শেষের পাতা

আল জাজিরার ‘অনুসন্ধানের সত্যানুসন্ধান’

ডেভিড বার্গম্যানের প্রতি খোলাচিঠি

রায়হান রশিদ

২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১, মঙ্গলবার, ৯:২৯ অপরাহ্ন

হ্যা লো ডেভিড, ৪ঠা ফেব্রুয়ারি এক ফেসবুক পোস্টে আল জাজিরার বহুল আলোচিত তথ্যচিত্রের (‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার’স মেন’) বিষয়ে আমার সংক্ষিপ্ত বক্তব্য ছিল:

“এটি হতে পারতো একটি গুরুত্বপূর্ণ কথোপকথনের অংশ; কিন্তু শেষ পর্যন্ত পূর্বাপর সম্বন্ধ ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে একগাদা অপ্রাসঙ্গিক তথ্য ও মিথ্যা ইঙ্গিতের ভিত্তিতে কিছু অপ্রমাণিত দাবির  সস্তা সেনসেশনাইজেশনে পরিণত হলো।”

আপনি আমাকে লিখে জিজ্ঞাসা করলেন আমি এর মাধ্যমে কী বুঝিয়েছি। যেহেতু এটি এখন একটি জনবিতর্কের বিষয়, তাই আমি ভাবলাম প্রকাশ্যে আপনার প্রশ্নের জবাব দেয়াই যুক্তিযুক্ত হবে। আমি আশা করি, আমাদের আলোচনা প্রকাশ্যে আসায় আপনার কোনো আপত্তি থাকবে না। আমি আশা করি, আমার মতো অনেকের এই তথ্যচিত্রের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে যে কৌতুহল সৃষ্টি হয়েছে, এই পোস্ট সেসব দিকে আলোকপাত করবে।

একটি সাক্ষাৎকারে এই তথ্যচিত্র নিয়ে আপনার মূল্যায়ন আমি আমলে নিয়েছি। আপনি ওই সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তথ্যচিত্রে যেসব দাবি তোলা হয়েছে, তা “যথেষ্ট প্রমাণ-নির্ভর”। তাই আমি পুনরায় তথ্যচিত্রটি দেখলাম শুধুমাত্র এটি নিশ্চিত হতে যে, আমরা একই তথ্যচিত্র নিয়েই কথা বলছি। তথ্যচিত্রটি দেখা শেষে অন্তত একটি বিষয়ে আমি আপনার সঙ্গে একমত হলাম যে, এর প্রোডাকশন কোয়ালিটি বেশ চাকচিক্যময়। এটি দেখলে “থ্রিলার” দেখার অনুভূতি পাওয়া যায় ঠিকই, যেমনটা আপনি বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তথ্যচিত্রটির কনটেন্ট নিয়ে আপনার যেই উচ্ছ্বসিত রায়, তার সঙ্গে একমত হতে পারিনি। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, “তথ্য/প্রমাণ” নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তথ্যচিত্রটির নির্মাতারা এত বেশি “শৈল্পিক স্বাধীনতা” ব্যবহার করেছেন, তা শেষ পর্যন্ত তথ্যচিত্রটির সাংবাদিকীয় কঠোরতার অভাবকে পূরণ করতে পারেনি।

এই তথ্যচিত্রটিকে কেন আমার কাছে “অ-প্রমাণনির্ভর” মনে হয়েছে, সেই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার আগে আমাকে কিছু বিষয় স্পষ্ট করা প্রয়োজন। আমার বিশ্বাস, শুধু বাংলাদেশেরই নয়, প্রতিটি দেশকেই নির্দিষ্ট কিছু মৌলিক বিষয় নিয়ে আত্ম-ভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ক্ষমতা (ও এর অপব্যবহার), প্রভাব (ও এর বিস্তার), নাগরিক অধিকার (ও এটি দমন করা), ব্যক্তিগত গোপনীয়তা (ও নজরদারি), সাধুতা, ন্যায়পরায়ণতা, স্বচ্ছতা, ইত্যাদি। বিবেকবান সাংবাদিকতা এগিয়ে যাওয়ার পথে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। কিন্তু দায়জ্ঞানহীন সাংবাদিকতা এতে বাধার সৃষ্টি করে। এটি আমার মতে এক ধরনের অপকার সাধনের মতো বিষয়- বিশেষ করে যখন বাংলাদেশে সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষকরা ক্ষমতার মুখের সামনে সত্য বলা ও স্তব্ধ করে দেয়ার মতো আইনের বিপরীতে নিজেদের স্বাধীনতা সুরক্ষিত রাখা, এই দুইয়ের মাঝে সার্বক্ষণিক দরকষাকষিতে লিপ্ত।

