বই থেকে নেয়া

মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৪)

‘তারা বললো- মার্শাল ল’ দিলে আন্তর্জাতিক সমর্থন পাবে না’

স্টাফ রিপোর্টার

২৪ মার্চ ২০২১, বুধবার, ১০:২৩ পূর্বাহ্ন

আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তখন ১৯৫৯ সালে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিতব্য প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাত্র কয়েক মাস আগে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে এবং ‘জনগণের প্রজ্ঞা’র ভিত্তিতে এক ধরনের বুনিয়াদি গণতন্ত্র প্রবর্তন করে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে এককভাবে কঠিন হাতে ১১ বছর দেশ শাসন করে। তার ফল ভালো হয়নি, শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান ভেঙে দ্বিধাবিভক্ত হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। পরবর্তী একসময়ে বেসামরিক সরকারের কাছ থেকে ক্ষমতা করায়ত্ত করার মাত্র তিন মাসের মধ্যে দেশে গণতন্ত্র পুনঃস্থাপনের অঙ্গীকার করে আরেকজন পাকিস্তানী জেনারেল জিয়াউল হক নিজস্ব গণতন্ত্রের কায়দায় ১১ বছর দেশ শাসন করেন এবং শেষাবধি মার্কিন রাষ্ট্রদূতসহ এক বিমানে বোমা বিস্ফোরণে নিহত হন।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এর আর এক দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। চিফ অব আর্মি স্টাফ থাকা অবস্থায় তিনি প্রত্যেকটি সেনানিবাসে বেসামরিক প্রশাসনে সামরিক অংশীদারিত্বের কথা বলে সেনা কর্মকর্তাদের সংগঠিত করেন। নির্বাচিত একটি সরকারের কাছ থেকে ক্ষমতা করায়ত্ত করার আগে তিনি জনগণের মধ্যে তার এই ধারণা ব্যাপকভাবে প্রচার করেন। এ ব্যাপারে এরশাদ কোনো লুকোচুরি করেননি। তিনি অত্যন্ত প্রকাশ্যভাবে সংবাদপত্র ও প্রচারযন্ত্রে দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতার’ লক্ষ্যে এক ধরনের সামরিক-বেসামরিক সমন্বিত প্রশাসনের ধারণা-সংবলিত সুলিখিত বিবৃতি ও বাণী (?) প্রচার করেন। তিনি জনগণকে এমন একটা ধারণা দেন যে, তার গণতন্ত্রের চিন্তাধারাই বাংলাদেশের জনগণের জন্য সবচাইতে উপযোগী হবে। কিন্তু ক্ষমতা গ্রহণ করার পর এবং নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত হওয়ার অব্যবহিত পরে তিনি বেসামরিক প্রশাসনে সেনাবাহিনীর অংশীদারিত্ব ও সেনাবাহিনীকে সাংবিধানিক ভূমিকা প্রদানের বিষয়টি পুরোপুরিভাবে পরিত্যাগ করে এবং নিজস্ব মডেলের গণতন্ত্রের অধীনে প্রায় ৯ বছর দেশ শাসন করেন।” অন্য যে কোনো জেনারেলের মতোই এরশাদ দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে তার শাসন শুরু করেন এবং শেষাবধি ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সেই দুর্নীতিবাজ হিসেবে কথিত রাজনীতিবিদদের উপরই নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। শুধু তাই নয়, নিজেও সবচাইতে দুর্নীতিবাজ রাষ্ট্রপ্রধানের কুখ্যাতি অর্জন করেন ও পরবর্তীকালে দেশের প্রচলিত আইনে সাজা পেয়ে কারাবরণও করেন।
কিন্তু এবারে ব্যতিক্রম হলো এই যে, জরুরি অবস্থার আচ্ছাদন দিয়ে সামরিক বাহিনী রয়ে গেছে পর্দার অন্তরালে, অথচ প্রশাসন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে তাদেরই একচ্ছত্র আধিপত্য, আর দেশের সংবিধানকে অকার্যকর অবস্থায় রেখে দেয়া হয়েছে। জেরাকারীরা অকপটভাবেই জানালো যে, চলমান ব্যবস্থা কোনো চিরস্থায়ী বা সুমীমাংসিত ব্যবস্থা নয়। তারা চাইছে প্রধান সেনাপতি মঈন ইউ আহমেদ হবেন দেশের রাষ্ট্রপতি, দেশে থাকবে সৎলোক দ্বারা পরিচালিত একটি দুর্নীতিমুক্ত স্থিতিশীল সরকার এবং সাবেকী রাজনৈতিক সংঘাতের সংস্কৃতির অবসান ঘটানো হবে। আমার অভিমতের উপর বিশ্লেষণ চালিয়ে তারা এ নিয়ে আলাদা কতকগুলো বিকল্প সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করলেও সেগুলো নিয়ে কীভাবে এগোতে হবে এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো ধারণা তাদের ছিল না। জিজ্ঞেস করলাম, “আপনারা কি মার্শাল ল’র কথা চিন্তা করছেন?” ওদের একজন স্পষ্টভাবে বললো, “না। একা দেশ চালানো আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়, তাছাড়া মার্শাল ‘ল’ দিলে তার জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন পাওয়া যাবে না। তাতে দেশের ভেতরে ও বাইরে সেনাবাহিনী দারুণ রকমের বেকায়দায় পড়তে পারে।”

