প্রথম পাতা

রোহিঙ্গা পাচারে ভয়ঙ্কর চক্র

মোহাম্মদ ওমর ফারুক, কক্সবাজার থেকে ফিরে

১৯ জানুয়ারি ২০২১, মঙ্গলবার, ৯:৪৬ অপরাহ্ন

ফাইল ছবি

দিনে দিনে রোহিঙ্গা পাচারের হার বাড়ছে। ক্যাম্পে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ, খুনোখুনিসহ নানা কারণে পাচারকারীদের ফাঁদে পা দিচ্ছে তারা। পাচারকারীরা নারী এবং শিশুদের টার্গেট করে তাদের মিশন পরিচালনা করছে। পাচারে জড়িত ভয়ঙ্কর কয়েকটি চক্র কৌশলে রোহিঙ্গাদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। ভয়ঙ্কর সাগর পথ পাড়ি দিতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করছেন অনেকে। সরজমিন উখিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পের বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তারাও বিষয়টি স্বীকার করছে। তবে তাদের বিরুদ্ধে ভয়ে কথা বলতে পারছেন না তারা। এসব  রোহিঙ্গাদের মধ্যে এসব মানবপাচারকারী সদস্যরা ক্যাম্পের স্থানীয় কয়েকটি সন্ত্রাসী বাহিনীর সঙ্গে তাদের যোগাযোগ রয়েছে বলে জানা গেছে।
জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের জানুয়ারির মধ্যে দেড় হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান সাগর পাড়ি দিয়েছে, যা ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালে সমুদ্র পাড়ি দেয়া মানুষের তুলনায় প্রায় ৫০ গুণ বেশি। ২০১৫ সালে সমুদ্রযাত্রীদের বেশির ভাগই ছিল পুরুষ। কিন্তু ২০১৮ সালের সমুদ্রযাত্রীদের শতকরা ৫৯ ভাগই নারী ও শিশু। গত বছরের চিত্র আরো ভয়াবহ। জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থা আইওএম বিভিন্ন সময় কাজ করতে গিয়ে ২০১৭ থেকে ২০২০ পর্যন্ত প্রায় ৬৩৩ জন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলেছেন এবং তাদের নিয়ে কাজ করেছেন। তাদের হিসাব অনুযায়ী গত তিন বছরে ৪৫% অর্থাৎ ৩৪৮ জন রোহিঙ্গা  ভুক্তভোগী ছিলেন।

 টার্গেট মালয়েশিয়া: বাংলাদেশের পর রোহিঙ্গাদের বড় একটি অংশ অবস্থান করছে মালয়েশিয়া। সেখানেই টার্গেট করে রোহিঙ্গাদের পাঠানোর চেষ্টা করে দালালরা। বিশেষ করে নারী ও শিশুদের। বিভিন্ন সময় সাগর পথে পাড়ি দিতে গিয়ে উদ্ধার হওয়া বেশির ভাগ ব্যক্তিরাই বলছেন, তাদের অনেক স্বজন রয়েছে মালয়েশিয়াতে। আর এসব স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করেই তারা বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো থেকে বের হচ্ছিলেন। তাদের আশ্রয়দাতা বেশিরভাগই মালয়েশিয়ায় বসবাসরত  রোহিঙ্গা স্বজনরা। তারা সেখানে আশ্রয়ের আশায় ও ভালো থাকার লোভে পাড়ি জমায়। কিন্তু এই চিত্র ভিন্ন সেখানে। অভিযোগ রয়েছে, মালয়েশিয়াতে গিয়েও তারা নানান নির্যাতনের শিকার হন। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মেয়ের বিয়ে দিতে এবং বাংলাদেশের ক্যাম্পের চেয়ে আরো ভালো থাকার জন্য তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করেন। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে, মানবপাচারকারী চক্রগুলো রোহিঙ্গাদের টার্গেট করে। বিশেষ করে রোহিঙ্গা নারীদের। কারণ সে দেশে থাকা রোহিঙ্গা পুরুষদের সঙ্গে বিয়ে দেয়ার জন্য তাদের নিয়ে যায় মালয়েশিয়ায় থাকা স্বজনরা। তবে উখিয়া রোহিঙ্গা একটি ক্যাম্পের প্রধান মাঝি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রোহিঙ্গা নারীদের মালয়েশিয়া বিয়ে হলেও, ওখানে যাওয়া বড় একটি অংশ অন্যান্য দেশে যেতে চায়। বিশেষ করে অস্ট্রিলিয়া, জার্মানসহ ইউরোপের দেশগুলোতে। ওই মাঝি বলেন, কোথাও আমাদের কেউ নেই। কিন্তু আমাদের এখানে (ক্যাম্পে) কিছু দালাল আছে। যারা স্থানীয় দালালদের সঙ্গে মিশে রোহিঙ্গা নারীদের রাজি করানোর চেষ্টা করে। তাদেরকে নানান প্রলোভনও দেখানো হয়। যেহেতু আমরা এখানে খুব কষ্টে থাকি, সবাই চায় একটু ভালো জায়গায় থাকতে। ফলে রোহিঙ্গারা সহজে রাজি হয়ে যায়। জানা গেছে, পাচারকারীরাও অতি সহজে রোহিঙ্গাদের পাচারে রাজি করাতে পারে বলে তাদের সবচেয়ে নিরাপদ মনে করে। রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে টাকা নিতে পারলে ফেরত দেয়ার ঝুঁকিও থাকে না। পাচারকারীদের লাভও হয় অনেক বেশি। এদিকে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব রোহিঙ্গারা মালয়েশিয়া গেলেও কিছু ওখানে থেকে যায়।