আল জাজিরার তথ্যচিত্রটির মতো অপ্রমাণিত বা দুর্বল প্রমাণ-নির্ভর কাজ, দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এই সাংবাদিকদের কাজকে আরো কঠিন করে দেয়। তাদের অনুসন্ধান চালানোর যতটুকু অবকাশ ছিল তা আরো সঙ্কুচিত হয়ে উঠে। এটি যেন সেই মিথ্যা বলা রাখাল বালকের গল্পের মতো, যে ‘বাঘ’ বলে চিৎকার করেছিল। এবারের রাখাল বালকের এই মিথ্যা আর্তনাদের চিৎকার প্রকৃত আহ্বানকে অকার্যকর করে ফেলছে।

শুরু থেকে বলতে গেলে, আল জাজিরার অনুসন্ধান নিম্নোক্ত তিনটি পয়েন্ট তুলে ধরেছে যাতে বাংলাদেশের বর্তমান সেনাপ্রধান তার আইনি দায়িত্ব কীভাবে প্রতিপালন করেছেন তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
-প্রথমত, তিনি (অভিযোগ করা হয়েছে) তার (কথিত) পলাতক ভাইদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন;
-দ্বিতীয়ত, তিনি (অভিযোগ করা হয়েছে) তার (কথিত) পলাতক ভাইদের বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে অবগত করতে ব্যর্থ হয়েছেন, যখন তারা অন্তত একবার বাংলাদেশে এসেছিলেন;
-তৃতীয়ত, তার দুই (কথিত) পলাতক ভাইদের একজন এখন (অভিযোগ রয়েছে) ভুয়া পরিচয় সংগ্রহ করেছেন (অভিযোগ রয়েছে) তার সহায়তায়।

যেসব কর্মকাণ্ড ও ত্রুটি যদি পর্যাপ্ত প্রমাণ ও তথ্যনির্ভর উপায়ে প্রমাণ করা যেত তাহলে সন্দেহাতীতভাবে বেশ কয়েকটি আইন ভঙ্গের অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত হতো। শুধু সেনাপ্রধানেরই নয়, এসব আইন সমুন্নত রাখার দায়িত্বে থাকা অন্যান্য আরো কিছু সংস্থার আইনভঙ্গের বিষয়টি প্রমাণিত হতো। সেক্ষেত্রে আইনের এই গুরুতর লঙ্ঘনের জন্য দায়বদ্ধ ব্যক্তিবিশেষকে অবশ্যই জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। আর সেক্ষেত্রে কৃতিত্ব হতো আল জাজিরার অনুসন্ধানী দলের।

আল জাজিরা তথ্যচিত্রের বিভিন্ন বিষয়ের উপর প্রথমে আলোকপাত করা যাক:
১. সেনসেশনালাইজড: আল জাজিরা নিজেদের প্রতিবেদনটিকে #ঢাকামাফিয়া হ্যাশট্যাগ দিয়ে প্রকাশ করেছে। বিষয়টা অনেকটা এমন যে, ঢাকা ও অন্যত্র যেন এক অপরাধের তাণ্ডবলীলা চলছে, যার নেপথ্যে রয়েছে ভয়াবহ ক্ষমতাধর চক্র। বাস্তবে তথ্যচিত্রে কেবল একটি গুরুতর অপরাধের বিষয়টি যথাযথভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, আর তা হলো একটি খুনের ঘটনা, যা ঘটেছে ২৫ বছর আগে।

