শেষের পাতা

ডেমরার আতঙ্ক ‘দখল অলি’

রুদ্র মিজান

২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১, সোমবার, ৯:৩০ অপরাহ্ন

নিজের জমি নেই। তবুও জমিদার তিনি। ডেমরার ডগাইর এলাকায় বাইরের কেউ জমি কেনার পরই জানান দেন তা। এই জমির মালিক তিনি। এজন্য অবলম্বন করেন কৌশল। নানা কৌশলে জিম্মি করার চেষ্টা করেন প্রকৃত মালিককে। শর্ত দেন, দিতে হবে জমির কিছু অংশ নতুবা টাকা। শর্ত মেনে নিলেই ঝামেলা থেকে মুক্তি। বাধ্য হয়ে কেউ কেউ টাকা দিয়ে থামান তাকে। অনেকে আশ্রয় নেন আইনের। এ রকম বেশ কয়েক মামলা, জিডি রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তদন্তে প্রমাণও মিলেছে। একাধিকবার কারাবন্দিও হয়েছেন তিনি। তার পরও বদলাননি মোটেই। স্থানীয় হিসেবে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেন। এই প্রভাবশালী জমিহীন জমিদারের নাম অলি উল্যাহ। এলাকায় ‘দখল অলি’ নামেও রয়েছে তার পরিচিতি। পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সী এই ব্যক্তির নামে এরকম অভিযোগের শেষ নেই। এলাকায় এক নামেই পরিচিত তিনি। ডেমরার আতঙ্ক এই অলি উল্যাহ।

সরজমিনে ওই এলাকা পরিদর্শনে জানা গেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। এলাকায় একটি দর্জির দোকান ছিল অতীতে। এখন ‘তাকওয়া’ নামে একটি রেস্টুরেন্ট দিয়েছেন বাদশা মিয়া রোডে। কিন্তু এসবের আড়ালে তার বাণিজ্য ভিন্ন। জমি বিক্রির কমিশন ও জিম্মি নাটক সাজানো নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। অলি উল্যাহর রয়েছে বেশ কয়েক দলিল। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার জমির দাম যখন বাড়তে থাকে ঠিক তখনই দলিল তৈরি করেন তিনি। ওই দলিলগুলোতে গ্রহীতা অলি উল্যাহ। বিক্রেতা মরণ মণ্ডল ও নিত্য মণ্ডল। ওই নামে এলাকায় কেউ না থাকলেও অতীতে বিশেষ প্রয়োজনে হাজির করা হয়েছে। বিষয়টি মোটেও অলৌকিক না। কারণ, প্রয়োজন অনুসারে দুই নাম একই ব্যক্তি ব্যবহার করেন। তিনি অলি উল্যাহর বড় ভাই সাক্তার উল্যাহ। বড় ভাই সাক্তারকে  মরণ মণ্ডল ও নিত্য মণ্ডল সাজিয়ে রেজিস্ট্রি অফিসে খাঁড়া করে ১৯৯৭ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে চারটি ‘খাঁড়া দলিল’ করেছেন অলি। ওই দলিলগুলোর সময়ও পেশিশক্তি ব্যবহার করে অপকর্ম করেন তিনি।

জিম্মি নাটক ও চাঁদাবাজি করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে কারাভোগ করেছেন অলি। এ ব্যাপারে অলির বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে আইনি সহায়তা নিয়েছেন ওই এলাকার বশির আহমেদ, মনির মিয়া, কাদের ভূঁইয়া ও কাইয়ূম ভূঁইয়া। বশির আহমেদের মামলায় দীর্ঘদিন কারাগারে ছিলেন অলি উল্যাহ। জবর-দখলে সুবিধা করতে না পেরে ভিন্ন পথেও হেঁটেছেন। ঘটনার শিকার মনির উদ্দিন। তিনি ইতালি যাবেন। যাওয়ার প্রাক্কালে তার বাসার ছাদ থেকে গাঁজা উদ্ধার করে ডিবি পুলিশ। ডিবি পুলিশের সোর্স ছিলেন অলি উল্যাহ। ওই মামলায় কারাগারে যান মনির। ভিসার মেয়াদ শেষ প্রায়। তার ইতালি যাওয়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল প্রায়। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, অলি উল্যাহ তখন মনিরের কাছে পাঁচ লাখ টাকা দাবি করেন। এই টাকা পেলে তাকে চার্জশিট থেকে রক্ষা করা হবে। এমনকি দ্রুত জামিনের ক্ষেত্রেও চেষ্টা করা হবে। বাধ্য হয়েই বড় অঙ্কের টাকা দেন মনির।

এলাকাবাসী জানান, অলি উল্যাহর ঘরবাড়ি বলতে তেমন কিছু ছিল না। ওই টাকা দিয়েই অলি উল্যাহ, তার বোন মায়ানূর, মায়ানূরের ছেলে বাবু, মিজান মিলে বাড়ি নির্মাণ করেছে।

