প্রথম পাতা

‘ওর চিঠিগুলোই এখন আমার সবকিছু’

তারিক চয়ন

৯ মার্চ ২০২১, মঙ্গলবার, ৯:৩০ অপরাহ্ন

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেপ্তার লেখক মুশতাক আহমেদ সমপ্রতি কারাগারে মারা গেছেন। তার মৃত্যুর পর দেশে-বিদেশে সমালোচনার ঝড় বইছে। রোববার (৭ই মার্চ) মুশতাকের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে সস্ত্রীক তার বাসায় যান আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাংলাদেশি ফটোগ্রাফার, অ্যাকটিভিস্ট, টাইম বর্ষসেরা ব্যক্তিত্ব শহিদুল আলম। শহিদুল নিজেও নিরাপদ সড়কের দাবিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা ছাত্র বিক্ষোভের প্রেক্ষাপটে আইসিটি আইনের মামলায় আটক হয়ে দীর্ঘদিন কারাভোগ করেছিলেন। ১০৭ দিন পর কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেয়ে এক তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় শহিদুল বলেছিলেন ‘মুক্তি প্রত্যেকের কামনা। স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীন নাগরিকরা মুক্ত থাকবে- সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু স্বাধীন নাগরিকরা যদি তাদের মুক্তচিন্তা বা স্বাধীনভাবে কথা বলতে না পারে, তাহলে তারা পরাধীন।’

মুশতাকের পরিবারের সঙ্গে কাটানো অভিজ্ঞতা নিয়ে শহিদুল নিউজডটকম-এ ‘তার যা কিছু আমার কাছে রইলো’ শিরোনামে ইংরেজিতে লিখেছেন। তার সেই লেখাটির হুবহু অনুবাদ তুলে ধরা হলো-
‘আমি তাকে ৫৪ বছরের জন্য দেখভালের দায়িত্বে ছিলাম। এখন আল্লাহ্‌ সেটা নিয়েছেন’- লেখক মুশতাক আহমেদের মা বললেন। একজন সম্ভ্রান্ত নারী ধীরস্থিরভাবে, নিয়ন্ত্রণ না হারিয়ে কথাগুলো বলছিলেন। মাঝে মাঝে তার কণ্ঠস্বর ভেঙে যেতো, তবে তিনি নিজেকে ধরে রাখতে পেরেছিলেন। তিনি কাউকে কষ্ট দিতে চাচ্ছিলেন না।

মুশতাকের বাবা অবশ্য অনেকটা প্রকাশ্যেই ভেঙে পড়লেন। তিনি তার সন্তানের কথা বলতে বলতে কাঁদছিলেন- মুশতাকের ফার্মের কথা, ফটোগ্রাফির প্রতি তার ভালোবাসার কথা, মুশতাকের বোনের কথা যিনি আমার মায়ের গড়া স্কুলের শিক্ষার্থী ছিলেন। বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন ‘আমি কি আপনাকে তার ক্যামেরাটি দেখাতে পারি?’ তিনি সতর্কভাবে ৭০-৩০০ মিমি লেন্স সহ ডিএসএলআর ক্যামেরাটি নিয়ে এসে আমার সামনে রাখলেন। মুশতাকের স্ত্রী লিপা মেমোরি কার্ড আর ব্যাটারি নিয়ে আসলেন। এসব কিছুই যেনো আমার জন্য ডাইনিং টেবিলে আমার সামনে রাখা হয়েছিল। আমি ক্যামেরাটি ধরতেই লিপা চুপটি করে বললেন, ‘এই ক্যামেরাটি ছিল আমার সতীন। সে আমার চেয়েও ওকে বেশি ভালোবাসতো।’