২. অপ্রমাণিত:এই অনুষ্ঠানে আহমেদ ভাইদের (কথিত) প্রভাব খাটানো ও অর্থপাচারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এটি এসব অভিযোগের কোনো উল্লেখযোগ্য প্রমাণ প্রতিষ্ঠা বা প্রমাণের দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করতেও ব্যর্থ হয়েছে। আমরা শুধু দেখতে পাই এক “বিশেষজ্ঞ” একটি অস্পষ্ট নথির বিভিন্ন অংশকে তুলে ধরছেন, কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট প্রমাণের সরাসরি উদ্ধৃতি দেননি। আমরা কিছু কোম্পানির নাম দেখতে পাই, কিন্তু সেগুলোতে খুবই ভয়াবহ আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন হওয়ার প্রমাণ পাই না।

একটি “অনুসন্ধানী” প্রতিবেদনে যখন অপরাধ, অপরাধের লাভ ও অর্থপাচারের অভিযোগ আনা হয়, তখন এমনটা প্রত্যাশা করাই যুক্তিযুক্ত যে, দর্শকদের নির্দিষ্ট করে অর্থ লেনদেনের একটি ধারাবর্ণনা দেখানো হবে। অর্থপাচার হোক না হোক, অর্থের সব সময়ই কিছু না কিছু চিহ্ন রয়ে যায়। আর এই ধরনের পূর্ণদৈর্ঘ্যের তথ্যচিত্রে আলোচিত লেনদেনের ক্ষেত্রে তো এই কথা আরো বেশি প্রযোজ্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই তথ্যচিত্রে সেই ন্যূনতম মান বজায় রাখা হয়নি।

তথ্যচিত্র এসব অর্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় সঠিকভাবে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে বলে অর্থ সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয়, যেভাবেই উত্থাপন করা হোক না কেন, সেগুলোকে অগ্রাহ্য করা যাবে না। বাংলাদেশ ও হাঙ্গেরির কর্তৃপক্ষকে তারপরও এসব ব্যক্তিবিশেষের (যাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি কর্মকর্তাও রয়েছেন) বিষয়ে তদন্ত করতে হবে যাতে করে নিশ্চিত করা যায় যে, তাদের বৈধ আয় এবং তথ্যচিত্রে উল্লিখিত তাদের শেয়ার, সম্পত্তি ও ব্যবসার পরস্পরের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা। এই ব্যক্তিবিশেষের নিজেদের স্বার্থেই এই তদন্ত দরকার।

৩. বিভিন্ন অনুমানের মধ্যে অসামঞ্জস্যতা: আল জাজিরা যেমনটা বলার চেষ্টা করেছে, আহমেদ ভাইরা কি সত্যিই ততটা ক্ষমতাধর? উদাহরণস্বরূপ, তাদের এক ভাই জোসেফ রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পাওয়ার আগে প্রায় ২০ বছর কারাগারে ছিল। অর্থাৎ তার কারাদণ্ড শেষ হওয়ার কয়েক মাস আগে ক্ষমা পায় সে। মজার বিষয় হলো, তার ২০ বছরের কারাভোগের ১৪ বছরই হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। তাহলে প্রশ্ন উঠে জোসেফ কীভাবে এত বছর কারাগারে ছিলেন, যখন আহমেদ পরিবার যেখানে শাসকগোষ্ঠীকে তাদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে? কীভাবে বাকি দুই ভাই বিদেশে দুই দশক পালিয়ে থাকলো যখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ওপর তাদের এত কর্তৃত্ব?

৪. বস্তুনিষ্ঠতার অভাব:“স্টিং অপারেশন” বা গোপন অভিযানের নামে, আল জাজিরার দল আহমেদ পরিবারের এক ভাইকে ফাঁদে ফেলেছে ও তাকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বড়াই করিয়েছে। আর সে-ও চা দোকানে আড্ডাবাজ লোকের মতো বড়াই করে গেছে অনবরত। আমরা দর্শক হিসেবে শুনেছি যে, কীভাবে সে বাংলাদেশের মন্ত্রী ও বিভিন্ন সংস্থাকে তার পকেটে রাখে। কীভাবে তার সেনাপ্রধান ভাই মূলত দেশ চালায়, কীভাবে তার অনুমোদন ছাড়া সরকারি বা সামরিক চুক্তি আগায় না, ইত্যাদি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, আল জাজিরার তথ্যচিত্রে তার এসব বক্তব্যের স্বপক্ষে, কোনো সত্যিকার অপরাধের একটি প্রমাণও উপস্থাপন করা হয়নি। সেনাপ্রধানের মাফিয়া-প্রধান ভাই কি সত্যিকার অর্থেই সরকারের ওপর তার পরিবারের “বিশাল প্রভাব-প্রতিপত্তি” ব্যবহার করে কোনো চুক্তি কব্জা করতে সমর্থ হয়েছে?

