অনলাইন

অক্সফোর্ডেরও ১০০ বছর আগে বাংলায় ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়!

বাংলার এক গৌরবময় অধ্যায়: পাল সাম্রাজ্যের একাংশ

রিফাত আহমেদ

৫ মার্চ ২০২১, শুক্রবার, ১০:০২ পূর্বাহ্ন

পলকহীন দৃষ্টিতে মুগ্ধ হয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে আছেন একজন ব্যক্তি। চোখের সামনে বিশাল স্থাপনা, সোমপুর বৌদ্ধ বিহার। একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু হলেও এখনও অনেক কিছুই তার জ্ঞানের পরিধির বাইরে। ১৮৭৯ সালে স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম এই বিশাল সোমপুর বিহার আবিষ্কার করেছেন এবং এতো বড় বৌদ্ধ বিহার ভারতবর্ষে আর দেখা যায় নি -এই সামান্য তথ্যের বাইরে আর তেমন কিছুই জানা নেই তার। নওগাঁ আগেও একবার আসা হয়েছিলো, কিন্তু পাহাড়পুরে এবারই প্রথম। “ভাগ্যিস ধর্মপাল মহাশয় তৈরি করেছিলেন এই অভূতপূর্ব বিহার!”, হঠাৎ পাশ থেকে এই বাক্য শুনে চমকে উঠলেন তিনি। পাশে তাকিয়ে দেখলেন, তার মতোই আরেকজন ভিক্ষু, কিন্তু চোখ-মুখ কেমন দীপ্তিময়! বোঝাই যাচ্ছে, ইনি অনেক অভিজ্ঞ ব্যক্তি। কৌতুহল দমন করতে না পেরে জিজ্ঞাসা করেই বসলেন পাশের ব্যক্তিকে যে, তার উক্তিটির মর্মার্থ কি, কে এই ধর্মপাল, আর কেনোই বা নির্মিত হয়েছে চমৎকার সব বিশাল বিশাল বৌদ্ধ বিহার। বিজ্ঞ ভিক্ষু স্নিগ্ধ একটি হাসি দিয়ে তাকে বললেন, “যে ইতিহাস আমাদের গৌরবমাখা, যে ইতিহাসে এতো ছন্দ, এতো নাটকীয়তা, সে ইতিহাস আমি বার বার বিরামহীনভাবে বলে যেতেও বিন্দুমাত্র ক্লান্তিবোধ করি না। চলুন তবে শুরু করা যাক। প্রায় দেড় হাজার বছর পুরনো গুরুত্বপূর্ণ এক ইতিহাসের অবতারণা আরও একবার হলে মন্দ হয় না”।

সে এক ভীষণ অরাজকতার সময়। আমাদের এই বাংলার প্রথম স্বাধীন সম্রাট গৌড়েশ্বর শশাঙ্ক মারা যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই চরম অরাজকতায় ছেয়ে যায় এই অঞ্চল। মাত্র আট মাসের মাথায় রাজাধিরাজ শশাঙ্কের ছেলে মানব ক্ষমতাহীন হয়ে পড়েন এবং বাংলা পরিণত হয় শাসকবিহীন এক অঞ্চলে। এটি ছিলো মাৎস্যন্যায় যুগ। এ সময় স্বার্থ হাসিলের তাগিদে বিনা বিচারে দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার চরম আকার ধারণ করেছিলো, বিষয়টা ঠিক ছোট মাছকে বড় মাছের খেয়ে ফেলার মতো। এ জন্যই এই সময়কে ‘মাৎস্যন্যায়’ বলা হয়েছে।

বিজ্ঞ ব্যক্তিরা একসময় বুঝতে পারলেন যে এই অরাজক পরিস্থিতি আর বেশি দিন চলতে দেয়া যায় না, এভাবে তো বাংলার অস্তিত্বই বিলীন হয়ে যাবে। তাই ঝগড়া-বিবাদ ভুলে অবশেষে গণতান্ত্রিকভাবে একজন ‘রাজা’ নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। এরই ধারাবাহিকতায় অষ্টম শতাব্দীর মধ্যভাগে ‘গোপাল’ নামক একজন সুনিপুণ যোদ্ধা ‘রাজা’ হিসেবে নির্বাচিত হলেন। ইতিহাসের পাতায় এই গণতান্ত্রিক নির্বাচন ছিলো একটি যুগান্তকারী ঘটনা। নতুন নির্বাচিত রাজা গোপাল ছিলেন বরেন্দ্র অঞ্চল (বর্তমান উত্তরবঙ্গ) এর অধিবাসী। তিনিই উপমহাদেশের সর্বপ্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নায়ক। তিনি ছিলেন সর্ববিদ্যাবিশুদ্ধ দয়িতবিষ্ণুর পৌত্র এবং যুদ্ধ ব্যবসায়ী বপ্যটের ছেলে। ‘পাল’ রাজবংশের শুরু তার হাত ধরেই। প্রাকৃত ভাষায় ‘পাল’ শব্দটির অর্থ হলো ‘রক্ষাকর্তা’। পাল রাজারা ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী, কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্তও তারা রেখে গিয়েছিলেন। এটিই ছিলো তাদের সমৃদ্ধির পথের সোনার চাবি।