অলি উল্যাহ’র নাটকের শিকার প্রবাসী জবিউল্লাহ। ২০০৪ সালে অর্থঋণ আদালত-১ থেকে সোনালী ব্যাংক মকিম কাটারায়  ফরিদ আহম্মদের বন্ধককৃত সম্পত্তি নিলামের মাধ্যমে খরিদ করেন জবিউল্লাহ। ডেমরা থানার ডগাইর বাজারের দক্ষিণে হিজলতলার ৮২৫ ব্যাংক কলোনীতে ওয়ালের ওপর টিন দিয়ে ১৩টি রুম তৈরি করে ভাড়া দিয়ে আসছিলেন জাপান ফেরত এই প্রবাসী। গত বছরের ৩০শে জুন বোরকা পরিহিত এক নারী এসে একটি রুম ভাড়া নেন। ১লা জুলাই তিনি রুমে উঠেন। রুমে উঠার পর স্বামী-স্ত্রীর জাতীয় পরিচয়পত্র ও ছবি চাইলে তিনি গড়িমসি করেন। এ নিয়ে বাকবিতণ্ডার এক পর্যায়ে ঘর থেকে বের হন এক যুবক। ওই নারীর স্বামী। তিনিই অলি উল্যাহ। অলি জানান, রুম ভাড়া নিতে এনআইডি লাগে না। এ নিয়ে বাকবিতণ্ডার একপর্যায়ে বাসা ছেড়ে দিতে বললে, তিনি জানান বাসাও ছাড়বেন না। তার সঙ্গে যোগ দেয়, অলি উল্যাহর স্ত্রী শাহনুর আক্তার ও পুত্র শিহাব উদ্দিনসহ অন্যরা। সশস্ত্র তারা। তাৎক্ষণিকভাবে গেটে তালা লাগিয়ে জবিউল্লাহকে জিম্মি করার চেষ্টা করে। ওই সময়ে দেয়াল টপকিয়ে রক্ষা পান জবিউল্লাহ। এ বিষয়ে ১১ই জুলাই ডেমরা থানায় একটি সাধারণ ডায়রি করেন জবিউল্লাহ।
জবিউল্লাহ জানান, জিডি করার পর অলি উল্যাহ দু’টি নম্বর থেকে কল দিয়ে তাকে বলেন, থানা পুলিশ নিয়ে ঝামেলা না করতে। পাঁচ লাখ টাকা দিলে বাড়ি ছেড়ে যাবেন তিনি। ওই বাড়িতে ওঠার পর বাড়ির পাম্প, কাঠ, রড বিক্রি করে দেন অলির পরিবারের সদস্যরা। সেই সঙ্গে অন্যান্য ভাড়াটিয়াদের নানাভাবে অত্যাচার করতে থাকেন। অতিষ্ঠ হয়ে আলমগীর হোসেন নামে এক ভাড়াটিয়া বাড়ি ছেড়ে চলে যান। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ওই এলাকার কাউন্সিলর আবদুল মতিন সাউদের শরণাপন্ন হন জবিউল্লাহ। এ বিষয়ে কাউন্সিলর আবদুল মতিন সাউদ মানবজমিনকে বলেন, অলি উল্যাহর বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ। পেছনে কিছু লোক আছে তাদের প্রশ্রয়ে এসব করে। আমার কাছে বিচার এলে চেষ্টা করি সঠিক বিচার করতে। কিন্তু বিচার না মানলে কী আর করা। আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পরামর্শ দিই। সহযোগিতা করি।

সালিশে কাজ না হলে বাধ্য হয়ে ডেমরা থানায় মামলা করেন জবিউল্লাহ। পরে অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয় অলি উল্যাহ, তার স্ত্রী শাহীনুর ও ছেলে শিহাবকে। পরবর্তীতে আদালতের নির্দেশে কারাগারে পাঠানো হয় তাদের। জবিউল্লাহর মামলায় গ্রেপ্তারের কিছু সময়ের মধ্যেই ঘর থেকে কিছু আসবাবপত্র বের করে ভাঙচুর করে এই চক্রের সদস্যরা। পরবর্তীতে ১৮ দিন পর কারাগার থেকে বের হয়ে জবিউল্লাহকে আসামি করে আদালতে একটি ডাকাতি মামলা করে অলি উল্যাহ। তবে অলি উল্যাহর অভিযোগের কোনো সত্যতা পায়নি পুলিশ। অন্যদিকে জবিউল্লাহর দায়েরকৃত মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তৎকালীন ডেমরা থানার উপ-পরিদর্শক মৃগানকো শেখর বলেন, তদন্ত করতে গিয়ে অভিযোগের সত্যতা পেয়ে আদালতে চার্জশিট দিয়েছি। অলি উল্যাহর স্ত্রী নিজেই স্বীকার করেছে ভাড়াটিয়া হিসেবে বাড়িতে উঠে তারা জিম্মি করে, বাড়ি দখলের চেষ্টা করে। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, অলি উল্যাহর সহযোগীদের মধ্যে অন্যতম রিপন। একাধিকবার মাদকসহ গ্রেপ্তার হয়ে কারাভোগ করেছে সে। এই চক্রটি মাদক, জমি দখল করে জিম্মি, চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মে জড়িত রয়েছে। এসব অভিযোগ অস্বীকার করে অলি উল্যাহ বলেন, অভিযোগ সত্য না। তবে নিজের ভাইকে হিন্দু সাজিয়ে ‘খাঁড়া দলিল’ তৈরি, জমি দখল, চাঁদাবাজির বিষয়ে কোনো ব্যাখা দেননি তিনি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status