শেষের পাতা

সড়ক, ফুটপাথে ভাসমান মানুষের রাত-দিন দেখার দায়িত্ব কার?

আলতাফ হোসাইন

৬ মার্চ ২০২১, শনিবার, ৯:৩০ অপরাহ্ন

রাত সাড়ে ১০টা। ইস্কাটন সরকারি কোয়ার্টারের পশ্চিম পাশের সীমানা দেয়াল ঘেঁষে ছোট ছোট পলিথিন-কাপড়ের ছাউনি। ভেতরে কারো ঘুমানোর প্রস্তুতি। কেউবা খাবারের আয়োজন করছেন। পাশে ইট বসিয়ে বানানো চুলায় রান্না সারছেন। বোঝার উপায় নেই যে, এটি গুরুত্বপূর্ণ একটি সড়কের পাশের ফুটপাথ। শুধু এই এলাকাই নয়, রাজধানীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ সড়ক, সড়ক দ্বীপ ও ফুট ওভারব্রিজে এভাবেই রাত যাপন করছেন অনেক ছিন্নমূল মানুষ। কারো কারো দিন কাটে এসব স্থানে। বলতে গেলে তাদের ঘরবাড়ি এইসব স্থান। প্রাত্যহিক সব কাজও তারা সারেন ওইসব স্থানে। এতে সাধারণ পথচারী ও এলাকার বাসিন্দাদেরও নানা সমস্যায় পড়তে হয়। ভাসমান মানুষদের পুনর্বাসন ও তদারকির জন্য নানা প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা থাকলেও তাদের তৎপরতা খুব একটা চোখে পড়ে না। অনেকে বলছেন, একটি দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার ইঙ্গিত দেয় সেদেশের রাস্তা-ঘাট ও সড়ক ব্যবস্থাপনা। রাজধানীর মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানের সড়কে, ফুটপাথে এভাবে ভাসমান মানুষের ভিড় নেতিবাচক ইঙ্গিতই বহন করে। এ ছাড়া সরকার মুজিববর্ষে সব মানুষকে ঘর করে দেয়ার যে উদ্যোগ নিয়েছে এভাবে সড়কে ছিন্নমূল মানুষকে রেখে তা কীভাবে সফল হবে এমন প্রশ্নও দেখা দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব নিয়ে। সিটি করপোরেশন, সমাজসেবা অধিদপ্তরসহ সরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ভাসমান মানুষদের নিয়ে কাজ করে। তারা তৎপর থাকলে এভাবে সড়ক-ফুটপাথে ভাসমান মানুষের ভিড় বাড়তো না।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নদীভাঙন ও বিভিন্ন দুর্যোগের শিকার হওয়া কিংবা কর্ম না থাকাসহ নানা কারণে ঢাকায় আসেন এসব ভাসমান মানুষ। বিভিন্ন ফুটপাথ, বাস টার্মিনাল, লঞ্চঘাট কিংবা রেলস্টেশনে গেলেই ঘরহীন শত শত মানুষের দেখা মেলে। বসবাসের জন্য ফুটপাথ কিংবা ওভারব্রিজের নিচেই তারা আস্তানা গেড়েছেন। এদের মধ্যে একটি অংশ রয়েছে যারা একেবারেই গৃহহীন, আবার অনেকের গ্রামে ঘরবাড়ি থাকলেও জীবিকার প্রয়োজনে রাজধানীতে এসে ফুটপাথে খুপরি তুলে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করেন। রান্নাবান্না, খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে মলমূত্র ত্যাগ সবকিছুই রাস্তার পাশেই করে থাকেন। কিছু এলাকায় পাবলিক টয়লেট থাকলেও টাকা দেয়ার ভয়ে তারা যেখানে সেখানে মলমূত্র ত্যাগ করেন। এতে দুর্গন্ধ ছড়ানোয় আশেপাশের পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফুটপাথে বসবাসের কারণে পথচারীদের চলাচলেও সমস্যায় পড়তে হয়। এসব ভাসমান মানুষের মধ্যে অধিকাংশই জীবন ধারণের জন্য ভিক্ষাবৃত্তিকে বেছে নিয়েছেন। এ ছাড়া ছিনতাই, চুরি, মাদককারবারসহ নানা অপরাধেও জড়ান কেউ কেউ।