দেখানো হয় বিয়ের প্রলোভন: টেকনাফ এবং উখিয়ায় ৩০টির বেশি ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়ে আছেন প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা। যারা মিয়ানমারে নানা অত্যাচার, নির্যাতন  ও গণহত্যার শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। কিন্তু এসব পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে অবিবাহিত নারীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। উখিয়া কুতুপালং ক্যাম্পের সাহিদা বেগম নামে এক নারী এই প্রতিবেদক’কে বলেন, আমাদের মেয়েদের নিয়ে খুব যন্ত্রণায় আছি। আমার চারটি মেয়ে। কিন্তু এখানে বেড়ার ঘর। বাঁশ বেত দিয়ে বানানো। ছিদ্র ও ফাঁকা। এসব ছিদ্র ও ফাঁকা ঘরে বখাটেরা নানান সময় উৎপাত করে। ঘরে মেয়েদের রাখা খুব কঠিন। উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে ঘুরে জানা গেছে, সাহিদার মতো অসংখ্য রোহিঙ্গা নারী তার পরিবারের নারী সদস্যদের নিরাপত্তা নিয়ে বিপাকে আছেন। শরণার্থী শিবিরে সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন নারীরা। তারা চেষ্টা করেন অল্প বয়সে বিয়ে দিতে, না হয় দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিতে। ফলে গত দুই বছর ধরে, নারীদের ঝুঁকি নিয়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে। দালালরাও তাদেরকেই টার্গেট করছে। টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান নূরুল আলম বলেন, এই চক্রের সঙ্গে স্থানীয় ও রোহিঙ্গা চক্র জড়িত। বিষয়টি নিয়ে আমরাও উদ্বিগ্ন। এবং থানা আইনশৃঙ্খলা কমিটির মিটিংয়ে নিয়মিত আলোচনা হয়। টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী বলেন, রোহিঙ্গাদের অনেকের আত্মীয়স্বজন মালয়েশিয়ায় থাকেন এটা ঠিক, তারাই টেকনাফ এবং উখিয়ায় বিভিন্ন ক্যাম্পে থাকা তাদের স্বজনদের সমুদ্রপথে অবৈধভাবে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। আমরা তো সবসময় পাহারা দিয়ে রাখতে পারি না। প্রতিনিয়তই এই ধরনের ঘটনা ঘটে। এসব লোকজন বিদেশ গিয়ে বাংলাদেশি পরিচয় দেয়। যা খুব দুঃখজনক। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছেন, বিভিন্ন সময় উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গা এবং আটক দালালদের জিজ্ঞাসাবাদে তারা আরো অনেক তথ্য পেয়েছেন। তারা বলছেন, পাহাড়, নদী ও সমুদ্র পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে এসব নারী ও শিশুদের মালয়েশিয়ায় পৌঁছিয়ে দিচ্ছে মানবপাচারকারী চক্রগুলো। উখিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক  চৌধুরী বলেন, এই ঘটনা অনেক পুরনো। দিনে দিনে এই হার বাড়ছেই। এসব বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে শুরু করে সবাই কাজ করছে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে সচেতনতা ছাড়া উপায় নেই।

