শেষের পাতা

যুবতীর সঙ্গে জোরপূর্বক অশ্লীল ভিডিও করাতো অপহরণকারীরা

শুভ্র দেব

২০ জানুয়ারি ২০২১, বুধবার, ৯:১৪ অপরাহ্ন

প্রতীকী ছবি

মিহির রায় একজন ফাস্ট ফুড বিক্রেতা। উত্তরার ৯ নম্বর সেক্টরে তার ‘ফুড স্টোরী’ নামে একটি দোকান আছে। ব্যবসা ভালোই চলছিল এই ব্যবসায়ীর। তার ফাস্ট ফুডের মান ভালো সেজন্য কিছু ক্রেতা নিয়মিত তার দোকানে আসতেন। একদিন এমনই এক ক্রেতা মিহিরকে খাবারের প্রশংসা করে বলেন- তার ভাইয়ের একটি অনুষ্ঠানে ৮০ প্যাকেট খাবার লাগবে। মিহির তখন সম্মতি জানিয়ে বলেন- কিছু টাকা অগ্রিম দিতে হবে। তখন ওই ক্রেতা বাসা থেকে টাকা দিতে হবে- এমনটা জানিয়ে মিহিরকে সঙ্গে নিয়ে যান। এরপর থেকে পরিবারের সদস্যরা মিহিরের আর খোঁজ পাচ্ছিলেন না। হাত, মুখ ও চোখ বাঁধা মিহির একসময় নিজেকে আবিষ্কার করেন তিনি অপহৃত হয়েছেন। এদিকে মিহিরের পরিবারের সদস্যরা যখন খোঁজাখুঁজি করে তার সন্ধান পাচ্ছিলেন না ঠিক তখন একটি অপরিচিত নম্বর থেকে তার স্ত্রীর মোবাইলে কল আসে। মোবাইল ফোনের অপর প্রান্ত থেকে মিহির বলেন, তার হাত-পা বেঁধে রাখা হয়েছে। ২০ লাখ টাকা দিলে তারা তাকে ছেড়ে দেবে। পরে তার স্ত্রী বিভিন্ন সময়ে অপহরণকারীদের ২ লাখ ৯১ হাজার টাকা দেন। তবুও অপহরণকারীদের ডেরা থেকে মুক্তি পাননি মিহির। তাদের দাবিকৃত বাকি টাকা দেয়ার জন্য প্রতিনিয়ত মিহিরকে টর্চার করতে থাকে এবং প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। উপায়ান্তর না পেয়ে মিহিরের স্ত্রী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারস্থ হন। পরবর্তীতে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ উত্তরের একটি টিম মিহিরকে উদ্ধার করেছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে অপহরণকারী চক্রের মিরাজ (৩৫) ও বৃষ্টি (২১)কে। বাকি সদস্যরা পলাতক রয়েছেন।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার কে এম হাফিজ আক্তার গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন সোমবার বিকাল চারটায় দক্ষিণখান থানার চেয়ারম্যান পাড়ার একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে অপহৃত ভিকটিমকে উদ্ধারসহ অপহরণকারী চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করে উত্তরা জোনাল টিম। গ্রেপ্তারের সময় তাদের হেফাজত থেকে অপহরণে ব্যবহৃত একটি ছুরি, ৫৭টি ইলেক্ট্রিক্যাল ক্যাবল টাইস, একটি স্ক্রু ড্রাইভার ও একটি প্লাস উদ্ধার করা হয়। সেই সঙ্গে ভিকটিমের স্ত্রীর কাছ থেকে বিকাশে নেয়া নগদ ৪৯ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, যে চক্রটি ব্যবসায়ী মিহির রায়কে অপহরণ করেছিল তারা পেশাদার অপহরণকারী। গত বছরের অক্টোবর থেকে তারা নিয়মিত এই কাজ করতো। প্রতি মাসে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অন্তত ৩/৪ জন ব্যক্তিকে তারা ধরে নিয়ে যেতো। গোপন আস্তানায় নিয়ে তারা ভুক্তভোগীদের নানাভাবে টর্চার করতো। প্রাণনাশের ভয়ভীতি দেখিয়ে পরিবারের লোকজনের কাছ থেকে বিকাশের মাধ্যমে আদায় করতো লাখ লাখ টাকা।
ডিবি জানিয়েছে, ১৩ই জানুয়ারি মিহির রায় অপহরণের পর বিকাশের মাধ্যমে অনেক টাকা দিয়েও অপহরণকারীদের কাছ থেকে স্বামীকে ছাড়াতে পারছিলেন না তার স্ত্রী। বরং উল্টো অপহরণকারীরা মিহিরকে নির্যাতন করে প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছিলো। পরে ১৬ই জানুয়ারি উত্তরা পশ্চিম থানায় অপহৃত ব্যবসায়ী মিহির রায়ের স্ত্রী বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। ওই ব্যবসায়ীকে উদ্ধারের জন্য বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালায় ডিবি। তদন্তকালে ডিবি জানতে পারে অপহরণ চক্রটি ভিকটিমকে দক্ষিণখানের চেয়ারম্যান পাড়ার হেজুর উদ্দিন রোডের একটি বাড়িতে আটকে রেখেছে। এমন সংবাদ পেয়ে ওই বাড়িতে অভিযান চালানো হয়। বাড়িটির ৩য় তলার একটি ফ্ল্যাট থেকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ভিকটিমকে উদ্ধার করা হয়।
