প্রথম পাতা

কীভাবে জনপ্রিয় হলো জামালপুরের ডিসি’র পক্ষ থেকে অভিনন্দন!

তারিক চয়ন

২৬ জানুয়ারি ২০২১, মঙ্গলবার, ৯:৫৮ অপরাহ্ন

ইদানীং কি পত্রিকার সংবাদ, কি ফেসবুক, কি ইউটিউব যেকোনো প্ল্যাটফরমেই যেকোনো নেতিবাচক খবরের বিপরীতে একটি মন্তব্য হরহামেশাই চোখে পড়ছে। আর সেটি হলো ‘জামালপুরের ডিসির পক্ষ থেকে অভিনন্দন’। পুলিশ কোনো চোরকে ধরেছে, কারো কুকীর্তির ভিডিও ফাঁস হয়েছে, এমনকি ডনাল্ড ট্রাম্প বলছেন- যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে জালিয়াতি হয়েছে- এমন যেকোনো খবরের মন্তব্যের ঘরেই কেউ এসে মন্তব্য করে বসছেন ‘ভাই, আপনাকে জামালপুরের ডিসির পক্ষ থেকে অভিনন্দন’।

মন্তব্যটি কখন জনপ্রিয় হয়ে উঠে?
 খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ‘জামালপুরের ডিসির পক্ষ থেকে অভিনন্দন’ মন্তব্যটি জনপ্রিয় হয়ে উঠে ২০১৯ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশের জনৈক অভিনেত্রী প্রতিবেশী দেশের এক নির্মাতাকে বিয়ে করা এবং একই সময়ে ওই অভিনেত্রীর অন্য একজন নির্মাতার সঙ্গে অন্তরঙ্গ ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর। ওই অভিনেত্রীকে নিয়ে যেকোনো সংবাদের মন্তব্যের ঘরেই ‘জামালপুরের ডিসির পক্ষ থেকে আপনাকে অভিনন্দন’ মন্তব্য দেখতে পাওয়া যায়।

কিন্তু এরপর এই মন্তব্য আর শুধু ওই অভিনেত্রীকে ঘিরেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। শুরুর দিকে ঠাট্টা-তামাশার বিষয় হলেও একসময় তা প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠে।
২০১৯ সালে রাজধানীতে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হলে সেপ্টেম্বরে ক্যাসিনো-রাজা, যুবলীগের প্রভাবশালী নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাট ধরা পড়লেও সে সংক্রান্ত সংবাদে অনেকে মন্তব্য করেন ‘সম্রাট ভাই, গ্রেপ্তার হওয়ায় আপনাকে জামালপুরের ডিসির পক্ষ থেকে অভিনন্দন।’ একই মন্তব্য দেখতে পাওয়া যায় ২০২০ সালের শুরুর দিকে প্রতারণা, অবৈধ অর্থ পাচার, জাল টাকা সরবরাহ, মাদক ব্যবসা ও অনৈতিক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে যুব মহিলা লীগের বহুল আলোচিত নেত্রী শামীমা নুর পাপিয়া গ্রেপ্তার হলেও। করোনাকালে করোনা পরীক্ষার ভুয়া প্রতিবেদন দিয়ে ধরা পড়েন রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মো. শাহেদ, জোবেদা খাতুন সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার (জেকেজি হেলথ কেয়ার) চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী এবং তার স্বামী আরিফুল হক চৌধুরী। এই তিনজনকে নিয়ে করা যেকোনো সংবাদেও অনেকে মন্তব্য করেন ‘ভুয়া সার্টিফিকেট বানিয়ে বিশ্বের বুকে দেশকে গর্বিত করায়, জামালপুরের ডিসির পক্ষ থেকে অভিনন্দন’।

গেল বছরই বাংলাদেশে পিয়াজের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। সে সময় প্রতিবেশী দেশ পিয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিলে তা সাধারণ মানুষের জন্য ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দেয়। সে সময় ‘বাংলাদেশে পিয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিলো প্রতিবেশীরা’ এ জাতীয় সংবাদের মন্তব্য হিসেবে অনেকে ব্যবহার করেন ‘আপনারা পিয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেয়ায় জামালপুরের ডিসির পক্ষ থেকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন’।

কিন্তু উক্ত মন্তব্য এমন অনেক সংবেদনশীল এবং দুঃখজনক সংবাদেও করা হয় যা নিয়ে মন্তব্যকারীরা উল্টো নিজেরাই তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, এ বছরের শুরুর দিকের একটি হৃদয়বিদারক ঘটনার কথা। রাজধানীর কলাবাগানে বন্ধুর বাসায় গিয়ে মাস্টারমাইন্ড স্কুলের ‘ও’ লেভেলের শিক্ষার্থী আনুশকা নূর আমিন (১৭)কে ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগ উঠে। যার প্রেক্ষিতে গ্রেপ্তার হয় তার প্রেমিক ইফতেখার ফারদিন দিহান। নাবালিকা আনুশকার মৃত্যু নিয়ে করা বিভিন্ন সংবাদের বিপরীতেও অনেকে মন্তব্য জুড়ে দেন ‘ছেলেবন্ধুর বাসায় গেলে ধর্ষণ তো হতেই হবে, জামালপুরের ডিসির পক্ষ থেকে তোমাকে অভিনন্দন আনুশকা’।