রাজা হবার পর গোপাল কঠিন হাতে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন এবং শতবর্ষব্যাপী চলমান নৈরাজ্যের মধ্য থেকে বাংলাকে একটি স্থিতিশীল অবস্থায় আনতে সক্ষম হন। রাজ্যে স্থিতিশীলতা ও শান্তি-সমৃদ্ধি আনয়নে গোপাল এতোটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে রাজ্যের বিস্তারে তিনি তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারেন নি। রাজ্য বিস্তারের দায়িত্ব পালন করেছেন তার উত্তরসূরি ধর্মপাল।

রাজা গোপালের মৃত্যুর পর খ্রিস্টপূর্ব ৭৭০ অব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন তার ছেলে ধর্মপাল। ধর্মপাল হলেন ‘পাল’ বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা। তিনি অত্যন্ত যোগ্যতা ও দক্ষতার সাথেই শাসনভার পালন করেছিলেন। বাংলার শক্তি ও সমৃদ্ধি তিনি অনেকাংশেই বৃদ্ধি করেছিলেন। ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে ধর্মপালই প্রথম বাংলাকে আঞ্চলিক রাজ্য থেকে সর্বভারতীয় সাম্রাজ্যের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তার আর্যাবর্তে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা অনেকাংশে সফল হওয়ার কারণেই গুজরাটের কবি সোঢঢল তাকে ‘উত্তরাপথস্বামী’ বলে অভিহিত করেন।

ধর্মপাল এসে রাজ্যের বিস্তারও করলেন, আবার জ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতায়ও মন দিলেন। তিনি ছিলেন একাধারে বীর, সাহসী ও রাজনীতিকুশল। সবচেয়ে গর্বের বিষয় হলো, ধর্মপাল দিল্লী থেকে শুরু করে আফগানিস্তান পর্যন্ত পাল রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, যদিও শেষ পর্যন্ত তা ধরে রাখতে সক্ষম হন নি। সম্রাট কনিষ্কেরও আগের সময় থেকে সবচেয়ে শক্তিশালী অঞ্চল মগধকে জয়ও করেছেন সবচেয়ে শক্তিশালী শাসকরা, আর ধর্মপালও তাদের মধ্যে একজন। তিনি মগধ ও বিহার জয় করে পাটালিপুত্রে রাজধানী স্থাপন করেছিলেন।

বাংলার সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক উৎকর্ষতায় ধর্মপালের অবদান অনেক বেশি। সে সময় বাংলার মাঠে-ঘাটে, ঘরে-বাইরে লোকমুখে ছিলো শুধু ধর্মপালেরই গুণগান।

২০১৬ সালে নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার গড় ধর্মপাল (পাল রাজা ধর্মপালের নামানুসারেই এলাকার নাম রাখা হয়েছিলো ‘গড় ধর্মপাল’) ইউনিয়নে ধর্মপালের একটি দুর্গের সন্ধান পাওয়া গেছে, বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খনন কাজ পরিচালনার মাধ্যমে। বলা হয়ে থাকে যে, প্রাচীন বাংলার অন্যতম শাসক ধর্মপাল বাংলাসহ উত্তর ভারতের রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ইতিহাসের পাতায় বিখ্যাত হয়ে আছেন।

