প্রথম পাতা

ডাকাতি করে রাস্তায় ফেলে হত্যা

শুভ্র দেব

২১ জানুয়ারি ২০২১, বৃহস্পতিবার, ৯:৪৮ অপরাহ্ন

গভীর রাতে বিভিন্ন সড়কের মোড়ে ওত পেতে বসে থাকে ডাকাতরা। সঙ্গে থাকে মিনি পিকআপ। টার্গেট ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। যারা রাতের বেলা ঢাকার বিভিন্ন ফল, সবজি ও মাছের পাইকারি বাজার থেকে পণ্য কিনে। রাতের বেলা লোকাল বাস না চলাতে কৌশল হিসাবে মিনি ট্রাক থেকে বিভিন্ন বাজারের নাম ধরে ডাকতে থাকে। স্বল্প খরচে বাজারে যাওয়ার জন্য ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ওই ট্রাকে উঠে। ট্রাকের সামনে পেছনে আগে থেকেই ডাকাত দলের সদস্যরা বসে থাকে। কিছু দূর যাওয়ার পর তারা ওই ব্যবসায়ীদেরকে ছুরি ধরে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে ছিনিয়ে নেয় টাকা, মোবাইলসহ গুরুত্বপূর্ণ সবকিছু। তারপর তাদের ধাক্কা মেরে ফেলে দেয় সড়কে। এভাবেই দীর্ঘদিন ধরে সংঘবদ্ধ একটি ডাকাত চক্র ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সব ছিনিয়ে নিয়ে চলন্ত গাড়ি থেকে ফেলে দিয়ে আসছিল। ডাকাত দলটির সর্বশেষ শিকার আপন মিয়া ও নজরুল ইসলাম। তাদের কাছ থেকে সব কেড়ে নিয়ে চলন্ত গাড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল। এতে আপন মিয়া মারা যান। এ ঘটনায় আপন মিয়ার স্ত্রী বাদী হয়ে বিমানবন্দর থানায় একটি হত্যা ও ডাকাতি মামলা করেন। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) গুলশান বিভাগ এ ঘটনায় জড়িত ৬ জনকে মঙ্গলবার গ্রেপ্তার করেছে।

যাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তারা হলো, সজল, মুসা, বাচ্চু, সজীব, মুন্না ও সিদ্দিক। নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ থানাধীন চনপাড়াস্থ বটতলা মোড় থেকে তাদের চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ সময় তাদের কাছ থেকে ডাকাতি কাজে ব্যবহৃত পিকআপ এবং দেশীয় অস্ত্র জব্দ, লুণ্ঠনকৃত টাকা ও মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়েছে। ঘটনার রাতে মুন্না ও সিদ্দিক ছাড়া বাকি চারজনই ছিল। মুন্না ডাকাত দলের সদস্য হলেও ওই ঘটনার রাতে সে ছিল না। এরবাইরে রফিক ওরফে পিতুল ও ছাত্তার নামের দু’জন পলাতক রয়েছে। রফিক ওই রাতে হত্যা ও ডাকাতির ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। আর ছাত্তার তাদেরকে ডাকাতি করতে সহযোগিতা করে। এছাড়া পলাতক ছাত্তার ছিনতাই করা মোবাইলসহ অন্যান্য জিনিস কিনে নেয়।

অনুসন্ধান ও ডিবিসূত্রে জানা গেছে, গ্রেপ্তারকৃত ডাকাতরা রাত ১২ টার পরে কিংবা গভীর রাতে  ভাড়া করা পিক-আপ নিয়ে ডাকাতির উদ্দেশ্যে বের হয়। পিক-আপের সামনের সিটে ৩ জন বসে এবং পিছনে যাত্রী হিসেবে ২/৩ জন বসে থাকে। ঢাকার কাওরানবাজার, যাত্রাবাড়ী, ভূলতাসহ অন্যান্য এলাকায় পাইকারি বাজারে মাছ, ফলমূল ও সবজি কিনতে যাওয়া ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে। যাদের বেশির ভাগই উত্তরখান, দক্ষিণখান, ভূলতা, রূপগঞ্জ, কাওলা, গাজীপুর এলাকার বাসিন্দা। এসব ব্যবসায়ীরা বাজার থেকে পাইকারি দামে সবজি কিনে এলাকায় নিয়ে বিক্রি করে। তাই গভীর রাতে তারা বাসা থেকে বের হয়ে গাড়ির অপেক্ষায় সড়কে দাঁড়ায়। বাজারে যাওয়ার সময় তাদের প্রত্যেকের সঙ্গেই ৫ হাজার টাকা থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত থাকে। ডাকাত দলের সদস্যরা এসব ব্যবসায়ীদের পাইকারি আড়তে পৌঁছে দেয়ার জন্য যাত্রী হিসেবে পিকআপে উঠায়। আব্দুল্লাহপুর থেকে কাওরানবাজার, কখনও রামপুরা থেকে যাত্রাবাড়ী, কখনও যাত্রাবাড়ী থেকে ভূলতা গাউছিয়া এই সকল রোডগুলোকে টার্গেট করে ডাকাতি করে। কারণ বিভিন্ন পাইকারি বাজারকে ঘিরে রাতভর আশপাশের সড়কগুলোতে ব্যবস্থা থাকে। গত দুই বছরে বিভিন্ন এলাকার অন্তত দুই শতাধিক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে তারা ডাকাতি করেছে। ডাকাতির শিকার অনেকেই নিঃস্ব হয়ে গেছে।