পাচারের নানা কৌশল: এক সময় স্থানীয় বাংলাদেশি জনগণকে নিয়ে টার্গেট থাকলেও পাচারকারী সদস্যরা এখন টার্গেট করছে রোহিঙ্গাদের। এখন স্থানীয় ও রোহিঙ্গাদের অভ্যন্তরীণ দালাল চক্রের সদস্যদের মূল টার্গেট থাকে ক্যাম্পগুলোতে। বছর খানেক আগেও নারী-পুরুষ উভয় টার্গেট থাকলেও, পাচারকারী চক্রের সদস্যরা সাম্প্রতিক সময়ে নারীদেরই টার্গেট করে রাখে। বিশেষ করে এসব নারীদের বিয়ের কথা বলে মালয়েশিয়ায় পাঠানোই মূল টার্গেট তাদের। পাচারকারী চক্রগুলোর নতুন কৌশল এটি। এসব রোহিঙ্গাদের টার্গেট  করে মাসতিনেক ধরে বোঝানো হয়। তাদের পরিবারে মাসে দুই তিনবার যাওয়া হয়। প্রতিবার গিয়ে বুঝানো বা প্রলোভনের কাজটি করে রোহিঙ্গা চক্রটি। তাদের কাজই হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের ম্যানেজ করা। নানা প্রলোভন দেখানো। পরে ম্যানেজ হলে এরপর দিনক্ষণ ঠিক করে, ছোট ছোট দলে ভাগ করে লোকজনকে আলাদাভাবে এনে এক জায়গায় জড়ো করা হয়। এরপর ছোট ছোট নৌকায় করে গভীর সাগরে পাঠানো হয়। সেখান থেকে নিয়ে তুলে দেয়া হচ্ছে বড় জাহাজে। এই পুরো প্রক্রিয়াটি দালাল চক্রের কাছে প্রজেক্ট হিসেবে পরিচিত।

কুতুপালং ২ নম্বর ক্যাম্পের হেড মাঝি সিরাজুল মোস্তফা এই প্রতিবেদককে বলেন, পাচারকারীরা খুব চালাক প্রকৃতির হয়। তারা নানান সময় নানান পন্থা অবলম্বন করে। প্রথমে তারা সাম্পান আকারের ছোট নৌকায় তুলে তীর থেকে  লোকজনকে সাগরে নিয়ে মাছ ধরার ইঞ্জিনচালিত নৌকা বা ট্রলারে তুলে  দেয়। এসব নৌকা সাধারণত সাগরে জাল দিয়ে মাছ ধরতে যায়। সেন্ট মার্টিনস দ্বীপ অতিক্রম করে আকিয়াব উপকূলের কাছাকাছি থাকে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়াগামী বড় জাহাজগুলো। মালয়েশিয়াগামী লোকজনকে পাচারকারীরা মাছ ধরার নৌকা থেকে বড় জাহাজে তুলে দেয়। আরো কয়েকজন রোহিঙ্গা মাঝির সঙ্গে কথা বলেও একই দৃশ্য ও ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়। জানা যায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে সব ধরনের কাজই করে তারা। টেকনাফের স্থানীয়রা বলছেন, তাদের ইউনিয়নের গ্রামগুলো নাফ নদ ও বঙ্গোপসাগরের তীরে। এই সুযোগ নিয়ে এবং অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় পাঠানোর জন্য এই গ্রামগুলোর বিভিন্ন পয়েন্ট ব্যবহারের মাত্রা এখন বেড়েছে। জানা গেছে, আগে তারা এক জায়গায় লোকজন জড়ো করতো। এখন তা করে না। এখন পাচারকারীরা দৃশ্যের পেছনে থাকে। মালয়েশিয়া থেকে রোহিঙ্গাদের স্বজনরাই সরাসরি টেলিফোনে এখানে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের গভীর রাতে কোন একটি জায়গায় থাকতে বলে। সেখানে তারা গেলে তখন দালালরা তাদের ছোট নৌকায় করে নাফ নদের মাঝে নিয়ে বড় নৌকায় উঠায়। এরপর মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছেন, নাফ নদ থেকে বঙ্গোপসাগরে ঢুকে ছেঁড়া দ্বীপ হয়ে পাচারের চেষ্টা করা হয় রোহিঙ্গাদের। এসব রোহিঙ্গাদের টেকনাফ থেকে থাইল্যান্ড হয়ে মালয়েশিয়ায় নিয়ে যেতো। এখনো সেই রুট ব্যবহারের চেষ্টা করে। অনেক সময় সরাসরি মালয়েশিয়া নিয়ে যায়।  