ধর্মপালের সময়ে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা হচ্ছে ‘ত্রিমুখী যুদ্ধ’। নবম শতকের শুরুতে বিতর্কিত এই ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষের মূল নায়ক ছিলেন ধর্মপাল। সে সময় ধর্মপালের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন প্রতীহার বংশীয় (এরা মূলত গুর্জ্জর জাতি; যারা হুণদের পরে এসে পাঞ্জাব, রাজপুতানা ও মালবে ছোট ছোট রাজ্য স্থাপন করেছিলো) রাজা বৎসরাজ। মগধ জয়ের পর ধর্মপাল দোয়াবের এলাহাবাদ পর্যন্ত গঙ্গা নদীর উপকূল ঘেঁষে এগিয়ে যেতে থাকেন। অপরদিকে প্রতীহার রাজা বৎসরাজও মধ্যাঞ্চলে তার আধিপত্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসেন এবং দোয়াব এলাকায় এসে রাজা ধর্মপালকে বাধা দেন। এতে দুই পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে বহু সেনা নিহত হয় এবং ধর্মপাল পরাজিত হন। তবে এ সময় দৃশ্যপটে অন্যদিক থেকে আগমন ঘটে রাষ্ট্রকূটরাজ ধ্রুবধারাবর্ষের। তিনিও তখন উত্তরের দিকে তার সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য বেরিয়েছিলেন। ফলে পথিমধ্যে তার মুখোমুখি হন প্রতীহার রাজা বৎসরাজ। ধ্রুবধারাবর্ষ এগিয়ে এসে আক্রমণ করেন বৎসরাজকে। ঐদিকে ধর্মপালের সাথে যুদ্ধ করে বৎসরাজ অনেক সৈন্য হারিয়েছেন এবং রসদ শক্তিও ক্ষয় করেছেন। ফলে নতুন করে যুদ্ধের মুখে পড়ে ধ্রুবধারাবর্ষের কাছে পরাজিত হন তিনি। ধ্রুবধারাবর্ষ পরাজিত বৎসরাজকে বিতাড়িত করেন রাজপুতানার মরু অঞ্চলের দিকে। তারপর তিনি এগিয়ে আসেন বরেন্দ্রভূমির ধর্মপালের দিকে। গঙ্গা ও যমুনার মধ্যবর্তী অঞ্চলে ধ্রুবধারাবর্ষ ও ধর্মপালের মধ্যে আরেক দফা যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিলো। ধর্মপালের সেনাবাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি কম হলেও, ত্রিমুখী যুদ্ধে হেরে যান তিনি। কিন্তু ধ্রুবধারাবর্ষ এ যুদ্ধে জিতলেও তার নিজ রাজ্য দাক্ষিণাত্যের নিরাপত্তার জন্য বিজিত অঞ্চলে আধিপত্য স্থায়ী করার কোনো ব্যবস্থা না করেই নিজ রাজ্যে ফিরে যান। ত্রিপক্ষীয় এ যুদ্ধে বৎসরাজ ও ধ্রুবধারাবর্ষ দুজনেই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হলেও ধর্মপাল ছিলেন মোটামুটি সুবিধাজনক অবস্থানে। কারণ কুশলী ভূমিকার জন্য যুদ্ধগুলোতে তার তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয় নি এবং হেরে গেলেও ভাগ্যক্রমে তিনিই কনৌজের ক্ষমতা পান। ধর্মপাল কিছুদিনের মধ্যেই কনৌজরাজ ইন্দ্রায়ুধকে পরাজিত করে ক্ষমতায় আসীন করেন তার অনুগত চক্রায়ুধকে। এর মাধ্যমে ধর্মপাল বাংলা, বিহারের সীমানা ছাড়িয়ে আধিপত্য বিস্তারে সমর্থ হন উত্তর ভারতীয় অঞ্চলেও। সেখানে তিনি তার দরবারে বিরাট অভিষেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন; যেখানে ভোজ, মৎস্য, কুরু, যদু, যবন, অবন্তি, গান্ধার, কীর প্রভৃতি জনপথের রাজারা আমন্ত্রিত হয়ে আসেন এবং তার বশ্যতা স্বীকার করে নেন। এর ফলে তার অধিকার বর্তমান মধ্য প্রদেশ, রাজস্থান, পাঞ্জাব ও পাকিস্তানের সিন্ধু নদ উপত্যকা পর্যন্ত বিস্তৃত হয় এবং বাংলা অঞ্চল হয়ে ওঠে সকলের কাছে ঈর্ষনীয় বিষয়। ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষের পর ভারতবর্ষের মধ্যাঞ্চলে ধর্মপালের প্রভাব ও ক্ষমতা তাকে বিখ্যাত শাসক হিসেবে পরিচিত করে তোলে। এ সময় তিনি উত্তর ভারতের অবিসংবাদিত সম্রাটে পরিণত হয়েছিলেন। বাংলা ও বিহার সরাসরি ধর্মপালের নিজের শাসনাধীন ছিলো, অন্য রাজ্যগুলো ধর্মপালের অধীনে অন্য শাসকরা শাসন করতেন।