৫. ইহুদী-বিদ্বেষী মোড়:আমি অবশ্যই স্বীকার করি যে, আমি বিশেষভাবে বাংলাদেশ সরকারের স্পাইওয়্যার ক্রয় করা নিয়ে বিশেষভাবে আগ্রহী ছিলাম। তবে আল জাজিরা অনুষ্ঠানে এটি স্পষ্ট ছিল না কোন বিষয়টি আয়োজকদের বেশি উদ্বিগ্ন করেছিল। স্পাইওয়্যার ও নজরদারি নিয়ে তারা বেশি উদ্বিগ্ন ছিলেন? নাকি ইসরাইলের তৈরি স্পাইওয়্যার নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন ছিলেন?

৬. দ্বিচারিতা: নজরদারি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আপনাকে জানিয়ে রাখি যে, আমাদের অনেকেই নজরদারি, আড়িপাতা, হ্যাকিং ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলাম। হোক এসব রাষ্ট্র কিংবা বেসরকারি কোনো সংস্থার কাজ। ২০০৭ ও ০৮ সালে রাজনৈতিক ব্যক্তি, সাংবাদিক ও কর্মীদের বিরুদ্ধে যখন নজরদারি চালানো হয়, তখন আমি এর বিরুদ্ধে ছিলাম। অথচ, তখন আমাদের কিছু তথাকথিত গণতন্ত্রপন্থি উদারমনারা ওই নিষ্ঠুর সরকারের সমর্থক ছিল। ২০১২ সালে এই ধরনের নজরদারি চর্চার বিরুদ্ধেই ছিলাম। এটি ছিল কথিত ‘স্কাইপে হ্যাক’। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়ায় জড়িত ব্যক্তিবিশেষের যোগাযোগে অনুপ্রবেশ করে তা প্রকাশ করা হয়। আর এই কাজে জড়িত ছিল বেসরকারিভাবে সক্রিয় একটি বিদেশি গোয়েন্দা বা নিরাপত্তা সংস্থা। এর ফলে ট্রাইব্যুনালের কর্মী, অধিকার কর্মী, গবেষক ও এমনকি ট্রাইব্যুনালের গোপন সাক্ষীদের নিরাপত্তাও হুমকিতে পড়ে। ওই সময় অধিকারের প্রশ্নে উদার অনেক ব্যক্তি, আপনি সহ, এই গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা লঙ্ঘনের পক্ষে লিখেছিলেন। আমি অন্তত দু’টি ঘটনায় মানুষের এই দ্বিচারিতা দেখিয়েছিলাম। আল জাজিরার এই ‘নজরদারি’র কাহিনী এর চেয়ে ভিন্নতর মনে হয়নি।

৭. সাংবাদিকতার নৈতিকতা এবং মান: আমি জানতে পেরে হতবাক হয়েছি যে, তথ্যচিত্রটিতে কমপক্ষে দুটি দৃষ্টান্ত ছিল যেখানে আল জাজিরা প্রদর্শিত নথিগুলোকে পরিবর্তন ও কারসাজি করা হয়েছে বলে মনে হয়েছে। আল জাজিরার তথ্যচিত্রে প্রদর্শিত নথিগুলোর সম্ভাব্য জালিয়াতির অভিযোগ করে বেশ কয়েকজন ব্লগার এই ইস্যুতে ইতিমধ্যে লিখেছেন। সুতরাং আমি এখানে ওগুলো নিয়ে পুনরায় কথা বলবো না। তদুপরি, নীতিগতভাবে অগ্রহণযোগ্য কিছু প্রক্রিয়ায় আল জাজিরা কিছু ভয়েস-ওভার শিল্পীদের যেভাবে ভাড়া করেছিল, তা-ও এখন প্রকাশিত হচ্ছে। এজেন্টদের মাধ্যমে আল জাজিরা কিছু শিল্পীকে নিয়োগ দিয়েছে, যারা বলছেন তারা আসলে জানতেন না তারা কী নিয়ে কাজ করছিলেন, ফলে তারা এখন প্রতারিত বোধ করছেন। আমি এই বিষয়ে আরো মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকি। সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা প্রকাশ্যে বিষয়টি নিয়ে সরব হবেন নাকি আইনি প্রতিকারের পথে যাবেন, সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার তাদের হাতেই ছেড়ে দিলাম।