কি বলছেন পাচারে শিকার রোহিঙ্গারা: গত বছরে ১১ই ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গোপসাগর দিয়ে মালয়েশিয়া যাত্রাকালে সেন্টমার্টিনের কাছে ট্রলারডুবিতে উদ্ধার রোহিঙ্গা নারীদের একজন আসমা বেগম। তিনি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বুশিডং জেলা থেকে ২০১৭ সালের দিকে পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন। আসমা বলেন, আমরা কয়েকজন ফোনে বিয়ে করেছি। মালয়েশিয়ায় আমাদের স্বামী রয়েছে। যার কারণে আমরা যাচ্ছিলাম। আমাদের সঙ্গে নজিবা নামে একজনের মোবাইল ফোনে বিয়ে হয়। কিন্তু সে ডুবে মারা যায়। সেও স্বামীর কাছে যাচ্ছিলো। জানা গেছে আগেও আসমা দুইবার অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করেছেন বলে জানিয়েছেন টেকনাফের  লেদা নতুন শিবিরের মাঝি আবু বক্কর। তিনি বলেন, অনেক বছর ধরেই বিদেশে থাকা রোহিঙ্গা পাত্রের সঙ্গে মোবাইল ফোনে বিয়ে হচ্ছে ক্যাম্পের নারীদের। বিয়ের পর স্বামীরা তাদের নেয়ার চেষ্টা করে।

পাচারে ব্যবহার হচ্ছে যেসব পয়েন্ট: রোহিঙ্গাদের বিদেশ পাচারের ক্ষেত্রে ব্যবহার হয় টেকনাফ ও উখিয়ার বেশ কয়েকটি পয়েন্ট। যেসব পয়েন্টে নানান সময় মানবপাচারের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। পয়েন্টগুলো পুরনো হলো কৌশল বদলে সেগুলোকে আবার নানাভাবে ব্যবহার করা হয়। এসব পয়েন্টের মধ্যে টেকনাফের শামলাপুর, শীলখালি, রাজারছড়া, জাহাজপুরা, সবারাং, শাহপরীরদ্বীপ, কাটাবনিয়া, মিঠাপানিরছড়া, জালিয়াপালং, ইনানী, হিমছড়ি, রেজুখাল, কুতুবদিয়াড়া, খুরুশকুল, চৌফলদণ্ডি, মহেশখালী। সীতাকুণ্ড ও মাঝিরঘাট এলাকা হয়ে ট্রলারে মানবপাচার হয়ে থাকে। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে স্থানীয়সহ বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা। তারা সবাই টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পের বাসিন্দা।
নিয়ন্ত্রণ করছেন যারা: খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, রোহিঙ্গা পাচারের ক্ষেত্রে টেকনাফ ও উখিয়ার বেশ কয়েকটি চক্র সরাসরি জড়িত। নানান সময় তাদের বিরুদ্ধে দুই থানায় মামলা হলেও সময় বুঝে তারা সক্রিয় হয়ে ওঠে। আবার সময় বুঝে গাঢাকা দেয়। গত দুই বছর  পর্যন্ত রোহিঙ্গা পাচার মামলায় ১৫৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। এর বাইরেও রয়েছে অনেকে। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যারা এই চক্রটি নিয়ন্ত্রণ করে তাদের বেশ কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। তারা হলেন টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ মিস্ত্রিপাড়ার শরীফ হোছন, মো. সেলিম ওরফে লম্বা সেলিম, মো.শুক্কুর ওরফে শুক্কুর মাঝি, মাঝের পাড়ার আবুল কালাম ওরফে কালাম, ডাংগরপাড়ার ফিরোজ আহমদ, সেন্টমার্টিনের বাজার পাড়ার আব্দুর রহমান, পশ্চিমপাড়ার ফয়াজ উল্লাহ ওরফে ফয়াজু, বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর এলাকার মৌলভী আশরাফ আলী, মো. ইউনুছ মেম্বার, আয়াত উল্লাহ, আজিজুল ইসলাম পুতু, মনখালী এলাকার মো. রফিক, শামলাপুর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মৌলভী রহিম উল্লাহ, শীলখালী এলাকার মফিদুল্লাহ, নোয়াখালী এলাকার আব্দুল্লাহ।

