এক্সক্লুসিভ

লালদিয়ার চরের কান্না

চট্টগ্রাম সংবাদদাতা

৪ মার্চ ২০২১, বৃহস্পতিবার, ৮:১৩ অপরাহ্ন

৭৫ বছরের বৃদ্ধ মোহররম আলী। স্কুলপড়ুয়া দুই নাতিকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন একটি বন্ধ চায়ের দোকানের সামনে। পাশে স্তূপ করে রাখা বসতঘরের টেবিল-চেয়ারসহ পরিবারের ব্যবহার্য মালামাল। চোখে-মুখে হতাশার ছাপ। জিজ্ঞেস করতেই ভেঙে পড়লেন কান্নায়। বললেন, আমাদের তো সব শেষ।’

গত ১লা মার্চ চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তীরসংলগ্ন লালদিয়ার চরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়। এতে বিপাকে পড়েন ২৩০০ পরিবার। পুনর্বাসন না করেই প্রায় অর্ধশত বছরের আবাস থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে তাদের। অসহায় এসব মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁই কোথায় হবে তার কিছুই জানেন না তারা।

গত সোমবার সকাল সোয়া ১০টা থেকে লালদিয়ার চরে অবৈধ উচ্ছেদে নামে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। ৬ জন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে এই অভিযানে এক হাজারেরও বেশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য অংশ নেয়। অভিযানের মধ্য দিয়ে এখানকার ২৩শ’ পরিবারের প্রায় ১৫ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হলো। অভিযানের পর সরজমিন দেখা যায়, আশেপাশে শত শত ভ্যান-পিকআপ সারিবদ্ধ করে দাঁড় করানো রয়েছে। সেখানকার বাস্তুচ্যুত অনেকে ঘরের ইট, দরজা-জানালা নিয়ে যাচ্ছে খুলে। কেউ ঘরের চালার টিন নিচ্ছে, কেউ কেউ নিচ্ছে থালাবাসন। আবার কেউ কোথাও যাওয়ার সুযোগ না থাকায় হা-হুতাশ করছেন।

জানা যায়, ৫৬ একর ভূমির উপর গড়ে ওঠা আলোচিত লালদিয়ার চরটি মূলত চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিত্যক্ত সম্পত্তি ছিল। ১৯৭২ সালে সার্জেন্ট জহুরুল হক ঘাঁটি নির্মাণ করতে পার্শ্ববর্তী পতেঙ্গা এলাকার কয়েক হাজার স্থানীয় বাসিন্দাকে সরিয়ে এই লালদিয়ার চরে পুনর্বাসন করেন তৎকালীন সরকার। সে সময় পরিবারগুলোকে বন্দরের এই জায়গায় স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি দেয়া হয়। যদিও এই ৪৯ বছরে কোনো সরকারের আমলেই এই কথা রাখা হয়নি। সর্বশেষ বন্দর কর্তৃপক্ষ এখানকার বাসিন্দাদের চলে যেতে নোটিশ দেয়। যা আদালত হয়ে সোমবারের উচ্ছেদ পর্যন্ত গড়ায়।

লালদিয়ার চরের ১০ নং ঘাট এলাকায় পরিবার নিয়ে থাকতেন আব্দুল করিম। করোনার কারণে গত বছরের মাঝামাঝি থেকে বেতন পান না। এখন পাঠাও রাইড দিয়ে ৫ জনের সংসার চালান নগরীর খুলশী এলাকার একটি বেসরকারি স্কুলের এই গণিতের শিক্ষক। এখন আবার বন্দরের উচ্ছেদে বাপ-দাদার দেয়া শেষ সম্বলটুকুও হারিয়ে অনেকটা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন তিনি। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বাস্তুহারা এই শিক্ষক মানবজমিনকে বলেন, জহুরুল হক বিমান ঘাঁটিতে ছিল আমাদের বাপ-দাদার ভিটেবাড়ি। যুদ্ধের পর বিমান ঘাঁটি সমপ্রসারণের সময় স্থায়ী বন্দোবস্ত দেয়ার কথা বলে নিজেদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে লালদিয়ার চরে আনা হয়েছিল আমাদের। সরকারের প্রয়োজনে নিজের বাপ-দাদারা ভিটেমাটি ছেড়ে এসেছেন, আর এখন কোনো পুনর্বাসন না করেই এখান থেকে তাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। আক্ষেপ করে এই শিক্ষক বলেন, সরকার লাখ লাখ ভিনদেশি রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছেন। তাদের ভরণপোষণ করছেন। এখন আমরা কি এদের চেয়েও নিকৃষ্ট হয়ে গেলাম। দেশের জন্য নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে নিজেদেরকেই ভবঘুরে হয়ে থাকতে হবে।’

চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সেক্রেটারি নুরুল আজিম রনি বলেন, ‘জাতির জনকের আহ্বানে এসব মানুষ একসময় তাদের বসতভিটে ছেড়ে দিয়েছিল। আর এখন অসহায়ের মতো রাস্তায় ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক বলেন, এখানে উচ্ছেদের কিছু নেই। বন্দর কর্তৃপক্ষ হাইকোর্টের রায়ের ভিত্তিতে নিজেদের সম্পত্তি পুনরুদ্ধার করেছে। তবে মানবিক দিক বিবেচনায় সত্যিকারের ক্ষতিগ্রস্তদের কিছু সহযোগিতা করা হবে।


 
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status