শেষের পাতা

বিদেশি প্রতারকদের বিয়ের ফাঁদ

শুভ্র দেব

৮ মার্চ ২০২১, সোমবার, ৯:৩১ অপরাহ্ন

বাংলাদেশি নারীদের বিয়ে করে প্রতারক হিসেবে তৈরি করছে নাইজেরিয়ান নাগরিকরা। পরে এসব নারীদের ব্যবহার করে নিত্য নতুন কৌশলে প্রতারণা করছে মানুষের সঙ্গে। হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। সম্প্রতি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের ওয়েব বেইজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিম এমনই একটি প্রতারক চক্রের সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের দু’জন নাইজেরিয়ান নাগরিক। ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে চক্রের সদস্যরা চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। ভিজিট ভিসায় দীর্ঘ ১০ বছর আগে তারা দেশে এসেছিল। ভিসার মেয়াদ চলে গেলেও তারা এ দেশে অবস্থান করছে। দীর্ঘ এই সময়ে ডিজিটাল পদ্ধতিতে নানা রকম প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছে। ডিবি জানিয়েছে, নাইজেরিয়ানরা এর আগে নানা প্রতারণার সঙ্গে জড়িয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন প্রলোভনে ফেলে বাংলাদেশের নারীদের বিয়ে করে তাদেরকে প্রতারক হিসেবে তৈরি করার ঘটনা এই প্রথম।

ডিবি তদন্ত সংশ্লিষ্টসূত্র জানিয়েছে, বনানী থানায় এক ভুক্তভোগীর করা মামলায় তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ৫ই মার্চ ঢাকার খিলক্ষেত এলাকার বোর্ডঘাট নামাপাড়ার একটি ফ্ল্যাট থেকে প্রথমে জন জোসেফ (২৭), ইমেকা ইউরিক (৩০), লতা আক্তার (২৬), আয়েশা আক্তারকে (১৯) গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পরে তাদের দেয়া তথ্যমতে পশ্চিম থানা এলাকা থেকে হাবিবুর রহমান (২৭), মো. আশরাফুল ইসলাম (২৪) এবং টঙ্গি পূর্ব থানাধীন এরশাদ নগর থেকে আল আমিন (২৭) কে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে ১৪টি মোবাইল ফোন, ২০টি সিম কার্ড, নগদ ৯৯ হাজার টাকা, বিভিন্ন ব্যাংকের ৮টি এটিএম কার্ড জব্দ করা হয়েছে। তাদেরকে আদালতে হাজির করলে পুরুষ প্রতারকদের ৫ দিন ও নারী প্রতারকদের তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়।  

প্রতারকদের মধ্যে জন জোসেফ পাঁচ বছর আগে বিয়ে করেছে লতা আক্তারকে। লতা একজন পোশাককর্মী। জোসেফ তাকে লোভে ফেলে দ্রুত বড় লোক হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে বিয়ে করেছে। জোসেফকে বিয়ে করার পর লতার দুই বোন, তাদের স্বামীসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা প্রতারণার কাজে জড়িয়ে পড়ে। নাইজেরিয়ান জন জোসেফ ও ইমেকা ইউরিকের মাধ্যমেই তারা এই পথে আসে।