রাজধানীতে ভাসমান মানুষের সংখ্যা কতো তার সর্বশেষ পরিসংখ্যান জানাতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা। তবে ২০১৪ সালে পরিসংখ্যান ব্যুরো যে ‘বস্তি শুমারি ও ভাসমান লোক গণনা জরিপ’ প্রকাশ করে, সেই হিসেবে রাজধানীতে বস্তিবাসী ও ভাসমান মানুষের সংখ্যা সাড়ে ছয় লাখ। এরপর পরিসংখ্যান ব্যুরো আর কোনো নতুন জরিপ প্রকাশ করেনি। তবে বিভিন্ন এনজিও সংস্থার হিসেবে, রাজধানীতে ভাসমান মানুষ রয়েছে অন্তত ১ লাখেরও বেশি। তবে বাস্তবে এ সংখ্যা আরো অনেক। যা ক্রমেই বাড়ছে। এর বাইরেও রাজধানীতে অন্তত অর্ধলক্ষাধিক রিকশাচালক রয়েছেন, যারা বিভিন্ন গ্যারেজ ও তার আশেপাশে ভাসমান জীবনযাপন করেন। পরিবার ছেড়ে দলবদ্ধভাবে তারা ফুটপাথেই খুপরি তুলে রাত কাটান।

সরজমিন কাওরান বাজার, বাংলামোটর, ইস্কাটন রোড, ফার্মগেট, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, মতিঝিল, কমলাপুর, গুলিস্তানসহ বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে কয়েকশ’ ভবঘুরে এবং ভাসমান মানুষের দেখা মেলে। দিনের বেলায় এদের এক জায়গায় দেখা না গেলেও রাতে পার্কে কিংবা রাস্তার পাশে একসঙ্গে বিপুলসংখ্যক ভাসমান মানুষ চোখে পড়ে। রাত গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব ভাসমান মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে।

রাত সাড়ে ১০টার দিকে ইস্কাটন রোড ওভারব্রিজ থেকে শুরু করে বাংলামোটর, কাওরান বাজার ও ফার্মগেট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ফুটপাথজুড়ে ও ওভারব্রিজের ওপরে-নিচে কেউ বিছানা করছেন, কেউ কেউ ঘুমিয়ে পড়েছেন। কেউ কেউ আবার নেশায় মেতেছে। এরা সুযোগ পেলেই পথচারীদের ধরে ছিনতাই করে, কেড়ে নেয় টাকা, মোবাইল ফোনসহ সঙ্গে থাকা জিনিসপত্র।

একই চিত্র ফার্মগেট এলাকাতেও। এই এলাকায় আনোয়ারা উদ্যান বা ফার্মগেট পার্কে আগে প্রচুর ভাসমান মানুষ দেখা যেতো। তবে মেট্রোরেলের কাজ শুরু হলে পার্ক বন্ধ করে দেয়ায় অনেকে এই এলাকা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যায়। তবে ফার্মগেট ওভারব্রিজের নিচে ও ওপরে এখনো অনেক ভাসমান মানুষ রাত কাটান। রাত ১০টার দিকে গিয়ে দেখা যায়, ওভারব্রিজের নিচে নোংরা পরিবেশে ঘুমিয়ে রয়েছেন কয়েকজন যুবক। তাদের নারী ও শিশুও রয়েছেন। সঙ্গে থাকা কয়েকজন কিশোর-যুবক পলিথিনে গাম নিয়ে নেশা করছেন, কেউ গাঁজা সেবনও করছেন। এখানে একাধিক মানুষের সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান, আগে এই এলাকায় অনেক মানুষ থাকতো। কিন্তু পার্ক বন্ধ হওয়ায় তারা গুলিস্তান, মতিঝিল, কমলাপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় চলে গেছেন। পরদিন সকালে গিয়েও ওভারব্রিজের নিচে আরো কিছু পরিবারের দেখা মেলে। তাদের মধ্যে একজন ময়মনসিংহ থেকে আসা রুকসানা। সঙ্গে আছেন তার বৃদ্ধ মা। তাদের কোনো ঘরবাড়ি নেই বলে জানান। তাদের জীবিকার উৎস ভিক্ষাবৃত্তি।

