প্রথম পাতা

ঐকমত্য গড়তে সম্মিলিত উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান প্রেসিডেন্টের

সংসদ রিপোর্টার

১৯ জানুয়ারি ২০২১, মঙ্গলবার, ৯:৪২ অপরাহ্ন

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ গড়ে তুলতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রেখে দেশ থেকে দুর্নীতি, মাদক, সন্ত্রাস ও জঙ্গিদের নির্মূলের লক্ষ্যে দল-মতের পার্থক্য ভুলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ। তিনি শান্তি, গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির যে পথে আমরা হাঁটছি, সে পথেই আমাদেরকে আরও এগিয়ে যেতে হবে। তাই আসুন, দল-মত-পথের পার্থক্য ভুলে গিয়ে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আমরা লাখো শহীদের রক্তের ঋণ পরিশোধ করি।
স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে গতকাল নতুন বছরের একাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম বছরের একাদশ অধিবেশনের প্রথম দিনে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি আরো বলেন, শত প্রতিকূলতার মধ্যেও সুশাসন সুসংহতকরণ, গণতন্ত্র চর্চা ও উন্নয়ন কর্মসূচিতে সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সরকার নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা আজ স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে। এ বছর মধ্যম-আয়ের দেশ হিসেবে আমরা ‘স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী’ পালন করবো। তবে, আমাদের লক্ষ্য ২০৪১ সালে বিশ্বসভায় একটি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশের মর্যাদায় অভিষিক্ত হওয়া। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জনগণের সর্বাত্মক অংশগ্রহণের মাধ্যমে আমরা একটি কল্যাণমূলক, উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে সক্ষম হবো।
গণতন্ত্রায়ন, সুশাসন ও নিরবচ্ছিন্ন আর্থসামাজিক উন্নয়নে সকল রাজনৈতিক দল, শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে ঐকমত্য গড়ে তোলার সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করার উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে প্রেসিডেন্ট বলেন, জাতীয় সংসদ দেশের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রবিন্দু। স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, পরমতসহিষ্ণুতা, মানবাধিকার ও আইনের শাসন সুসংহতকরণ এবং জাতির অগ্রযাত্রায় সরকারি দলের পাশাপাশি বিরোধী দলকেও গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রেসিডেন্ট সরকারি দল ও বিরোধী দল নির্বিশেষে মহান জাতীয় সংসদে যথাযথ ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ‘মুজিববর্ষ’ পালনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রেসিডেন্ট বলেন, বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু অভিন্ন সত্ত্বা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক কিংবদন্তি। আপসহীন নেতৃত্ব দৃঢ় মনোবল আর ত্যাগের মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের প্রধান নেতা। প্রতিটি বাঙালির কাছে তিনি পৌঁছে দিয়েছেন মুক্তির মূলমন্ত্র।
বিকাল সাড়ে ৪টায় স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অধিবেশন শুরু হয়। সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকার ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন। অধিবেশন শুরুর পর শোক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। প্রতিবার বছরের শুরু অধিবেশনের প্রথম দিন বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গকে সংসদে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তবে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে এবার তা হয়নি।
১৪৭ পৃষ্ঠার ভাষণের সংক্ষিপ্তসারে প্রেসিডেন্ট দেশের অর্থনীতি, বাণিজ্য-বিনিয়োগ, খাদ্য-কৃষি, পরিবেশ-জলবায়ু, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, করোনা মহামারি মোকাবিলাসহ বিভিন্ন খাতে সরকারের কার্যক্রম ও সাফল্য তুলে ধরেন। এছাড়া দেশে আইনের শাসন সুসংহত ও সমুন্নত রাখা এবং সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে সরকারের কার্যক্রমের প্রশংসা করেন।
কোনো সংসদের প্রথম এবং নতুন বছরের প্রথম অধিবেশনে প্রেসিডেন্টের ভাষণ দেয়ার বিধান রয়েছে। পরে প্রেসিডেন্টের ভাষণের ওপর ধন্যবাদ প্রস্তাব আনা হয়। পুরো অধিবেশনজুড়ে ওই প্রস্তাবের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নেন সরকার ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা। সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শেষ বক্তব্যের পর আলোচনা শেষে প্রেসিডেন্টকে ধন্যবাদ জানিয়ে সংসদে একটি প্রস্তাব গৃহীত হবে।
প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ তার ভাষণে বলেন, দেশে আইনের শাসন সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারসহ চাঞ্চল্যকর অন্যান্য মামলার রায় দ্রুত প্রদান করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনকে আরো শক্তিশালীকরণের পাশাপাশি জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও তথ্য কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। দুর্নীতি, মাদক, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও উগ্রবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হচ্ছে এবং জনজীবনে স্বস্তি বিরাজ করছে।