রোহিঙ্গা দিয়ে রোহিঙ্গা পাচার:
টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের নোয়াখালী মধ্যমপাড়ার লাইলা বেগম। একজন রোহিঙ্গা নারী। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, ওই নারী প্রতিটি ক্যাম্পে ঘুরে সংগ্রহ করেন মালয়েশিয়ায় যেতে ইচ্ছুক নারীদের। লাইলা বিয়ে করেছেন ওই গ্রামের বাসিন্দা রেজাউল করিম খোকাকে। খোকা এলাকার আবদুল আলী সিন্ডিকেট নামে পরিচিত একটি মানবপাচারকারী চক্রের সদস্য। এ রকম আরো অসংখ্য সিন্ডিকেট রয়েছে ক্যাম্পগুলোতে। যারা নিয়মিত মালয়েশিয়ায় যেতে ইচ্ছুক নারীদের জোগাড় করে। এবং তাদের সঙ্গে দামদর করে। টেকনাফ লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পের বসবাসরত বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রোহিঙ্গারা নিজেরাই রোহিঙ্গা পাচারে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। যারা সাগরপথে মালয়েশিয়ায় মানবপাচারে সক্রিয়ভাবে জড়িত রোহিঙ্গা দালাল চক্র। এবং নিজেদের গোত্রের বলে তাদের সহজে বিশ্বাসও করছে ভুক্তভোগীরা। তাদের সঙ্গে এই অপকর্মে স্থানীয় অংশীদার হচ্ছে স্থানীয় চক্রটিও। এরইমধ্যে সমুদ্র মালয়েশিয়ায় মানবপাচারের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা দালাল। তাদের  দেয়া তথ্যে উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরে মানবপাচারকারী চক্রের অনেক সদস্যের নাম বেরিয়ে আসে। তাদের মধ্যে রয়েছেন- হাফেজ ছলিম, আতাত উদ্দিন, মোহাম্মদ আলম, আবদুর করিম, হাফেজ মোহাম্মদ আইয়ুব, মোহাম্মদ ইলিয়াছ, মোহাম্মদ কবির, আমির হোসেন, মোহাম্মদ ফয়েজ, নূর  হোসেন, মোহাম্মদ রশিদ, হাসিম উল্লাহ, মোহাম্মদ শাহ ও মোহাম্মদ হামিদ। তারা সবাই উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা। এ ছাড়াও আরো বেশ কয়েকটি চক্র সক্রিয় ওই ক্যাম্পগুলোতে। যারা নিয়মিত রোহিঙ্গা নারী সংগ্রহে ব্যস্ত থাকে। তাদের ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিয়মিত রোহিঙ্গা বাসায় মাইকিং করলেও থেমে নেই এই চক্রটি।