ভয়াবহ বিষয় হলো, একটি বিয়ের অনুষ্ঠান উদ্‌যাপনের দৃশ্য অনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে তথ্যচিত্রে। সেখানে এই তথ্যচিত্রের সঙ্গে সম্পর্কহীন পুরুষ ও নারীদের নাচ দেখানো হয়েছে। তাদের মুখ ঝাপসা না করে দিয়ে, আল জাজিরা শালীনতা ও সংবেদনশীলতার ন্যূনতম মানদণ্ড অনুসরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।

৮. নারী-বিদ্বেষ থেকে ভুল নামের প্রয়োগ: আমি অনুষ্ঠানটির শিরোনাম “অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার’স মেন”-এ রুচির অভাব দেখতে পেয়েছি।  বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী একজন মহিলা। এ কারণে শিরোনামটির নারী-বিদ্বেষী দিকটি উপেক্ষা করা শক্ত। মনোযোগ আকর্ষণকারী কিন্তু অপ্রাসঙ্গিক এই শিরোনামটি এই তথ্যচিত্রের সামগ্রিক ‘ফ্যালাসি’রই প্রতিফলন।

নির্মাতারা মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাহিনীর ভিত্তিতে রচিত ৭০-এর দশকের ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি বিষয়ক বিখ্যাত চলচ্চিত্র “অল দ্য প্রেসিডেন্টস মেন”-এর সঙ্গে মিল রাখতে চেয়েছিলেন। বাংলাদেশে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির মতো কিছু খুঁজে বার করার উচ্চাকাঙ্ক্ষা আল জাজিরার নির্মাতাদের থাকতেই পারে, আর সেজন্য কেউ তাদের দোষ দিতে পারেন না। কিন্তু আল জাজিরার দুর্ভাগ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিক্সনের মতো গণহত্যার উস্কানিদাতাও নন, আল জাজিরাও ওয়াশিংটন পোস্ট নয়; আর নির্মাতাদের কেউ উডওয়ার্ডস বা বার্নস্টেইন নন। বিষয়বস্তু বিবেচনায় অনুষ্ঠানটির আরো উপযুক্ত শিরোনাম হতে পারতো ‘আহমেদ ব্রাদার্স’ অথবা ‘দ্য ব্র্যাগার অব বুদাপেস্ট’।
৯. রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গুপ্তচরবৃত্তি ও জাতীয় নিরাপত্তা: আল জাজিরার তথ্যচিত্র থেকে এটি স্পষ্ট যে, অনুসন্ধানী দলটি বাংলাদেশের সেনাপ্রধানের বিস্তারিত ভ্রমণ বৃত্তান্ত পেয়েছিল, যা ব্যবহার করে তারা বিভিন্ন দেশে তাকে অনুসরণ করতে সক্ষম হয়। এটি সেনাপ্রধানকে লক্ষ্য করে আল জাজিরা দলের করা বড় ধরনের নজরদারির ঘটনা। এই ধরনের নজরদারিকে ন্যায়সঙ্গত হিসেবে প্রমাণ করার জন্য কেউ কেউ “জনস্বার্থ”কে যুক্তি হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করতে পারে। তবে আমরা যদি সংবাদ মাধ্যমটির প্রকৃতি ও এর নজরদারির লক্ষ্যকে বিবেচনা করি, তাহলে একে গুপ্তচরবৃত্তি হিসেবেও দেখা যেতে পারে।

