প্রথম পাতা

ঢাবি’র মাস্টার প্ল্যান

আবাসন সুবিধার আওতায় আসছে ৭৬ শতাংশ শিক্ষার্থী

মুনির হোসেন

৭ মার্চ ২০২১, রবিবার, ৯:৩৯ অপরাহ্ন

শতবর্ষে পদার্পণ উপলক্ষে শিক্ষার মানোন্নয়নের পাশাপাশি অবকাঠামোগত উন্নয়নেও জোর দিচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে শিক্ষার্থীদের আবাসন চাহিদা পূরণ। কারণ শিক্ষার্থীদের আবাসন সুবিধা নিশ্চিত না হওয়ায় শিক্ষার মানোন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে সাড়ে ৭৬ শতাংশ শিক্ষার্থী আবাসন সুবিধার আওতায় আসবে। ইতিমধ্যে অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও পরিবেশবান্ধব ক্যাম্পাস তৈরির লক্ষ্যে একটি মাস্টার প্ল্যানও প্রণয়ন করা হয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী সভা। সিন্ডিকেটে এটি অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এখন প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে মাস্টার প্ল্যানটি। প্রধানমন্ত্রীর সবুজ সঙ্কেত পেলে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এ মহাপরিকল্পনা ৩ ধাপে বাস্তবায়ন করা হবে। বর্তমানে আবাসন ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে অনেক শিক্ষার্থীকে গণরুম ও বারান্দায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে দিন কাটাতে হচ্ছে। আর গণরুমে থাকতে হলে শাসক দলের ছাত্র সংগঠন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে হয় তাদের। ক্লাস-পরীক্ষার সময়ও ছাত্র সংগঠগুলো নিজেদের নিয়মিত কর্মসূচিতে উপস্থিত থাকতে বাধ্য করে শিক্ষার্থীদের। বিভিন্ন সময় ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেতারা শিক্ষার্থীদের মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। এদিকে, শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ গণরুমের দুর্দশার কথা চিন্তা করে বাহিরে মেস ভাড়া নিয়ে থাকছে। যার কারণে ব্যয় হচ্ছে অর্থ, নষ্ট হচ্ছে সময়। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের মেধা ও মনন বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দিনদিন অবনমন হচ্ছে শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত মান। বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলের শিক্ষার্থী রাহাতুল ইসলাম বলেন, আবাসন ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের গণরুমে থাকতে হয়। সেখানে থাকতে গেলে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন শিক্ষার্থীদের মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করে থাকে। যার কারণে যে উদ্দীপনা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় তা বাধাগ্রস্ত হয়। নষ্ট হয়ে যায় দীর্ঘদিনের পড়ালেখার ধারাবাহিকতা। আমি মনে করি, আবাসন সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে শিক্ষার্থীদের গণরুমে থাকতে হবে না। শিক্ষার্থীরা পড়ালেখায় মনযোগী হতে পারবে। যে উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে এসেছে তার বাস্তবায়ন হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বার্ষিক তথ্য বিবরণী’তে উল্লেখিত তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টির ১৯টি হল ও ৪টি হোস্টেল মিলিয়ে আবাসন সুবিধা রয়েছে মাত্র ১৬ হাজার ৭২৩ জনের। যা মোট শিক্ষার্থীর ৪২ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও শিক্ষার্থীদের এই দুর্দশা কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে। যার কারণে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়েছে আবাসন সুবিধা বাড়ানোর