ডিবির ওয়েব বেইজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের কর্মকর্তারা জানিয়েছে, বনানী এলাকার প্রকৌশলী মো. হাবিবুর রহমানের (৪৯) ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডিতে গত বছরের মার্চ মাসে জেসিকা অসকার নামের এক নারীর ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট আসে। হাবিবুর ওই নারীর রিকুয়েস্ট গ্রহণ করে চ্যাটিংয়ের মাধ্যমে কথা শুরু করেন। কথিত জেসিকা অসকার নিজেকে আমেরিকান নাগরিক ও নেভি অফিসার হিসেবে পরিচয় দিয়ে জানান, বর্তমানে তিনি আফগানিস্তানে কর্মরত আছেন। জেসিকার সঙ্গে খুব দ্রুতই সখ্যতা গড়ে ওঠে হাবিবুরের। এভাবে কিছুদিন কথাবার্তার একপর্যায়ে জেসিকা হাবিবুরকে জানায়, তার কাছে এক মিলিয়ন ইউএস ডলার আছে (বাংলাদেশি ৮ কোটি পঞ্চাশ লাখ টাকা)। এই টাকাগুলো তিনি তার দেশ আমেরিকায় নিয়ে যেতে পারছেন না। তাই এই টাকাগুলো তিনি তাকে পাঠাতে চান। পরে সুবিধামতো সময়ে বাংলাদেশে এসে টাকা নিয়ে যাবেন। এই কথার কয়েকদিনের মধ্যেই জেসিকা একটি বুকিং রিসিট হাবিবুরের কাছে পাঠিয়ে দেন। ১৭ই ফেব্রুয়ারি হাবিবুরের মোবাইল নম্বরে কাস্টমস কর্মকর্তা পরিচয়ে হামিদুর রহমান নামের একজন ফোন দিয়ে বলেন, একটি পার্সেল এসেছে ছাড়িয়ে নেয়ার জন্য ৫৫ হাজার টাকা লাগবে। টাকা পাঠানোর জন্য কথিত কাস্টমস কর্মকর্তা ডাচ্‌- বাংলা ব্যাংকের উত্তরা শাখার একটি অ্যাকাউন্ট নম্বর দেন। সরল বিশ্বাসে হাবিবুর ওই অ্যাকাউন্ট নম্বরে ৫৫ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেন। পরে ওই নম্বর থেকে আবার ফোন দিয়ে বলা হয় পার্সেলটি স্ক্যানিং করার জন্য আরো ২ লাখ ৭২ হাজার টাকা লাগবে। হামিদুর রহমানের কথামতই হাবিবুর ২ লাখ ৭২ হাজার টাকা একই ব্যাংকের শাখায় জমা করেন। তাতেও থামেনি প্রতারকরা। ১৮ই ফেব্রুয়ারি একই মোবাইল নম্বর থেকে ফোন দিয়ে বলা হয় পার্সেলে খারাপ কিছু পাওয়া গেছে সেটার জন্য আরো ১৭ লাখ ৯৮ হাজার টাকা লাগবে। টাকা না দিলে হাবিবুর মানিলন্ডারিং আইনে মামলায় জড়াবেন। এজন্য তাকে কয়েকটি অ্যাকাউন্ট নম্বর দেয়া হয়। উপায়ান্তর না পেয়ে হাবিবুর এমএম এইচ ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের নামে মিউচ্যুয়াল ট্রাষ্ট ব্যাংকের মিরপুর বাঞ্চ, একই ব্যাংকের সারুলিয়া ব্রাঞ্চে ওই টাকা জমা করেন। পরে প্রতারকরা হাবিবুরের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। কিছুদিন পর তারা ফের যোগাযোগ করে আরো ৫ লাখ ৯০ হাজার টাকা দাবি করে। এজন্য তারা পর্যায়ক্রমে গোলাম কিবরিয়া নামীয় মিউচ্যুয়াল ট্রাষ্ট ব্যাংকের উত্তরা ব্রাঞ্চের অ্যাকাউন্ট নম্বর, একই ব্যাংকের আরেকটি শাখায় সজিব এন্টারপ্রাইজ, এবি ব্যাংকের মিরপুর-২ শাখায় গোলাম কিবরিয়া, মিউচ্যুয়াল ট্রাষ্ট ব্যাংকের মিরপুর-১০ শাখায় এমএমএইচ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, মিউচ্যুয়াল ট্রাষ্ট ব্যাংকের সারুলিয়া শাখায় আবির এন্টার প্রাইজ, ডাচ্‌-বাংলার উত্তরা শাখায় বেলাল হোসেন, ইসলামী ব্যাংকের জিনজিরা ও সিটি ব্যাংকের জিনজিরা শাখায় হেলাল মিয়া, সাউথইস্ট ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায় সাকিবুল, সিটি ব্যাংকের মিরপুর শাখায় মহসিন হোসাইন, ইউসিবি ব্যাংকের সারুলিয়া শাখায় আবির এন্টার প্রাইজ, ইসলামী ব্যাংক কেরানিগঞ্জ শাখায় হেলাল, সিটি ব্যাংক কেরানিগঞ্জ শাখায় হামিদুল, সিটি ব্যাংক চট্টগ্রাম শাখায় আবির এন্টার প্রাইজ, সিটি ব্যাংক জনসন রোড শাখায় মাহবুবুর রহমান, সিটি ব্যাংক শিবচর শাখায় হালিম, সিটি ব্যাংক উত্তরা শাখায় আমিনুল ইসলাম, ইসলামী ব্যাংক নারায়ণগঞ্জ শাখায় হুমায়ুন কবির, ইসলামী ব্যাংক খেজুরবাগ শাখায় আবু তাহের নামীয় অ্যাকাউন্ট নম্বর হাবিবুরের কাছে পাঠায়। প্রতারকদের এ রকম কর্মকাণ্ডে হাবিবুর এক সময় বুঝতে পারেন তিনি ফাঁদে পড়েছেন। পরে তিনি বনানী থানায় গিয়ে একটি মামলা করেন।

সাইবার স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের ওয়েব বেইজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের ইনচার্জ অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার আশরাফউল্লাহ মানবজমিনকে বলেন, এই চক্রের মূলহোতারা দেশের বাহিরে অবস্থান করছে। বিশেষ করে ফ্রান্স, আফগানিস্তান, নাইজেরিয়া ও ভারতে চক্রের সদস্যরা আছে। সেখান থেকেই বিভিন্ন পরিচয়ে ভুয়া আইডি খুলে মানুষকে নক করে। চক্রে অনেক সদস্য থাকে। প্রতি সদস্যদের ভিন্ন ভিন্ন কাজ রয়েছে। ভুয়া ফেসবুক আইডি তৈরি, টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে শনাক্ত, নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে রিকুয়েস্ট পাঠিয়ে সখ্যতা গড়ে তোলা, আইডির ব্যক্তি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ, কাস্টমস কর্মকর্তা সেজে ফোন করা, টাকা তোলা ও ভাগবাটোয়ারা করা তাদের কাজ। বাংলাদেশেও চক্রের অনেক সদস্য রয়েছে। তারা সব সময় ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। অনেক সদস্যরা একে অন্যকে চিনে না। আড়ালে থেকে হোয়াটসঅ্যাপস নম্বরে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তিনি বলেন, বিভিন্ন নামিদামি ব্যক্তিদের নামে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে এই প্রতারকরা টার্গেটকৃত ব্যক্তিদের ফাঁদে ফেলে। লোভ দেখিয়ে মিথ্যা পার্সেল পাঠিয়ে টাকা হাতিয়ে নেয়। এখন পর্যন্ত তারা বহু মানুষকে ঠকিয়েছে। ভোটার আইডি কার্ড দিয়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে টাকার লেনদেন, কাস্টমস কর্মকর্তা সেজে কথা বলাসহ নানা কাজে ব্যবহার করার জন্য নাইজেরিয়ানরা বাংলাদেশি নিম্ন শ্রেণির নারীদের বিয়ে করে। প্রতারণার টাকা লেনদেনের জন্য তারা বিভিন্ন মানুষের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status