সাগরপথে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা: উত্তাল সাগরের বুক চিড়ে অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় যাওয়াটা রোহিঙ্গাদের কাছে যেন এক স্বপ্নের যাত্রা। গত বছরের এপ্রিলে করোনাভাইরাস আতঙ্কের মধ্যে উপকূলে আসা ৩৯৬ জন রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করা হয়েছে। তারা মালয়েশিয়া যাওয়ার আশায় দুই মাস ধরে সাগরে ভাসছিলো। উদ্ধার হওয়ারা দুই মাস আগে ৪৮২ রোহিঙ্গা মানবপাচারকারীদের প্ররোচনায় উন্নত জীবন ও বিয়ের আশায় মালয়েশিয়ায় রওনা হয়েছিল। কিন্তু মালয়েশিয়ার  নৌবাহিনী তাদের সেখানে ভিড়তে না দেয়ায় তারা আবার টেকনাফ উপকূলে ফিরে আসে। উদ্ধার রোহিঙ্গারা সবাই উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন শিবিরের বাসিন্দা। তারা বলছেন, প্রথমে মালয়েশিয়ার নৌবাহিনী, এরপর থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারের নৌবাহিনীর বাধার মুখে পড়ে তারা বাংলাদেশের উপকূলে ফিরে আসতে বাধ্য হন। এই  একই ঘটনায় সাগরে অভুক্ত থেকে ৩২ রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছিল। বিভিন্ন সংস্থার তথ্য বলছে, ঝুঁকি নিয়ে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার পথে শুধুমাত্র এক বছরে সাগরে ডুবে দুইশ’র বেশি রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। অনেকে নিখোঁজ হয়েছে। ২০২০ সালেই এমন নির্মম পরিণতি ঘটে এসব রোহিঙ্গার ভাগ্যে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) বলছে, বাংলাদেশের আশ্রয়শিবির থেকে যারা মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় বিপজ্জনক ভ্রমণ করেছে তাদের বেশির ভাগ ছিল শিশু বা অপ্রাপ্তবয়স্ক।

রোহিঙ্গা পাচার নিয়ে বেড়েছে মামলা ও আসামি: টেকনাফ ও উখিয়া থানায় গত তিন বছরে রোহিঙ্গা পাচার ঘটনায় ৫৩টি মামলায় ১৪৯ জনকে আসামি করা হয়েছে। এরমধ্যে ২০১৭ সালে মামলার সংখ্যা শূন্যের কোঠায় থাকলেও পরের বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালের এই মামলার ৮ জনকে আসামি করে ২টি মামলা দায়ের হয়। ঠিক এর এক বছর পরে এই মামলা বেড়ে যায় তিনগুণ। মামলা হয় ২৩টি, আসামি করা হয় ১০৬ জনকে। এরপরের বছর মানবপাচার বাড়লেও আগস্ট মাস পর্যন্ত মামলার সংখ্যা ছিল ৩টি। আসামি ছিল ২৩ জন।

কি বলছেন সংশ্লিষ্টরা: কক্সবাজারের ১৬ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক (পুলিশ সুপার) হেমায়েতুল ইসলাম বলেন, আগে অনেক পাচার হতো। বিষয়টি কমে এসেছে। আমি এখানে যোগদানের পর উল্লেখযোগ্যহারে পাচার দেখিনি। এই এলাকাটিই অপরাধপ্রবণ এলাকা। পাচার হতেই পারে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় এই হার অনেক কমেছে।

উখিয়া থানার ওসি আহমেদ মঞ্জুর মোরশেদ বলেন, গত ৫-৬ মাসে কোনো মানবপাচারের খবর পাইনি আমরা। আমরাও চেষ্টা করছি এই ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে। টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. হাফিজুর রহমান বলেন, এই এলাকায় মানবপাচার চক্রটি সবসময়ই সক্রিয়। তবে আমরা তা রুখে দিয়েছি। কিন্তু ওরা সুযোগের অভাবে বসে থাকে। বিশেষ করে রোহিঙ্গারা নানান অপরাধে জড়িয়ে যায়। তারা এই কাজটি করে বেশি। কিন্তু সকল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে আমরাও করছি। এই ধরনের খবর পেলে বা সন্দেহ হলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিচ্ছি।
কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান বলেন, এখানে নিয়মিত মামলা রুজু হয়। আমরা কমিউনিটি ও বিট পুলিশিং করে থাকি। কারা এসব পাচারের সঙ্গে জড়িত তাদেরকে আমরা আইনের আওতায় নিয়ে আসি। শুধু তাই নয় কেউ যদি জামিনে বের হয়ে আসে তার পরেও আমরা তাদের নজরদারি করে থাকি। তবে এই ক্ষেত্রে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে।

অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন  কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ সামসুদ্দৌজা নয়নের কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে নিয়মিত কথা বলি, মিটিং করি কীভাবে সেটা কমানো যায়। তাছাড়া তাদেরকে নিয়ে জনসেচতনতামূলক অনেক কাজ করে থাকি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status