এর আগে লিপা মুশতাকের তোলা পর্বতমালার ছবি (বড় করে বাঁধানো) নিয়ে এসেছিলেন। বরফাবৃত চূড়াগুলো চাঁদের আলোয় ঝলমল করছিল। লিপা আর মুশতাকের খালা আমাকে ছবিটি দেখাবার জন্য আনন্দের সঙ্গে ধরে রেখেছিলেন। “ওর খুব ইচ্ছে ছিল আপনাকে ছবিটি দেখাবে। আপনি আমাদের বাড়িতে এসেছেন জানতে পারলে, সে যে কি খুশি হতো!” তিনি মুশতাকের শেষ প্রকাশিত বই ‘কুমির চাষির ডায়েরি’ নিয়ে আসলেন। ভালোবেসে তিনি লিখলেন, ‘যাদের নিজ হাতে দিতে পারলে মুশতাক সবচেয়ে খুশি হতো।’ “এখানে কুমিরের কথা আছে, আমাদের বিবাহ, আমাদের সম্পর্কেও কথা আছে। এ বইটি আমাদের সম্পর্কে জানতে সাহায্য করবে।’’

লিপা মুশতাকের কাছ থেকে পাওয়া চিঠি নিয়ে আসলেন। জেল থেকে লেখা মোট সাতটি চিঠি, টিকিট লাগানো, সিলমারা। মার্জিত, ঝরঝরে হাতের লেখার চিঠিগুলো তিনি যত্ন সহকারে রেখে দিয়েছেন, বাদামি খামের ভেতর ঢুকিয়ে। “এগুলোই এখন আমার সবকিছু।’’

নিজের অনিশ্চিত অবস্থা সম্পর্কে বলার পরিবর্তে কথা ঘুরিয়ে চিঠিতে লেখা, ‘তোমার চুলে রং করো, বাইরে বেড়াতে যাও, যার সঙ্গে ভালো লাগে যাও।’ রেহনুমা (রেহনুমা আহমেদ, সাবেক অধ্যাপক-গবেষক-সমাজবিজ্ঞানী-সমাজকর্মী এবং শহিদুল আলমের স্ত্রী) লিপাকে জিজ্ঞেস করলো, আপনি তাকে কিছু লিখেন নি? ‘না, কারাগারের জেলাররা সেগুলো পড়তো, সন্দেহের চোখ দিয়ে’।

ওদের কথাগুলো আমি শুনতে পাচ্ছিলাম। রেহনুমা বললো, আপনি তাকে ‘বাবু’ বলেও ডাকতেন। না, না, তার বাবা-মা ডাকতেন। মাঝেমাঝে আমিও ডাকতাম, যাতে বুঝতে অসুবিধা না হয়। তিনি আপনাকে কী বলে ডাকতেন, রেহনুমা জিজ্ঞাসা করে বললো- জেল থেকে পাঠানো তার চিঠিগুলোতে আমি তাকে ‘জান’ লিখতে দেখেছি। ‘আর তুমি?’ কিছুই না, আমি সবসময় ‘এই’ বলেই ডাকতাম।

ভালোবাসার এক ঘর, একটি পরিবার। শিক্ষিত, প্রগতিশীল, উদার এবং নিজ দেশ নিয়ে খুবই গর্বিত। এর আগে রেহনুমার সঙ্গে তাদের কেবল একবারই দেখা হয়েছিল, মিন্টো রোডে ডিবি অফিসের ওয়েটিং রুমে, যে রাতে আমাকে তুলে নেয়া হয়েছিল। মুশতাককেও ফেসবুকে আমার পোস্ট শেয়ার করার কারণে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
আমরা মুশতাকের বাসা থেকে চলে আসার পর রেহনুমা মৃদুভাবে বললো ‘আমি ভাবতেও পারি না যে, তুমি আমার পাশেই আছো। লিপার মুশতাক তো আর নেই।’ রেহনুমা এমনিতে বেশ শক্ত এক নারী। আমার বন্দিদশা জুড়ে, আমার ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে জেনেও, আমার বিরুদ্ধে জঘন্য কুৎসা রটানো সত্ত্বেও, বারবার জামিন প্রত্যাখ্যান করার পরও সে কখনো ভেঙে পড়েনি। আজ, তাকে আমি চোখের জল আটকে রাখতে দেখলাম।
আমরা যথেষ্ট কিছু করিনি-এই তাড়না আমাদের আমরণ ভোগাবে।

 
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status