বাংলামোটর, ইস্কাটন রোড এলাকায় ফুটপাথে বসবাস করা কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে কথা হয়। তারা দক্ষিণ ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি জেলার স্থায়ী বাসিন্দা। এখানে ফুটপাথেই কয়েকটি পরিবার রান্নার কাজে ব্যস্ত। পথচারীরা বাধ্য হয়ে ফুটপাথ ছেড়ে মূল সড়ক দিয়েই হাঁটছেন। আশেপাশে নোংরা পরিবেশের মধ্যেই শুয়ে আছেন কয়েকজন যুবক। পাশেই একজন তার স্ত্রীর রান্নার কাজে সহযোগিতা করছেন। তিনি জানান, এখানে তারা বেশ কয়েকদিন ধরে বসবাস করছেন। মূলত রিকশা চালাতে বরিশাল থেকে তারা ঢাকায় এসেছেন। গ্রামে বাড়িঘরও আছে। ঢাকায় বাসা ভাড়া করে থাকার সামর্থ্য নেই বলে ফুটপাথেই থাকেন তারা। পুরুষেরা সারাদিন রিকশা চালান। আর নারীরা ফুটপাথে বসে ভিক্ষা করেন। এভাবে ৩-৪ মাস থেকে কিছু টাকা সঞ্চয় করে গ্রামে ফিরে যান। কিছুদিন পর আবার ঢাকায় আসেন।

কাওরান বাজারে কথা হয় শাহেদা নামে এক ভাসমান নারীর সঙ্গে। তার গ্রামের বাড়ি মাদারিপুর। গ্রামে কোনো জায়গা-জমি নেই। কাওরান বাজার মোড়ের পাশে হাতিরপুল অভিমুখে রাস্তার পাশে দুই শিশু সন্তান নিয়ে বসবাস করেন তিনি। তার স্বামী ৫ মাস আগে করোনায় মারা গেছেন। তিনি ফুটপাথে বসে চা বিক্রি করতেন। শাহেদা এখন এই ছোট স্টলটি চালান। রাতে এখানেই দুই সন্তান নিয়ে ঘুমান।