বিষয়টি। পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নে নতুন হল নির্মাণ ছাড়াও প্রতিটি হলে নতুন নতুন ভবন নির্মাণ ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো ভেঙে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায় বিশেষ বিবেচনায় উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য অর্থের যোগান দেবে সরকার। কিভাবে উন্নয়ন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে এ লক্ষ্যে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন করেছে বিশ্ববিদ্যালয়। মাস্টার প্ল্যানটি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪০ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে আবাসন ব্যবস্থা আছে মাত্র ১৬ হাজার ৭২৩ জনের। যা মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ৪২ শতাংশ। আর নতুন পরিকল্পনায় আবাসন সুবিধার আওতায় আসছে আরো ১৩ হাজার ৮৪৮ শিক্ষার্থী। সর্বমোট আবাসন সুবিধা পেতে যাচ্ছে ৩০ হাজার ৫৭১ শিক্ষার্থী। যা বর্তমানের প্রায় দ্বিগুণ। পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে সাড়ে ৭৬ শতাংশ শিক্ষার্থী আবাসন সুবিধা পাবে। এর মধ্যে মোট ছাত্রদের ৮২ শতাংশ এবং ছাত্রীদের ৬৭ শতাংশ আবাসনের অন্তর্ভুক্ত হবে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী প্রতিটি হলে শিক্ষার্থী প্রতি ২০০ বর্গফুট জায়গা নিশ্চিত করেই এ পরিকল্পনা করা হয়েছে। জানা গেছে, মাস্টার প্ল্যানটি ৩ ধাপে বাস্তবায়ন হবে। ৩টি ধাপে মোট ২৪টি বহুতল ভবন নির্মাণ হবে। যেখানে প্রথম ধাপে ছেলেদের জন্য ৩টি ও মেয়েদের জন্য ৪টি বহুতল ভবন নির্মাণের কথা রয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে মেয়েদের জন্য ১টি ও ছেলেদের জন্য ৭টি। আর সর্বশেষ ধাপে মেয়েদের জন্য ৩টি ছেলেদের জন্য ৬টি। প্রথম ধাপে নির্মাণ কাজের মধ্যে রয়েছে- ছাত্রীদের জন্য নতুন ‘জয় বাংলা হল’ নির্মাণ ছাড়াও শামসুন্নাহার হল, বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হল এবং শহীদ অ্যাথলেট সুলতানা কামাল ছাত্রী নিবাসে একাধিক বহুতল ভবন নির্মাণ। আর ছাত্রদের জন্য শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল, মাস্টার দা’ সূর্যসেন হল এবং হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে একাধিক বহুতল ভবন নির্মিত হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ‘জয় বাংলা হল’টি নির্মিত হবে নিউমার্কেট সংলগ্ন শাহ নেওয়াজ হোস্টেল ভেঙে। যেখানে ১ হাজার ছাত্রীর আবাসনের ব্যবস্থা হবে। এ ছাড়া গ্রিন রোডে ৬০০ ছাত্রীর আবাসনের ব্যবস্থা সম্বলিত পৃথক হোস্টেল করার প্রস্তাব করা হয়েছে। আর রোকেয়া হলে ৫০০টি আসন বাড়িয়ে ২ হাজার ২০০তে আবাসন সুবিধা উন্নীত করা হবে। শামসুন্নাহার হলে ৬০০টি আসন বাড়িয়ে ১ হাজার ২৮৮তে আসন সুবিধা উন্নীত করা হবে। নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ছাত্রী নিবাসে আসন সংখ্যা বাড়ানো হবে ৪০০টি। কবি সুফিয়া কামাল হলে বাড়ানো হবে ৬০০টি। যেখানে বর্তমানে ১ হাজার ছাত্রীর থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলে বর্তমানে আবাসন ব্যবস্থা রয়েছে ৬৩৮টি। এই হলে ৩৬৮টি আসন বাড়িয়ে ১ হাজারে উন্নীত করার প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হলে বর্তমানের ৯৬৮টি আসনই বলবৎ থাকছে। সেখানে কোনো পরিবর্তন আসছে না। আর শহীদ অ্যাথলেট সুলতানা কামাল হোস্টেলে ৫৯৪ জন ছাত্রীর আবাসন ব্যবস্থা বাড়িয়ে ৭০০ আসনে উন্নীত করা হবে। আর ছাত্র হলের মধ্যে অমর একুশে হল, স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম হল এবং বিজয় একাত্তর হলে নতুন করে কোনো আসন সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে না। তবে ড. মু. শহীদুল্লাহ হলে ২৭০টি আসন বাড়িয়ে ১ হাজার ৫০০ জনের আবাসন ব্যবস্থায় উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে। ফজলুল হক মুসলিম হলে কমছে আসন সংখ্যা। এই হলে ৭৫টি আসন কমিয়ে ১ হাজার ৪০০ জনের আবাসনের ব্যবস্থা করা হবে। হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে বর্তমানে রয়েছে ৫৪০টি আসন। এই হলে ৯৬০টি আসন বাড়িয়ে ১ হাজার ৫০০তে আসন সুবিধা উন্নীত করা হবে। জগন্নাথ হলে বাড়ানো হবে ২ হাজার ১০০ জনের আবাসন সুবিধা। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে এই হলের আসন সংখ্যা হবে সাড়ে ৩ হাজার। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে ৫১৩টি আসন বাড়িয়ে দেড় হাজার আসনে আবাসন সুবিধা উন্নীত করা হবে। কবি জসিমউদ্‌্‌দীন হলে ৩৯৭টি আসন থেকে বেড়ে ১ হাজার আসনে উন্নীত করা হবে। মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে বর্তমান আসন রয়েছে ৪৮৪টি। নতুনভাবে এ হলে যুক্ত হবে আরো ৫১৬টি আসন। শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের বর্তমান ধারণ ক্ষমতা ৭২৫। নতুন পরিকল্পনায় ১ হাজার ৭৭৫টি আসন বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। তাহলে এই হলের মোট ধারণ ক্ষমতা হবে আড়াই হাজার। স্যার এএফ রহমান হলে বাড়ানো হবে ৯৩টি আসন। তাহলে এই হলে ১ হাজার ছাত্রের আবাসন সুবিধা নিশ্চিত হবে। সূর্যসেন হলে নতুনভাবে ১ হাজার ৪৫৪ জনের আবাসন সুবিধা নিশ্চিত হলে এই হলের মোট ধারণ ক্ষমতা দাঁড়াবে ২ হাজারে। আর স্যার পিজে হার্টগ ইন্টারন্যাশনাল হলের বর্তমান ধারণ ক্ষমতা ১২৯। ৩৭১টি আসন বাড়িয়ে এই হলে ধারণ ক্ষমতা করা হবে ৫০০। আর ড. কুদরত-ই-খুদা হোস্টেলে ১১২টি আসন বাড়িয়ে ২৫০-এ উন্নীত করা হবে। এ ছাড়া গ্রিন রোডের আইবিএ হোস্টেলে ১ হাজার ৭৭৫টি আসন বাড়িয়ে মোট আসন সংখ্যা আড়াই হাজারে উন্নীত করা হবে। জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি (শিক্ষা) ও মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন বিষয়ক টেকনিক্যাল কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. এ কে এম মাকসুদ কামাল বলেন, আমাদের শিক্ষার্থীদের সিংহভাগই গ্রাম থেকে আসে। যারা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে মেধার ভিত্তিতে ভর্তি হয়। তাই এদের অনেকেই শহরে বাস করার মতো আর্থিক সক্ষমতা রাখে না। ঢাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকার সামর্থ্য না থাকায় শিক্ষার্থীদের হলগুলোর গণরুমে থাকতে হয়। গণরুমে থাকতে গেলে রাজনৈতিক শক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে হয় তাদের। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের মেধার সঠিক বিকাশ হয় না। সে কথা বিবেচনা করে ছেলেদের ৮২ শতাংশ এবং মেয়েদের ৬৭ শতাংশকে আবাসনের আওতায় আনার পরিকল্পনা করা হয়েছে। আমি মনে করি আবাসনের সঙ্গে মেধা-মননের বিকাশের সংযোগ রয়েছে। স্বাধীনভাবে থাকতে পারলে শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত মান অর্জন সম্ভব। তিনি বলেন, একাডেমিক পরিবেশ তৈরির জন্য আবাসন বাড়ানোর আবশ্যকতা রয়েছে। একজন শিক্ষার্থীর জন্য হলে ২০০ বর্গফুট জায়গার প্রয়োজন, যা আমাদের নেই। মাস্টার প্ল্যানের বাস্তবায়ন হলে সেটি নিশ্চিত হবে। সঠিকভাবে আবাসন সুবিধা নিশ্চিত হলে শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক শক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে হবে না। মেধার সুষ্ঠু বিকাশ হবে।
 
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status