আল জাজিরা কাতার নামে একটি সার্বভৌম দেশের সম্পূর্ণ অর্থায়ন ও মালিকানায় পরিচালিত। সরাসরি একটি সার্বভৌম দেশের সমর্থনে অন্য আরেকটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের সেনাপ্রধানের ওপর নজরদারি চালাচ্ছে-বিষয়টি একবার কল্পনা করে দেখুন। আমার মনে হয়, কাতারের কাছ থেকে এই বিষয়ে ব্যাখ্যা চাইতে পারে বাংলাদেশ সরকার। আমি হতাশ হয়েছি যে, তথ্যচিত্রের এই বিশেষ দিকটি সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের জারি করা কোনো বিবৃতিতে বিষয়টি প্রতিফলিত হয়নি। তবে এই ব্যাখ্যা বাংলাদেশের চাওয়া উচিত। কারণ এতে জাতীয় নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের নাগরিকদেরও এই ব্যাখ্যা দাবি করার অধিকার রয়েছে বলে আমি মনে করি।
শেষ করার পূর্বে...
ক্ষমতাধরদের মুখের ওপর সত্য বলা ও গঠনমূলক সংলাপ শুরুর জন্য আমাদের কি শক্তিশালী ও স্বাধীন সংবাদমাধ্যম দরকার? অবশ্যই। আল জাজিরার এই তথ্যচিত্রটি কি এই লক্ষ্য অর্জনে ইতিবাচক অবদান রাখে? দুর্ভাগ্যজনক হলেও উত্তর হলো- না; কারণ,

প্রথমত, ‘হুইসেলব্লোয়ার’ ও তথ্যদাতাদের বিশ্বাসযোগ্যতা ও সত্যতা যেকোনো প্রতিবেদনের ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই দুই বিষয়েই আল জাজিরা দুর্বল বিবেচনাবোধের পরিচয় দিয়েছে।
দ্বিতীয়ত, একটি মিডিয়া প্ল্যাটফরম কতটা স্বাধীন, তাদের বস্তুনিষ্ঠতা ও নিরপেক্ষতা গুরুত্ব বহন করে। আল জাজিরার মতলব খোঁজা আমার উদ্দেশ্য নয়। তবে আল জাজিরা নিজেদের সম্পাদকীয়ভাবে স্বাধীন দাবি করলেও, নিজেদের বিভিন্ন প্রতিবেদন, প্রতিবেদনের বিষয়, লক্ষ্য ও পন্থা নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাদের যেই ‘সুনাম’, তা তথ্যচিত্রটির বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে অগ্রাহ্য করা যায় না।

তৃতীয়ত, কোনো অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে অনুসন্ধানী দল ও পর্যবেক্ষক মন্তব্যকারীদের নিরপেক্ষতা ও বস্তুনিষ্ঠতা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অতীতে আপনাকে (ডেভিড বার্গম্যান) আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে অভিযুক্তদের বিচারের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানের অভাব থাকা নিয়ে আপনাকে উদ্বিগ্ন হিসেবে উপস্থিত হতে দেখেছি। কিন্তু এখানে আশ্চর্য্যজনক হলো, আল জাজিরার অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার আন্তর্জাতিক মানের অভাব আপনি স্বীকারই করতে চান না। বরং, আপনি সেখানে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন, কথা বলেছেন।

আমি অবশ্যই এটি পুনর্ব্যক্ত করতে চাই যে, আমি বিশ্বাস করি, সঠিকভাবে পরিচালিত হলে, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা সত্যিকার ভালো পরিবর্তন বয়ে আনতে পারে। এই তথ্যচিত্র প্রচারের ঘটনা থেকে অনেক শিক্ষণীয় বিষয় আছে; শুধু বাংলাদেশ সরকারেরই নয়, আল জাজিরা ও অনুসন্ধানী দলেরও। আমি আশা করি, আল জাজিরা তথ্যচিত্র নিয়ে আমি আমার অবস্থান স্পষ্ট করতে পেরেছি। সময় নিয়ে পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
(রায়হান রশিদ আইন নিয়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়েছেন। তিনি ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম (আইসিএসএফ)-এর প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি। সংক্ষেপিত)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status