“তাহলে কি আপনারা এমন একটা অলিগার্কির কথা ভাবছেন যেখানে শুধু যোগ্য ও সৎ ব্যক্তিদের দ্বারা সরকার পরিচালিত হবে? কিন্তু তাদের বাছাই করবে কে? যোগ্যতা ও সততার মাপকাঠি কী হবে? দেশের সংবিধান বলছে প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতা থাকবে জনগণের হাতে।”
“সেজন্যই তো আমরা আপনার সঙ্গে বসেছি। আমরা বুঝতে চাইছি কীভাবে আমাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা যায়।”

বললাম, “আপনাদের প্ল্যান কোনো কাজে আসবে না। গণতন্ত্র দীর্ঘস্থায়ী করতে হলে এই প্ল্যান ব্যর্থ হতে বাধ্য। সামরিক বাহিনী প্রশাসনে যে কোনো রকমের অংশীদারিত্ব চাইলে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো বদলাতে হবে- যা যে কেউ চ্যালেঞ্জ করলেই সুপ্রীম কোর্ট বাতিল করে দেবে। এমনকি আপনারা যদি সামরিক আইন জারি করে মার্শাল ‘ল’ প্রক্লেমেশনের মাধ্যমে সংবিধান স্থগিত করে দেন বা সংশোধন করেন এবং পরে তা দুই-তৃতীয়াংশ ইতিবাচক ভোটের মাধ্যমে সংসদে বৈধ করে নেওয়া হয় তবুও পরবর্তীকালে সুপ্রীম কোর্ট তা বাতিল করে দিতে পারে। সুপ্রীম কোর্ট এই বলে বাতিল করবে যে, তা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক।” মনে হলো আমার ব্যাখ্যায় অফিসাররা যথেষ্ট হতাশ হয়েছে। তবুও হ্যান্ডশেক করে পরে আবার তারা আমার সঙ্গে বসবে বলে আমাকে আবার সেই বদ্ধ প্রকোষ্ঠে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিল। তবে তারা কখন আসবে সে ব্যাপারে কিছুই বলেনি।

চোখবাঁধা অবস্থায় সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠার চাইতে নিচে নামা ছিল অনেক বেশি কঠিন। শ্লথ গতিতে ধীরে ধীরে নিচে নামার সময় আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছিল- “চেয়ে দ্যাখো বেয়াদবগুলোর দিকে! নিচের তলার ওরা আমাকে অযোগ্য দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ বলে গালাগাল করেছে। আর উপরতলার ওরা গণতন্ত্র আর সংবিধানকে ধ্বংস করে ক্ষমতায় সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য আমার পরামর্শ চাইতে এসেছে। যাই হোক, কিছুক্ষণের জন্য হলেও তেলাপোকার আক্রমণ, ইঁদুরের আনাগোনা আর মশককূলের আগ্রাসনের বাইরে থাকতে পেরে আমার কাছে একরকম ভালোই লাগছিল। তাছাড়া ওদের সঙ্গে আলােচনাও ছিল অনেকটা ইন্টারেস্টিং। অন্ততঃপক্ষে জাতিকে নিয়ে তারা কী খেলা খেলতে চায় তার কিছুটা আভাস পেলাম। তবে মনে হচ্ছিল ওরা পুরোপুরিভাবে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। এবং আসলে তারা অজানা কোনো শক্তির হাতের ক্রীড়নক হয়ে কাজ করছে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো ক্ষমতা এদের হাতে ছিল না। মঈন ইউ আহমেদের যদি সে রকম ব্যক্তিত্ব, নেতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ থাকতো তাহলে তিনি আরো নিশ্চিতভাবে এবং সুসংহত কায়দায় এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেন। আসলে নেতৃস্থানীয় সকল জেনারেলের সমর্থন তার পেছনে আছে কী? দেশের শাসন প্রত্যক্ষভাবে অধিগ্রহণ করার জন্য সামনে পেছনে সবাই তার জন্য ঐক্যবদ্ধ কী? আমি নিশ্চিত হতে পারছিলাম না।