কাওরান বাজার এলাকায় সাড়ে ৭ বছর ধরে থাকেন ভাসমান নারী আনোয়ারা খাতুন। ষাটোর্ধ্ব এই বৃদ্ধের গ্রামের বাড়ি ছিল নরসিংদীর নুরালাপুরে। বর্তমানে তিনি ওয়াসা ভবনের সামনে ওভারব্রিজের নিচে রাত কাটান। তিনি মানবজমিনকে জানান, এক সময় তার সংসার ছিল, বাড়িও ছিল। কিন্তু বর্তমানে পৃথিবীতে তার কিছুই নেই। স্বামী অনেক আগে মারা গেছেন। দুই ছেলে আছে। তারমধ্যে বড় ছেলের বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে পুরো শরীর পুড়ে যায়। সেই ছেলের চিকিৎসা করাতে গিয়ে একমাত্র সম্পদ বাড়িভিটে-জমি বিক্রি করতে হয়। পরে দুই ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় এসে প্রথমে কাজকর্ম খুঁজে না পেয়ে ভিক্ষাবৃত্তি বেছে নেন। তিনি জানান, সাড়ে ৭ বছর এই কাওরান বাজার এলাকায় এভাবে কষ্ট করে থাকেন তিনি। সারাদিন ভিক্ষা করেন আর রাতে এসে অন্যদের মতো তিনিও ওভারব্রিজের নিচে ঘুমিয়ে পড়েন। আশেপাশে কোনো পাবলিক টয়লেট না থাকায় বেশিরভাগ সময় রাস্তার পাশেই প্রয়োজনীয় কাজ সারেন। বেশি জরুরি হলে কাওরান বাজার এলাকায় গিয়ে টাকার বিনিময়ে টয়লেট করতে হয়। প্রতিদিন নিয়ম করে গোসল করা হয় না। তাই মাঝে মাঝে পাবলিক টয়লেটে গিয়ে গোসল করেন। শুধু আনোয়ারা খাতুন নন, এই এলাকায় এ রকম আরো বহু মানুষ রয়েছেন। এ ছাড়া কাওরান বাজারের আশেপাশে কুলি মজুর তাদের ব্যবহৃত বড় আকারের ডালার মধ্যেই ঘুমিয়ে রাত কাটিয়ে দেন।

গুলিস্তানের নগর ভবন ও সচিবালয় সংলগ্ন প্রায় ২৩.৩৭ একর জায়গাজুড়ে ওসমানী উদ্যানের অবস্থান। প্রতিরাতে এই উদ্যানে ঘুমান কয়েকশ’ ভাসমান নারী-পুরুষ। এ ছাড়া গুলিস্তান এলাকায় স্টেডিয়াম মার্কেটের আশেপাশে এবং রাজউক ভবন এলাকায় শত শত ভাসমান মানুষ রাতে ঘুমান। সরজমিন গিয়ে একাধিক ভাসমান নারী-পুরুষের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর এসব ভাসমান মানুষের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নানা পরিকল্পনার কথা বলা হলেও তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনেরও নেই কোনো কার্যকরী উদ্যোগ। সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা ভাসমান মানুষের নির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান দিতে পারেনি। জানাতে পারেনি কোনো পরিকল্পনার কথাও। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীসহ সারা দেশেই বিপুলসংখ্যক মানুষ গৃহহীন অবস্থায় রয়েছে। রাষ্ট্রের কাছে এসব মানুষের খাদ্য, বাসস্থান ও চিকিৎসা সহায়তা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। রাষ্ট্রের অন্য নাগরিকদের নিয়ে যেমন ভাবনা রয়েছে, একইভাবে এসব ভাসমান মানুষদের নিয়েও সমানতালে ভাবতে হবে। তাদের জীবনমান উন্নয়নে সরকারের কার্যকরী উদ্যোগ নেয়া জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা মোহাম্মদ মামুন-উল-হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে জানান, তিনি এই বিভাগে অল্পদিন ধরে এসেছেন। তাই এ ব্যাপারে তার কাছে কোনো তথ্য আপাতত নেই। তবে দক্ষিণ সিটির প্রধান সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা আকন্দ মোহাম্মদ ফয়সাল উদ্দিন মানবজমিনকে বলেন, রাজধানীতে কী পরিমাণ ভাসমান মানুষ রয়েছে এর নির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই। আসলে পরিসংখ্যান ব্যুরো এই তথ্যটি বের করে থাকে। তবে সিটি করপোরেশন বেসরকারি সংস্থাগুলোকে সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন প্রকল্প করে থাকে। ভাসমান মানুষদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য সংস্থাগুলোর সঙ্গে সিটি করপোরেশন যৌথভাবে কাজ করে। এ ব্যাপারে কার্যক্রম আছে। যেমন তাদেরকে বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণ দেয়া এবং টয়লেট ফেসিলিটি দেয়া, এই কাজগুলো সংস্থাগুলো করে থাকে।


 
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status