আপন মিয়া ও তার সঙ্গী নজরুল ইসলাম দক্ষিণখানের কাওলার নামাপাড়া মতিউর রহমানের বাসায় ভাড়া থাকতেন। তাদের দু’জনের বাড়ি কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামে। প্রতিদিন তারা কাওরান বাজার থেকে শাক-সবজি কিনে কাওলা এলাকায় বিক্রি করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২৮শে ডিসেম্বর রাতে তারা বাসা থেকে বের হয়ে কাওরান বাজারের উদ্দেশে কাওলার ফুটওভার ব্রীজের পূর্ব পাশের গোড়ায় ঢাকাগামী মহাসড়কে এসে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ডাকাতদলের সদস্যরা সেখানে এসে যাত্রী উঠানোর ভান করে কাওরান বাজার, কাওরান বাজার বলে ডাকতে থাকে। আপন মিয়া ও নজরুল ইসলাম কাওরান বাজার যাওযার জন্য যাত্রী হিসেবে পিক-আপে উঠেন। পিকআপটির সামনের সিটে আগে থেকে চালক বাচ্চু, সজীব ও সজল ছিল। আর পেছনে মুসা ও রফিক ছিল। কিছু দুর যাওয়ার পর মূসা ও রফিক আপন ও নজরুলের বুকে চাকু ধরে। মূহুর্তের মধ্যে সামনের সিটে বসে থাকা সজল পিছনে চলে আসে। ছুরি ধরে ভয়-ভীতি দেখিয়ে তাদের কাছে থাকা টাকা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়।  তারপর তারা আপন মিয়াকে ধাক্কা মেরে চলন্ত গাড়ি থেকে ফেলে দেয়। সড়কে পড়ে ছটফট করতে থাকেন আপন মিয়া। কিছুদূর যাওয়ার পর নজরুল ইসলামের কাছ থেকে সব কেড়ে নিয়ে তাকেও রাস্তায় ফেলে দিয়ে চলে যায় ডাকাতরা। পরে সড়কে পড়ে থাকা আপন মিয়াকে উদ্ধার করে অপরিচিত সিএনজি চালক নিয়ে যান শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ব্রেন হ্যামারেজের কারণে সেখানেই আপন মিয়ার মৃত্যু হয়। খবর যায় তার বাড়িতে। শেরেবাংলা থানার মাধ্যমে মরদেহ বুঝে নেয় পরিবার। এ ঘটনায় ৬ই জানুয়ারি নিহত আপন মিয়ার স্ত্রী সুফিয়া বাদী হয়ে বিমানবন্দর থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। থানা পুলিশের পাশপাশি মামলার তদন্ত করে ডিবি গুলশানের একটি টিম।

ডিবি গুলশানের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার গোলাম সাকলায়েন মানবজমিনকে বলেন, মামলাটি সম্পূর্ণ ক্লুলেস ছিল। একটি ভিডিও ফুটেজ ও প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে আসামিদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আসামিরা আমাদের কাছে ডাকাতি ও হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। তারা দুই বছর ধরে এই কাজে জড়িত।

নিহত আপন মিয়ার স্ত্রী সুফিয়া বলেন, আমার স্বামীর আয়েই সংসার চলতো। চার মাস বয়সী একটি কন্যা শিশু আছে আমাদের। তার একটি কান বন্ধ, ঠিকমতো শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারে না। স্বামী নাই এখন কি করে বাচ্চার ওষুধের খরচ, নিজের থাকা খাওয়ার খরচ চালাবো? স্বামীকে হারিয়ে পুরোপুরি নিঃস্ব হয়ে গেলাম।

ডিবি’র অতিরিক্ত কমিশনার কেএম হাফিজ আক্তার গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, এ ধরনের ঘটনা সম্প্রতি বেশি হচ্ছে। স্বল্প আয়ের মানুষদের সঙ্গে এমনটা হচ্ছে। তারা ভয়ে ও ঝামেলা এড়াতে পুলিশের কাছে অভিযোগও করে না। তাই গভীর রাতে ডাকাতির মতো ঘটনা এড়াতে পুলিশি টহল ও অভিযান বাড়ানো হয়েছে। কারণ মূলত রাত ২টা থেকে ভোররাত পর্যন্ত তারা ডাকাতি করে। তিনি বলেন, রাতের বেলা অপরিচিত গাড়ি ভাড়া বা অপরিচিত ট্রাক-ভ্যানে উঠার ক্ষেত্রে সচেতন থাকতে হবে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status