তখন প্রায় ভোর চারটা। আমি তখন ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। ঘরের দেয়ালে জ্বলছিল অল্প পাওয়ারের বাতি। পিঁপড়ার দল ততক্ষণে বিদায় নিয়েছে। নিশ্চয়ই আহার জোগাড় করে ওরা মেঝের কোণায় কোনো ছিদ্রপথে ফিরে গেছে তাদের আবাসে। তেলাপোকা, পিঁপড়া কিংবা ইঁদুরেরা কি রাতে ঘুমায়? মানুষের মতো ওদের কি বিশ্রাম দরকার? পোকামাকড় সম্পর্কে আমার খুব একটা ধারণা নেই। ওদের ঘুম প্রয়োজন হলে ওরা যথার্থই ভাগ্যবান- কারণ ঘুমাবার যথেষ্ট সময় ওদের রয়েছে। কিন্তু আমার ঘুমাবার কোনো সুযোগই নেই। মশককুল ছিল অধৈর্য। সাধারণত আমি মশারীর ভেতরে থাকলে একটিমাত্র মশাই হতো আমার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাবার জন্য যথেষ্ট, অথচ এখন আমার চারদিকে অসংখ্য মশা এবং আমি মশারীবিহীন অবস্থায় আছি। থিয়েটারে কারো অভিনয় দেখে একজন যেভাবে তালি দেয়, ঠিক সেভাবে আমি তালি দিয়ে বেশ কয়েকবার মশা নিধন করার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম। মশাগুলোর দৃষ্টিশক্তি নিশ্চয়ই খুব তীক্ষ্ণ। কারণ, তাদের রয়েছে আক্রমণের হাত থেকে সরে যাওয়ার ব্যাপারে প্রবল অনুধাবন ক্ষমতা। এরপরও কয়েকবারের চেষ্টায় আমি তাদের মধ্যে গোটা দুয়েককে নিধন করে আমার হাতকে রক্তাক্ত করেছি। একপর্যায়ে আমার সঙ্গে আনা টাইম ম্যাগাজিন দিয়ে বাতাস করে ওদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে চেষ্টা করলাম- কিন্তু সে প্রচেষ্টাও শেষ পর্যন্ত কাজে এলো না। অতঃপর শক্ত কাঠের চৌকিতে জড়োসড়ো হয়ে লুঙ্গি দিয়ে আপাদমস্তক ঢেকে শুয়ে পড়লাম। ক্লান্ত শরীরটা কিছুক্ষণের জন্য নিদ্রায় ঢলে পড়লো। কিন্তু বেশিক্ষণ নয়, দরজা খোলার মৃদু শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। দুই টুকরা ঠাণ্ডা রুটি, এক ধরনের ভাজি এবং এক গ্লাস পানি নিয়ে দুজন এসে ঘরে ঢুকলো। একজন ওই খাবারগুলো মেঝের উপর রেখে আমাকে হাতের ইশারায় ঘরের কোণের দিকে একটা সরু গলির দিকে ইশারা করে জানালো যে, ইচ্ছে করলে আমি সেখানে ছোট টয়লেটটি ব্যবহার করতে পারি। তবে টয়লেটটা ব্যবহার করার আগে আমি যেন তাদের জানাই। কারণ, টয়লেটের ওপাশে অন্য বন্দিরাও এই একই টয়লেট ব্যবহার করছে। অবশ্য তখনো অন্য কোনো বন্দির সঙ্গে আমার দেখা হয়নি, টয়লেটে যাওয়ার সুবাদে যেন সেরকম কোনো ঘটনা না ঘটে সে ব্যাপারে সাবধান করে দিল। “মুখ ধুবো কোথায়?” আমার জিজ্ঞাসার উত্তরে ওরা আমাকে টয়লেটের দিকে আঙুল তুলে দেয়ালে বসানো ছোট্ট একটা বেসিন দেখিয়ে দিল। গতকাল যে দুজন আমার জন্য ডিউটিতে ছিল তারা কোথায় জিজ্ঞেস করলে একজন আমার দিকে তাকিয়ে খুব নিচুস্বরে জানালো, মেহমানদের সঙ্গে বেশি বেশি কথা বলায় তাদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার দিকে তাকালে মনে হলো সে আরো কিছু বলতে চায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছু না বলে মৃদু মাথা ঝাঁকিয়ে সে চলে গেল। বাইরে থেকে তারা আবার দরজাটা বন্ধ করে দিল।
(চলবে..)

আরও পড়ুন-
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৫)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status