প্রথম পাতা

অবৈধ বিট কয়েনের রমরমা বাজার

শুভ্র দেব

২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১, বুধবার, ৯:৪০ অপরাহ্ন

দেশে নিষিদ্ধ বিট কয়েনের (ক্রিপ্টোকারেন্সি/ ভার্চ্যুয়াল মুদ্রা) বাজার রমরমা হচ্ছে। বিট কয়েন কেনাবেচাকে ঘিরে সক্রিয় একাধিক চক্র। এসব চক্র অবৈধ এই বিট কয়েন কেনাবেচা করে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা জানিয়েছেন, অর্থপাচারের নতুন মাধ্যম হচ্ছে বিট কয়েন। এরমাধ্যমে শুধু অর্থ পাচার নয়, জঙ্গি অর্থায়নও হচ্ছে। এছাড়া যেকোনো ধরনের কালো টাকা এক দেশ থেকে অন্যদেশে স্থানান্তরের বা অবৈধ মাদক ব্যবসা, অস্ত্র, অবৈধ যন্ত্রপাতি কেনা-বেচার ক্ষেত্রে ব্যবহার হচ্ছে। বিগত কয়েক বছরে দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে বিপুল অঙ্কের টাকা। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ও র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) বিট কয়েনের সঙ্গে জড়িত কয়েকটি চক্রের সন্ধান পেয়েছে। এসব চক্রের ১০ জন সদস্যকে বিগত কিছুদিনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের মধ্যে মাস্টারমাইন্ডরা রয়েছে। গ্রেপ্তারের পর এই হোতারা দিয়েছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। তাদের মতে, দেশের অন্তত শতাধিক ব্যবসায়ী এই বিট কয়েনের সঙ্গে জড়িত।

গত শনিবার গোয়েন্দা পুলিশের তেজগাঁও ডিভিশন সাতরাস্তা থেকে বিট কয়েন কেনাবেচা করার সময় মাহমুদুর রহমান জুয়েল (২৭) নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে। জুয়েল বিট কয়েন, ইথিরিয়াম, ইউএসডিটি কেনাবেচা করতো। তার ব্যবহৃত মোবাইলের দু’টি ডিভাইসে তিনটি অ্যাকাউন্ট পাওয়া যায়। ব্লক চেইন, বাইনান্স ও কয়েন বেইজ এই তিনটি অ্যাপের মাধ্যমে বিট কয়েন কেনাবেচা করতো। বিট কয়েন কেনাবেচার জন্য জুয়েল মালয়েশিয়া, দুবাই ও ভারতসহ বিভিন্ন দেশে একাধিকবার যাতায়াত করেছে। ২০১৬ সালের শেষের দিকে মালয়েশিয়া থাকাকালীন তার এক আত্মীয়ের মাধ্যমে প্রথম এই আইডিয়া পায়। তারপর থেকে পুরোপুরি এই অবৈধ বিট কয়েন কেনাবেচায় জড়িত হয়। প্রাথমিকভাবে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানতে পেরেছেন, জুয়েল বিপুল পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচার করেছে। তার অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে একবারে সর্বোচ্চ ২১ হাজার ডলার লেনদেন করেছে। ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে সে জানিয়েছে, বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ী ও যাদের কাছে কালো টাকা আছে তারাই তার কাছ থেকে বিট কয়েন সংগ্রহ করেন। পরে বিভিন্ন কেনাকাটার কাজে ও অর্থ পাচারের জন্য এটি ব্যবহার করা হয়। গ্রেপ্তার জুয়েল বিট কয়েন কেনার অর্থ সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে এমএলএম পদ্ধতিতে টাকা নিয়েছিলেন। পরে লাভের টাকা থেকে তাদেরকে পরিশোধ করার কথা ছিল।

