বিশ্বজমিন

পুনওয়ালা: ঘোড়াপালক পরিবার থেকে ভ্যাকসিন সাম্রাজ্যের অধিপতি

মানবজমিন ডেস্ক

২৮ জানুয়ারি ২০২১, বৃহস্পতিবার, ১১:৪৬ পূর্বাহ্ন

ভারতের পুনেতে আদর পুনওয়ালার বোর্ডরুম থেকে ভারতের বৃহত্তম অশ্বখামারের নিখুঁতভাবে কাটা মাঠটি দেখা যায়। এখন অবদি পুনওয়ালা পরিবারের ঘোড়াগুলো ১০ বার ইন্ডিয়ান ডার্বি প্রতিযোগিতা জিতেছে। তবে আজকাল ঘোড়দৌড় নিয়ে তেমন একটা ভাবছেন না আদর। বরং, বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষকে করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) টিকা দেওয়ার প্রতিযোগিতায় মনোনিবেশ করছেন। বিশ্বকে টিকাদানের মাধ্যমে করোনামুক্ত করার দৌড়ে বিশ্বের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে উঠেছেন পুনওয়ালা ফার্মাসিউটিক্যালসের তরুণ এই মালিক। সম্প্রতি, বৃটিশ পত্রিকা দ্য টেলিগ্রাফের এক প্রতিবেদনে এই পরিবার নিয়ে এমন মন্তব্য করা হয়েছে।
খবরে বলা হয়, বিশ্বের সবচেয়ে বড় টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সিরাম ইন্সটিউট অব ইন্ডিয়ার প্রধান নির্বাহী আদর পুনওয়ালা। মুম্বই থেকে ৭০ মাইল দূরে অবস্থিত কারখানাটিতে পুরোদম কাজ চলছে। প্রতি মাসে বৃটিশ-সুইডিশ ফার্মাসিউটিক্যালস প্রতিষ্ঠান অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি করোনা টিকার ৫ কোটি ডোজ উৎপাদনে সর্বশক্তি ঢেলে দিচ্ছে কর্মীরা। প্রাণঘাতী ভাইরাসটিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে আশার আলো হয়ে দেখা দিয়েছে এ টিকা।
প্রতিষ্ঠানটি কেমন চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তা গত বৃহস্পতিবার এক নির্মাণাধীন ভবনে আগুন লাগার ঘটনায় প্রকাশ পায়। ওই অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারান পাঁচ জন। ঘটনাটি  ঘিরে দেওয়া এক টুইটে পুনওয়ালা লিখেন, আমরা গভীরভাবে ব্যথিত। নিহতদের পরিবারের প্রতি আমরা গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।
এখন অবধি ওই অগ্নিকাণ্ডের কারণ নিশ্চিত করা যায়নি। এতে টিকা উৎপাদনেও কোনো প্রভাব পড়েনি। কিন্তু ঘটনাটি নতুন এক ধারণার জন্ম দিয়েছে যে, সিরাম ইন্সটিটিউট বৈশ্বিক মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে।
আগুন লাগার আগ থেকেই অবশ্য প্রতিষ্ঠানটির উপর চাপের বিষয়টি বেশ স্পষ্ট ছিল। পুনওয়ালা বলেন, সবাই সারামাস ধরে ক্লান্তিহীনভাবে কাজ করে গেছে। এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বিশ্বজুড়ে সকল দেশে টিকা বিতরণ ও একইসঙ্গে দেশীয় পর্যায়ে আমাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা। পাশাপাশি, এ-ও বোঝা যে আমার সরকার আমাদের কাছ থেকে কী চায়।