ডিবি আরো জানায়, অপহরণকারী এই চক্রের আস্তানায় একজন তরুণীকে রাখা হয়। ওই তরুণী অপহরণকারীদের জন্য রান্না করেন। এ ছাড়া যাদেরকে অপহরণ করে নেয়া হয় তাদেরকে বস্ত্রহীন করে ওই তরুণীর সঙ্গে অশালীন ভিডিও ও ছবি তোলা হয়। অপহৃতদেরকে নানাভাবে টর্চার করে তাদের পরিবারের কাছ থেকে টাকা আদায়ের পর ছেড়ে দেয়ার সময় বলা হয় যদি মুখ খুলে বা পুলিশের কাছে কিছু বলে তবে এসব অশ্লীল ভিডিও ও ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেয়া হবে। এ জন্য অনেক ভুক্তভোগী মান-সম্মানের ভয়ে নির্যাতনের শিকার হয়েও মুখ খুলতো না। কিছু দিন পর পর তারা এই কাজের জন্য নতুন নতুন যুবতীকে নিয়ে আসতো। নির্দিষ্ট বেতনে ওই যুবতীরা কাজ করতো। রান্না আর ভুক্তভোগীদের সঙ্গে ছবি তোলা ছাড়াও অপহরণকারীদের সঙ্গে যুবতীরা শারীরিক সম্পর্ক করতো। এই চক্রের সর্বশেষ যুবতী ছিল গ্রেপ্তার বৃষ্টি। ডিবি জানায়, এই চক্রের মূলহোতারা পলাতক রয়েছে। তাদেরকে এখনো গ্রেপ্তার করা যায় নি।
এদিকে অপহরণকারী চক্রের সদস্যদেরকে ডিবি গ্রেপ্তার করেছে, এমন খবর পেয়ে গতকাল ডিবি অফিসে এসেছিলেন এমন আরো অনেক ভুক্তভোগী। তাদের কাছ থেকেও প্রায় একই কৌশলে নির্যাতন করে টাকা আদায় করেছে অপহরণকারীরা। এমন এক ভুক্তভোগী হলেন- ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা এলাকার নেয়ামত উল্লাহ। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ঢাকায় রেন্ট-এ- কারের গাড়ি চালাতেন। গত বছরের শেষের দিকে তাকে অপহরণ করে নিয়ে যায় চক্রটি। নেয়ামত মানবজমিনকে বলেন,  ১০ই ডিসেম্বর রাতে আমি কেউলা এলাকা দিয়ে গাড়ি চালিয়ে আসছিলাম। এমন সময় দেখতে পাই একটি হাইয়েস গাড়ি আমার গাড়ি থামানোর জন্য সংকেত দিচ্ছে। কিন্তু আমি গাড়ি না থামিয়ে সামনে যাচ্ছিলাম। এমন সময় ওই হাইয়েসটি সামনে এসে ব্যারিকেড দিয়ে আমার গাড়ি থামায়। পরে গাড়ি থেকে কয়েকজন নেমে এসে আমাকে বলে এত দেরি হলো কেন গাড়ি থামাতে। আমি বলি চাইলেই তো গাড়ি থামানো যায় না, সময় লাগে। পরে তারা আমার গাড়ির কাগজপত্র দেখতে চায়। আমি বলি কাগজপত্র দেখার জন্য তো পুলিশের আরেকটি ডিপার্টমেন্ট আছে। তখন তারা তুই কি আমাদেরকে আইন শিখাবি বলেই মারধর শুরু করে। তারপর আমার গাড়ির লাইসেন্স দেখে বলে মেয়াদ নাই স্যারের কাছে যেতে হবে। এরপর আমাকে তাদের হাইয়েসের কাছে নিয়ে যায়। সেখানে যাওয়ার পরপরই আমাকে কয়েকজন ধরে ধাক্কা দিয়ে গাড়ির ভেতরে তুলে। তখন মাথায় রিভলবার ধরে আমার মুখে কিছু একটা দিয়ে মুখ চোখ-মুখ বেঁধে ফেলে। ১ মিনিট পরে আমি আর কিছু বলতে পারি নাই। তিনি বলেন, ১৪ দিন তারা আমাকে আটকে রেখেছিল। আমার কাছে তারা ২০ লাখ টাকা চায়। কিন্তু এত টাকা দিতে আমি রাজি হইনি। এরপর টাকা কমিয়ে ১১ লাখ চায়। সেটিও দিতে অপারগতা জানালে তারা আমার শরীরে ইলেকট্রিক শর্ট দিয়ে টর্চার করে। ওই সময় তারা আমার ঢাকা ও বাড়ির ঠিকানা নিয়ে হয়তো খোঁজখবর নিয়েছে। একপর্যায়ে তারা আমাকে বলে ৫ লাখ টাকা দিতেই হবে। পরে আমার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে সব মিলিয়ে ৪ লাখ ৮৩ হাজার টাকা আদায় করে। পরে আমাকে তিনশ’ ফিট সড়কে চোখ বেঁধে ফেলে রেখে যায়।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status