জামালপুরের ডিসির ঘটনাটি কি?
২০১৯ সালের ২২শে আগস্ট জামালপুর জেলার সে সময়ের জেলা প্রশাসকের (ডিসি) একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। পরদিন সকাল থেকে ফেসবুক ও ইউটিউবে তা ভাইরাল হয়। দেশে ও বিদেশে লাখ লাখ নয়, কোটি কোটি মানুষ সেটি প্রত্যক্ষ করেন। নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন সবাই। সেই ভিডিওতে ডিসি আহমেদ কবীরের সঙ্গে তার অফিস সহকারী সানজিদা ইয়াসমিন সাধনাকে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখা যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার পর এক পর্যায়ে আহমেদ কবীরকে ওএসডি করা হয়। অফিস সহায়ক সাধনাকে সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা বিধিমালা অনুসারে সাময়িক বরখাস্ত করে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাও করা হয়।

আহমেদ কবীরকে ওএসডি করার পর যারা ভয়ে তাকে এবং সেই শয্যাসঙ্গীকে নিয়ে কোনো কথা বলেননি, তারাও মুখ খুলতে শুরু করেন। ভুক্তভোগীদের কয়েকজন সাংবাদিকদের জানান, ডিসির সঙ্গে সম্পর্কের প্রভাব দেখিয়ে সানজিদা ইয়াসমিন অফিসে দোর্দণ্ড প্রতাপে দাপিয়ে বেড়াতেন। শুধু কর্মচারীরাই নন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও পাত্তা দিতেন না। চাকরি হারানোর ভয়ে প্রতিবাদ করতে সাহস পেতেন না কেউ-ই।

এ ঘটনার কিছুদিন আগেই আহমেদ কবীর লাভ করেন বিভাগীয় শুদ্ধাচার পুরস্কার। নিজ দপ্তরের খাস কামরায় একজন অফিস সহায়কের সঙ্গে ‘আপত্তিকর’ ভিডিও প্রকাশের পর জনমনে প্রশ্ন উঠে, রাষ্ট্রীয় শুদ্ধাচার সনদ পাওয়া একজন কর্মকর্তার এমন নৈতিকস্খলন হয় কি করে? মানুষের মাঝে জানার আগ্রহ তৈরি হয়, রাষ্ট্রীয় শুদ্ধাচার পুরস্কার পাওয়ার ক্ষেত্রে যোগ্যতা কী এবং কীভাবে এই পুরস্কারের জন্য কর্মকর্তা বাছাই করা হয়। এই সনদ পাওয়া কর্মকর্তাকে বাছাই করার ক্ষেত্রে কারও গাফিলতি ছিল কিনা, আলোচনা চলে তা নিয়েও।

বিষয়টি অস্বীকার করে ঘটনাটি ‘সাজানো’ বলে আহমেদ কবীর দাবি করলেও এ ঘটনার প্রেক্ষিতে গঠিত তদন্ত কমিটির ২৬ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনে সোজাসাপ্টা বলা হয়- জামালপুরের সাবেক ডিসি আহমেদ কবীরের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের ভিডিওটি সত্য। এটি জাল বা মনগড়া নয়। এ ঘটনায় তার নারী সহকর্মী সানজিদা ইয়াসমিন সাধনাও অভিযুক্ত। তারা পরস্পরের ইচ্ছায় অনৈতিক কাজে মিলিত হয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে বিধিবিধান অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

এমন মন্তব্য নিয়ে বিশেষজ্ঞ কি বলছেন?
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মুনিরা আজহার ঊর্মি বলেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিনোদনের সুযোগ এখন সবার হাতের নাগালে। এ ধরনের মন্তব্য অনেকের স্থূল ব্যক্তিত্বের-ই বহিঃপ্রকাশ। অনেকে স্রেফ সস্তা রসিকতা করার জন্যই এসব মন্তব্য করে থাকেন। আবার এর বিপরীতে এসব মন্তব্য আমাদের সমাজে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেদিকেও ইঙ্গিত দেয়। ‘বিচার চাই, বিচার চাই’ জাতীয় মন্তব্য করে দীর্ঘদিন ধরে কোনো বিচার না পেয়ে অনেকে হয়তো রসিকতার মধ্য দিয়ে তাদের রাগ, ক্ষোভ, উষ্মা, অসহায়ত্ব প্রকাশ করছেন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status