ভারতে টিকা প্রদান
ঘোড়দৌড়ের ঘোড়া পালা ভারতীয় একটি পরিবার কিভাবে গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন ও ফাইজারের মতো জায়ান্টদের পেছনে ফেলে বিশ্বের টিকা উৎপাদনের রাজা হয়ে উঠলো, সেই গল্প যতটা কৌতূহলোদ্দীপক, ততটাই অবিশ্বাস্য।
১৯৬৬ সালে সিরাম ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন আদর পুনওয়ালার বাবা ও পুনওয়ালা গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইরাস পুনওয়ালা (৮০)। কিছুদিন আগেও ভারতের বাইরে ও টিকা উৎপাদনকারী জগতেও খুব একটা পরিচিতি ছিল না প্রতিষ্ঠানটির। কিন্তু করোনা মহামারিতে তা পুরোপুরি পাল্টে যায়। গত মার্চ থেকে শুরু করে বৃটেনের অ্যাস্ট্রাজেনেকা, যুক্তরাষ্ট্রের নভোভ্যাক্সসহ পাঁচটি শীর্ষ ফার্মাসিউটিক্যালস প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে টিকা উৎপাদনের চুক্তি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। সব মিলিয়ে করোনা টিকার অন্তত ১০০ কোটি ডোজ উৎপাদনের কাজ চলছে এর কারখানায়। বিশ্বজুড়ে করোনা মোকাবিলার একেবারে কেন্দ্রস্থলে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
ফাইজার, মডার্না, অ্যাস্ট্রাজেনেকার মতো পশ্চিমা ফার্মাসিউটিক্যালস জায়ান্টগুলো বা অক্সফোর্ডের মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো টিকা তৈরির লজিস্টিক কাজ সম্পন্ন করলেও বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষের জন্য সেসব টিকার পর্যাপ্ত ডোজ উৎপাদনের কাজ সিরাম ইন্সটিটিউটের উপরেই বর্তিয়েছে।
গত মাসে নিজে করোনার টিকা গ্রহণ করেছেন পুনওয়ালা। তিনি বলেন, আমার অংশীদার, অর্থায়নকারীসহ অনেককে খুশি করতে হবে। সবাই উদ্বিগ্ন। সবার অনুভূতি এমন যে, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তাদের টিকা দিতে হবে।

ছোট থেকে শুরু
করোনা মহামারির আগ থেকেই ভারতের সবচেয়ে ধনী ব্যবসায়ী গ্রুপগুলোর একটি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল পুনওয়ালা পরিবার। মহামারির মধ্যে ব্যাপক লাভবান একটি বছর পার করেছে তারা। গত এক বছরে সাইরাস পুনওয়ালার আনুমানিক মোট সম্পদের পরিমাণ ৮৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ১ হাজার ৬৪০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। ব্লুমবার্গ অনুসারে বর্তমানে ভারতের ষষ্ঠতম ধনী ব্যক্তি তিনি। তার সম্পদের বেশিরভাগই—১ হাজার ৫৫০ কোটি ডলার— এসেছে সিরাম ইন্সটিটিউটে তার শেয়ার থেকে। এছাড়া ৯৬ কোটি ডলারের রিয়েল এস্টেট ও অন্যান্য সম্পদও রয়েছে তার।
বড় পরিসরে টিকা উৎপাদন অত্যন্ত জটিল ও কারিগরিভাবে কঠিন একটি প্রক্রিয়া। বর্তমানে পুনওয়ালাদের সিরাম ইন্সটিটিউট প্রতি বছর ১৭০টি দেশে ব্যবহারের জন্য পোলিও, হাম ও ইনফ্লুয়েঞ্জার ১৫০ কোটি ডোজ টিকা উৎপাদন করে থাকে। ইন্সটিটিউটটির দাবি, বিশ্বজুড়ে শিশুদের দেওয়া ৬৫ শতাংশ টিকাই তারা উৎপাদন করে থাকে।
ষাটের দশকে প্রতিষ্ঠার সময় অবশ্য সিরাম ইন্সটিটিউট এত বড় ছিল না, কেবল একটি ভেটেনারি ক্লিনিক ছিল। ঘোড়া পালনের পাশাপাশি অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ করতে চেয়েছিলেন সাইরাস। এক ভেটেনারি চিকিৎসকের সঙ্গে আলাপের পর টিকা তৈরির কাজে উৎসাহিত হন তিনি।
তার এ পদক্ষেপ যুক্তিযুক্ত ছিল। অনেক টিকা তৈরিতে প্রাণীদেহের সিরাম ব্যবহৃত হয়। যেমন ডিপথেরিয়া, টিটেনাস ও স্কারলেট জ্বরের টিকা তৈরিতে ঘোড়ার সিরাম ব্যবহৃত হয়। তীক্ষ্ণ দূরদর্শিতার সঙ্গে সাইরাস তার ছোট ভেটেনারি ক্লিনিকটিকে একটি বড় কোম্পানিতে রূপ দিয়ে ফেলেন।
বৃটেন থেকে ভারতের স্বাধীনতার মাত্র ১৮ বছর পর সেরাম প্রতিষ্ঠিত হয়। সরকার দেশের জনসংখ্যার জন্য কম খরচে টিকা চাইছিল। পরবর্তী ১৫ বছর ধরে সরকারের শিশুদের টিকা প্রদান কর্মসূচিতে কম খরচে টিকা সরবরাহ করে যায় সিরাম।

