিভাগ পেয়েছিল, তবে তা বিজ্ঞান বিভাগে। তখন মানবিক বিভাগ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে ফার্স্ট ডিভিশন পাওয়া অনেক সহজ ছিল। তবু ফার্স্ট ডিভিশন উপলক্ষে তার বাসায় বিরাট খাওয়া দাওয়ার আয়োজন হলো। চকচকে ও দামী কাপড় চোপড় পড়ে সে ডাইনিং টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে। তার আলো গায়ে মেখে আমিও হাসি হাসি মুখে পাশে দাঁড়িয়ে আছি। বড় মামা এসে তাকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন বংশের মুখ উজ্জ্বল করেছে সে। নিস্প্রভ আমার দিকে একবারো ফিরে তাকালেন না তিনি। উনি কি জানেন আমি স্ট্যান্ড করেছি গতবছর? তাকে দেখে মনে হলো জানেন না। আমি যে পাশে দাঁড়ানো, এটাও বোধহয় চোখে পড়লো না তার। মামাতো ভাইয়ের অসাধারণ রেজাল্ট নিয়ে তুমুল উচ্ছাস তখন খাবার টেবিলে। অন্ধকার বারান্দায় এসে জীবনের এসব রহস্য বোঝার চেষ্টা করলাম। মনে হয়না খুব একটা বুঝেছিলাম তখন।
মামার পরিবার এরপর ঘুরতে গেল লন্ডনে। সেই লন্ডনে, মুহাম্মদ আবদুল হাই-য়ের বিলেতে সাড়ে সাতশো দিন পড়ে যা মনে হয়েছিল রূপকথার রাজ্য। আকাশের মেঘ ছুঁয়ে ছুঁয়ে, অন্ধকার গুহা থেকে গোঁ গোঁ করে বের হয়ে আসা পাতাল রেলের পেটে ঢুকে, সাদা সাদা মেমসাহেব দেখে এলো তারা লন্ডন থেকে। লন্ডনের চকলেটের একটা টুকরো খেয়ে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো আনন্দে। লন্ডনের গল্প শুনতে মন চায় তার কাছে। কিন্তু সে বিরক্ত ধরনের তরুন। আমার অতিরিক্ত মুদ্ধতা ভালো লাগলো না তার।
আমি তাতেও খুশী। লন্ডনে যাওয়া একটা ছেলে আমার মামাতো ভাই! এটা ভেবেই মন ভরে উঠতো গর্বে। বিমান দুরের কথা, তখনো আমি ট্রেনেই চড়িনি। ছোটবেলায় লঞ্চে চড়ে গেছি কুমিল্লায় দেশের বাড়িতে। সেও লঞ্চের পেটের ভেতর বসে বসে।

সাহস হলো না লন্ডনে কোনদিন যাবো এটা ভাবার।

(আসিফ নজরুলের আলোচিত গ্রন্থ ‘পিএইচডির গল্প’ থেকে। এবারের বইমেলায় গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে বাতিঘর থেকে।  দ্বিতীয় পর্ব আগামীকাল।)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status