ধর্মপালের জীবনে ত্রিমুখী যুদ্ধের দামামা আরও একবার বেজেছিলো। তার চির-প্রতিদ্বন্দ্বী বৎসরাজের ছেলে নাগভট্টের সাথে আবারও যুদ্ধ হয় ধর্মপালের। এবারও ধর্মপাল পরাজিত হন। কিন্তু আরেক দিকে ধ্রুবধারাবর্ষের ছেলে তৃতীয় গোবিন্দের সাথেও নাগভট্টের যুদ্ধ বাঁধে। নাগভট্ট পরাজিত হন এবং গোবিন্দও তার বাবার মতোই দক্ষিণাপথে ফিরে গিয়েছিলেন। ফলে এবারও ধর্মপালই লাভবান হন, কারণ তার আর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী অবশিষ্ট রইলো না। তবে গোবিন্দ এবার বিনা কারণে ধর্মপালকে সহায়তা করেন নি। নিজ কন্যা রন্নাদেবীকে ধর্মপালের সাথে বিয়ে দিয়ে নিজেদের শক্তিকে পাকাপোক্ত করার একটি সুপ্ত বাসনা ছিলো তার মনে। ওদিকে ধর্মপাল ও রন্নাদেবীও পরস্পরকে কম পছন্দ করতেন না। তাই গোবিন্দের প্রস্তাব পেয়ে ধর্মপাল আর দেরী করলেন না। অবশেষে রাষ্ট্রকূট রাজকন্যা রন্নাদেবী হলেন ধর্মপালের সহধর্মিণী।

ধর্মপাল বহু বৌদ্ধ মঠ, বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ করেছিলেন। তিনি বর্তমান নওগাঁর পাহাড়পুরে সোমপুর বিহার (আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়) এবং বিহারের ভাগলপুরে বিক্রমশীল বিহার (ধর্মপালের আরেকটি নাম ‘বিক্রমশীল’ থেকেই এই বিহারের নামকরণ হয়েছে) বা বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করেছিলেন। ধর্মপালের বাবা গোপালও একটি বিহার তৈরি করেছিলেন, যেটি ‘উদন্তপুরী বিহার’ নামে পরিচিত। এগুলোই প্রাচীন ভারতবর্ষের বিশ্ববিদ্যালয়, যেগুলো পরবর্তী ৩০০-৪০০ বছর ধরে বৌদ্ধ ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়াও বাস্তুশাস্ত্র, আয়ুর্বেদ, জ্যোতিষশাস্ত্র ও আরো অনেক বিষয়ে শিক্ষা দিয়ে থাকতো। এখানে পন্ডিত অতীশ দীপঙ্কর ও শাক্য শ্রীভদ্রও শিক্ষক হিসেবে ছিলেন। জানা যায়, ধর্মপাল প্রায় ৫০ টি বড় বড় বৌদ্ধ বিদ্যালয়ও তৈরি করেছিলেন। বিক্রমশীল বিহার তো নালন্দা বিহারের মতোই সমগ্র ভারতবর্ষে প্রসিদ্ধ ছিলো। এতে ছিলো একটি প্রধান মন্দির ও তার চারদিকে ১০৭ টি ছোট ছোট মন্দির। এটি ছিলো ১১৪ জন শিক্ষকের অধ্যাপনায় পরিচালিত একটি উচ্চশিক্ষাকেন্দ্র।

ধর্মপালের মৃত্যুর পর তার বড় ছেলে ত্রিভুবন পালের রাজা হওয়ার কথা থাকলেও ত্রিভুবন পাল হঠাৎ মারা গেলে ধর্মপালের ছোট ছেলে দেবপাল হন পরবর্তী রাজা। দেবপালের আমলে বাংলার বিস্তার ছিলো সবচেয়ে মুখ্য ঘটনা। কিন্তু তাতে দেবপালের চেয়ে তার সেনাপতি ও মন্ত্রীবর্গের অবদান ছিলো অনেক বেশি। দেবপালের সব কাজে তার সার্বক্ষণিক সাথী ছিলেন মহামন্ত্রী দর্ভপাণি।

দেবপালের মৃত্যুর পর ধর্মপালের ভাই বাকপালের পৌত্র ও জয়পালের ছেলে বিগ্রহপাল সিংহাসনে বসেন এবং এর পর যথাক্রমে নারায়ণপাল, রাজ্যপাল, দ্বিতীয় গোপাল, দ্বিতীয় বিগ্রহপাল, মহীপাল প্রভৃতি পাল রাজার দেখা পাওয়া যায়। সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী (প্রায় ৪০০ বছর) শাসনামল ছিলো পাল শাসনামল। আর তাই এ ধারা একটি সাম্রাজ্যে সীমাবদ্ধ থাকে নি। যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় পাল সাম্রাজ্য দেখার সৌভাগ্যও বাংলার মানুষের হয়েছে।