যেভাবে পশ্চিমাদের জয় করলো সিরাম
তবে সিরামের সবচেয়ে বড় লাভ আসে আশির দশকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জন্য টিকা উৎপাদনের লাইসেন্স পায় প্রতিষ্ঠানটি। বিশ্বজুড়ে পোলিও ও অন্যান্য রোগের টিকা রপ্তানি শুরু করে পুনওয়ালা পরিবার। কম দামে টিকা সরবরাহ করে অচিরেই পশ্চিমা ও দেশীয় টিকা উৎপাদনকারীদের পেছনে ফেলে দেয়। লাভ কম আসায় তখন অনেক পশ্চিমা ফার্মাসিউটিক্যালস প্রতিষ্ঠানই টিকা উৎপাদন থেকে বেরিয়ে যায়। এরপর থেকে সিরামে বিনিয়োগের পরিমান বাড়তেই থাকে। বিল অ্যান্ড গেটস ফাউন্ডেশনের সঙ্গেও চুক্তি পেয়ে যায় প্রতিষ্ঠানটি।
গত মার্চে শেষ হওয়া অর্থ বছরে সিরাম ইন্সটিটিউটের রাজস্বের পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৯০০ কোটি রুপি। চলতি বছর তা আরো বাড়ার কথা রয়েছে। মহামারির মধ্যে টিকার চাহিদা মেটাতে নিজেরা ২৭ কোটি পাউন্ড বিনিয়োগ করেছে তারা। গেটস ফাউন্ডেশন থেকে পেয়েছে আরো ৩০ কোটি পাউন্ড। উৎপাদন বাড়াতে নিয়োগ দিয়েছে ৭০০ কর্মী।
এখন অবধি সিরামের অন্যতম বড় ক্রেতা হচ্ছে ভারত সরকার। দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে পুনওয়ালাদের সম্পর্করক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া, অন্যান্য বিনিয়োগকারী ও ক্রেতারাতো আছেনই। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের পর বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি করোনা সংক্রমণ ঘটেছে ভারতে। আগামী আগস্টের মধ্যে দেশটির ১৩৬ কোটি জনগণকে টিকা দিতে চায় মোদী সরকার

আপাতত মুনাফা নেই
করোনা টিকার মূল্য নির্ধারণ পুনওয়ালাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর একটি। যদিও আদর পুনওয়ালা জানিয়েছেন, আপাতত স্বল্প মূল্যেই টিকা বিক্রি করবে সিরাম ইন্সটিটিউট।
তিনি বলেন, আমি চাইলে প্রতি টিকার দাম ১০ ডলার করে রাখতে পারতাম। মহামারির সুযোগ নিতে পারতাম। কিন্তু আমার বিবেক বাধা দেয়। আমি ১০-১৫ ডলার করে দাম ধরলে আফ্রিকান, ভারত সহ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলো টিকা পাবে না।
তবে ভবিষ্যতে অবশ্য টিকার দাম বাড়তে পারে। তিনি বলেন, হয়তো এক-দুই বছর পর মুনাফার জন্য আমি বাণিজ্যিকভাবে টিকার দাম বাড়িয়ে দেবো।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status