তিনি বলেন, বৈশ্বিক মহামারি করোনার প্রভাবে গোটা বিশ্বের ন্যায় আমাদের অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা-বাণিজ্য, কর্মসংস্থান, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পসহ অর্থনীতির সকল সেক্টরে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩১ দফা নির্দেশনাসহ ভার্চ্যুয়াল কনফারেন্সের মাধ্যমে নানামুখী দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন। সামাজিক সুরক্ষা ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার সংবলিত এক লাখ ২১ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকার ২১টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রদান অব্যাহত রাখায় প্রায় ৫০ লাখ শ্রমিক-কর্মচারীর চাকরি সুরক্ষা হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট তার ভাষণে বলেন, বিশ্ব শান্তি, গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নির্মূল, নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকার স্বীকৃতিস্বরূপ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীকে প্রদত্ত আন্তর্জাতিক পুরস্কার এবং সম্মাননাসহ সমগ্র বিশ্বে বাংলাদেশের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও দূরদর্শী দর্শন-চিন্তায় আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ সম্মাননা অর্জন সম্ভব হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট বলেন, বাঙালি জাতির জীবনে শ্রেষ্ঠ গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল বীরমুক্তিযোদ্ধা এবং মৃত বীরমুক্তিযোদ্ধাদের ওয়ারিশদের পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংবলিত একটি ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম প্রস্তুত করা হয়েছে। এর ফলে সরাসরি বীরমুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাংক হিসাবে সম্মানী ভাতা প্রদান সহজতর হয়েছে। তিনি বলেন, মুজিববর্ষের উপহার হিসেবে ১৪ হাজার গৃহনির্মাণ করে বিনামূল্যে অসচ্ছল বীরমুক্তিযোদ্ধাদের প্রদান করার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথগ্রহণ স্থানকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ‘মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিকেন্দ্র স্থাপন’- এর নির্মাণকাজ শুরু হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন শীর্ষক প্রকল্প এবং মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্যানোরমা নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে।
জনগণ শিগগিরই করোনা টিকা পাবেন: সরকার খুব শিগগিরই দেশের জনগণকে কোভিড-১৯ টিকা প্রদান করতে পারবে উল্লেখ করে প্রেসিডেন্ট বলেন, কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলায় বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড এবং ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট অব লাইফ সায়েন্সেস প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে ৩ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন সরাসরি ক্রয়ের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় সিএমএসডি’র মাধ্যমে জরুরিভিত্তিতে ভ্যাকসিন ক্রয় বাবদ ৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে প্রদান করা হয়। আমি আশা করছি সরকার খুব শিগগিরই দেশের জনগণকে কোভিড-১৯ এর টিকা প্রদান করতে পারবে।
দুর্নীতি-সন্ত্রাস-মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স: দুর্নীতি-মাদক ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির কথা উল্লেখ করে প্রেসিডেন্ট তার ভাষণে বলেন, এ লক্ষ্যে ১৮টি সংশ্লিষ্ট আইন প্রণয়ন ও সময়োপযোগী করা হয়েছে। পুলিশ, এম্বুলেন্স ও ফায়ার সার্ভিসের সহায়তা পাওয়ার জন্য জাতীয় জরুরি সেবা ‘৯৯৯’ সেবাসহ অনলাইন জিডি, মহিলা, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সব থানায় পৃথক ব্যবস্থা এবং বিভিন্ন অ্যাপসের মাধ্যমে পুলিশের সেবা প্রদানের মান উন্নয়ন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার পলাতক ও আত্মগোপনকারী আসামি ক্যাপ্টেন মাজেদকে গ্রেপ্তার করে মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকর করা হয়েছে। বিজিবি ও বিএসএফের যৌথ প্রচেষ্টায় যশোরের ৮ দশমিক ৩ কিলোমিটার সীমান্ত ‘ক্রাইম ফ্রি জোন’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। মাদকের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়নে ডোপ টেস্ট কার্যকর করা হয়েছে। পাসপোর্টের আন্তর্জাতিক মানোন্নয়নে ই-পাসপোর্ট চালু করা হয়েছে।
তিনি বলেন, দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষায় ফোর্সেস গোল-২০৩০ এর আলোকে ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিভিন্ন কোরের ১৭টি ইউনিট গঠন করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য উল্লেখযোগ্য সংখ্যক যানবাহন ও আধুনিক সরঞ্জাম সংযোজিত হয়েছে। দু’টি সাবমেরিন সংযোজনের মাধ্যমে বাংলাদেশ নৌবাহিনী আজ ত্রিমাত্রিক নৌবাহিনী হিসেবে বিশ্বে আত্মপ্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে ২০২০ সালের ৩১শে আগস্ট প্রথম স্থান পুনরুদ্ধার করেছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status