চলতি বছরের ১২ই জানুয়ারি র‌্যাব রায়হান হোসেন (২৯) নামের এক প্রতারককে গ্রেপ্তার করে। সে বিট কয়েন বিক্রি ও প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছিল এবং ভার্চ্যুয়াল মুদ্রা কেনা-বেচার মাস্টারমাইন্ড ছিল। প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়া এসব অর্থ রায়হান বিদেশে পাচার করতো। অল্প দিনেই কোটিপতি বনে যাওয়া রায়হান এক কোটি টাকা দামের গাড়িতে চলাফেরা করতো। থাকতো দামি ফ্ল্যাটে। বিট কয়েনের কেনা-বেচার বিষয়ে র‌্যাবের সাইবার মনিটরিং সেলের গোয়েন্দা নজরদারি ও ছায়াতদন্তের মাধ্যমে বের হয়ে আসে একটি চক্র বিট কয়েন কেনা-বেচা ও বিভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। এই চক্রটিকে শনাক্ত করতে গিয়ে রায়হানের নাম উঠে আসে। পরে তাকে গাজীপুরের সফিপুর এলাকা থেকে আটক করে র‌্যাব-১। তখন তার একটি অ্যাকাউন্টে ৫৪ লাখ টাকা পাওয়া যায়। এছাড়া ২৭১টি অ্যাকাউন্টে মাত্র এক মাসে ৩৫ হাজার ডলার লেনদেন করেছিল। পাকিস্তান রাশিয়া ও নাইজেরিয়ার বাসিন্দাদের সঙ্গে মিলে এই বিট কয়েন কেনা-বেচা করতো রায়হান। মাত্র অষ্টম শ্রেণি পাস রায়হান ২০০৬ সালে ব্যক্তিগত আগ্রহে কম্পিউটারের ওপর প্রশিক্ষণ নেয়। এরপর ওয়েব ডেভেলপমেন্টের কাজ করে। ২০২০ সালের জুন মাস থেকে পাকিস্তানি নাগরিক সাইদ (২২) এর সহায়তায় প্রতারণা করে অর্থ হাতিয়ে নেয়া শুরু করে। সে পাকিস্তান, নাইজেরিয়া এবং রাশিয়ান স্মাগলার, ক্রেডিট কার্ড হ্যাকার, ক্রেডিট কার্ড হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে ভার্চ্যুয়াল মুদ্রা বিট কয়েন ক্রয় করতো। স্মার্ট ডিভাইস ব্যবহার করে নামে-বেনামে দেশি-বিদেশি অনলাইন ব্যাংক হিসাব তদারকি করতো। তারও আগে ২০১৮ সালের ২৮শে নভেম্বর র‌্যাব-২ বিট কয়েন ব্যবসায় সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে ৮ জনকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃতদের মোবাইল ফোনে বিট কয়েনের কার্যক্রম সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য পায় আভিযানিক দল। ওই বছর সেপ্টেম্বরে যাত্রাবাড়ী থেকে বিট কয়েন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে আরো একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, বিট কয়েনে লোকসানের কোনো রেকর্ড থাকে না। এটি নিয়ে বিভিন্ন ফেরামে আলোচনা চলছে। জি-২০ এর সম্মেলনেও এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। এই প্লাটফর্ম ব্যবহার করে বিদেশে যে অর্থ পাচার করা হচ্ছে তার বেশিরভাগই কালো টাকা। দেশের অন্তত শতাধিক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী এরসঙ্গে জড়িত। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা তাদের একটি তালিকা নিয়ে কাজ করছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশকমিশনার গোলাম মোস্তফা রাসেল মানবজমিনকে বলেন, বিট কয়েন বর্তমান বিশ্বে অনলাইন লেনদেন করার একটি জনপ্রিয় ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম। অনেক দেশে এর বৈধতা দেয়া হলেও আমাদের দেশে এটা অবৈধ ও নিষিদ্ধ। তার পরও কিছু লোক দেশে বসে এই লেনদেন করছে এমন তথ্য ডিবি’র কাছে ছিল। এমন তথ্যের ভিত্তিতেই আমরা একজন আসামিকে গ্রেপ্তার করেছি। তার কাছ থেকে আমরা বেশকিছু তথ্য পেয়েছি। বিদেশে থাকে তার এমন এক আত্মীয়য়ের কাছ থেকে আইডিয়া পেয়ে এই লাইনে আসে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আরো একজেনর নামও পেয়েছি। তার বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছি। তিনি বলেন, বিট কয়েন হচ্ছে অবৈধ লেনদেন ও মানিলন্ডারিং করার একটি মাধ্যম। দেশের অনেক ব্যবসায়ী বিট কয়েন কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত। যারা বিট কয়েন কিনে রাখেন তারা দ্রুত লাভবান হন। কারণ বিট কয়েন কিনে রাখলে দ্রুত এর মূল্য বাড়ে।

 
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status