পাল রাজত্বের ৪০০ বছরকে বাঙালির আত্মপ্রতিষ্ঠার যুগ বললে কোনো ভুল হবে না। পাশ্চাত্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কতো দিনের পুরনো? প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় বলতে আমরা তো শুধু অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয়কেই বুঝি। প্রাথমিকভাবে এগুলো ধর্মীয় শিক্ষার পীঠস্থান ছিলো, পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়। বারো বা তেরো শতক থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা যায়। অক্সফোর্ড এদের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন বলেই আমরা জানি। কিন্তু এই তথ্য আমরা অনেকেই জানি না যে, এই অক্সফোর্ডেরও ১০০ বছর আগে বাংলায় ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়। ভারত উপমহাদেশের বিহারে অবস্থিত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় পঞ্চম শতকের কাছাকাছি কোনো সময়ে গড়ে উঠেছিলো। পাল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা বিক্রমশীল বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো অষ্টম শতকের আরো কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রীই ছিলো বাঙালি।

মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর উত্তর ভারতবর্ষে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের উপর ব্রাহ্মণ্যবাদের অত্যাচার অনেক বেড়ে যায়। তাই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা পূর্ব দিকে অগ্রসর হতে থাকে এবং বহু বিহার নির্মাণ করে। জ্ঞানের যথাযথ আদান-প্রদানই মূলত এতো এতো বিহার তৈরির মুখ্য উদ্দেশ্য। বৌদ্ধ ধর্মে ‘নির্বাণা’ বলে একটি শব্দ আছে, ‘নির্বাণা’ বলতে মূলত ‘মোক্ষলাভ’ বোঝায়।

পাল রাজাদের আমলে বৌদ্ধ ধর্ম বিকাশ লাভ করতেই থাকে। ধর্মপালের পৃষ্ঠপোষকতায় বৌদ্ধ ধর্ম যেনো এক নতুন জন্ম নেয়। গুপ্তযুগের প্রধান ধর্ম বৌদ্ধ ধর্ম না হলেও তখন বৌদ্ধ ধর্ম বেঁচে ছিলো একটি ধর্ম হিসেবে। চীনা পরিব্রাজকরা সপ্তম শতকে বাংলা ভ্রমণের পর বাংলায় প্রায় ৩০ টিরও বেশি মহাবিহারের কথা উল্লেখ করেন। যে কোনো প্রতিষ্ঠানই সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হবার জন্য রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ও একসময় অনেক রমরমা ছিলো, কিন্তু রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা কমে যাওয়ার কারণে তা স্তিমিত হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে ধর্মপালের পৃষ্ঠপোষকতায় সোমপুর বিহার ও একের পর এক অন্যান্য বিদ্যাপীঠ গড়ে ওঠে এবং দীর্ঘদিন সেগুলো নিজেদের উদ্দেশ্য ধরে রাখতে সক্ষম হয়। কিন্তু আমরা এমন অমূল্য জ্ঞানের আদান-প্রদানের কথা মনে রাখতে পারিনি। এ তো আমাদেরই ব্যর্থতা। আমরা এ-ও ভুলে যাই যে, উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় বিহার সোমপুর বিহারের গর্বিত উত্তরাধিকারী তো আমরাই। আমাদের এখানেই দূর-দূরান্ত থেকে জ্ঞানের অন্বেষণের জন্য ছুটে আসতে হয়েছিলো সবাইকে। আমরা দীর্ঘমেয়াদী শাসনের ক্ষেত্রে ‘ব্রিটিশ পিরিয়ড’ এর কথা মনে রেখেছি, কিন্তু সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী শাসন যে পাল সাম্রাজ্যের রাজাদের থেকে আমরা পেয়েছি সে কথা বেমালুম ভুলে যেতেও আমাদের দ্বিধাবোধের অভাব। ৪০০ বছরের এতো গুরুত্বপূর্ণ ও গৌরবময় সময়ের মূল্যায়ন আমাদেরকেই করতে হবে। কেননা আমরাই এ গৌরবের, এ সম্মানের প্রকৃত হকদার।

[লেখকঃ চেয়ারপার্সন, সিদ্দিকি’স ইন্টারন্যাশনাল স্কুল। কোষাধ্যক্ষ, বাংলাদেশ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল’স এসিস্ট্যান্স ফাউন্ডেশন। ইতিহাস, বিজ্ঞান নিয়ে লেখা staycurioussis.com (বাংলা এবং ইংলিশ) ওয়েবসাইটের প্রতিষ্ঠাতা।]
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status