প্রথম পাতা

আয়েশার অন্যরকম লড়াই

মরিয়ম চম্পা

১৭ জানুয়ারি ২০২১, রবিবার, ৯:৪৬ অপরাহ্ন

দিনাজপুরের ফুলবাড়ীর মেয়ে আয়েশা সিদ্দিকার লড়াইটা শুরু ২০১২ সাল থেকে। ফুলবাড়ীর দারুল সুন্নাহ সিনিয়র সিদ্দিকিয়া মাদ্রাসা থেকে ফাজিল পাস করা ৩৯ বছর বয়সী আয়েশা বর্তমানে পেশায় একজন হোমিও চিকিৎসক। তার স্বামী ডা. সোলায়মান হোসেনও একই পেশায়। আয়েশা সিদ্দিকা দেশের প্রথম নারী কাজী হওয়ার চেষ্টায় একের পর এক বাধা আসলেও একদিন সফল হবেন- এমন আশায় আছেন। মানবজমিনের সঙ্গে বিস্তারিত আলাপে বলেন, নিকাহ রেজিস্ট্রার হিসেবে সারা দেশে পুরুষরা কাজ করছেন। নারীরা তো কোথাও নেই। কিন্তু দেশের সব সেক্টরে নারীর উপস্থিতি রয়েছে। ২০১২ সালের ১লা এপ্রিল যখন এ সংক্রান্ত একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হলো তখন আমার মামাতো ভাই বিজ্ঞপ্তিটার একটা কপি নিয়ে আসে। আমাকে দেখায় ‘নিকাহ রেজিস্ট্রার নেয়া হবে’। আমি দিনাজপুরের যে এলাকায় অবস্থান করছি সেখানেই নেয়া হবে।
বিজ্ঞপ্তিতে নারী এবং পুরুষ উল্লেখ ছিল না। তারা শর্ত দিয়েছিল প্রার্থীকে কোনো মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড থেকে আলিম পাস হতে হবে। সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দা হতে হবে। শর্তানুযায়ী সকল যোগ্যতাই আমার আছে। এটা দেখে আমার আগ্রহ হলো যেহেতু এই পেশায় নারীরা নেই। আসেনি এখনো। এবং নারী- পুরুষ উল্লেখও নেই। আমি যদি যেতে পারি তাহলে আমার পরে আরো অনেকেই সুযোগ পাবে। মাদ্রাসা পড়ুয়া নারীরা অনেক অবহেলিত। তারা শিক্ষকতা পেশা ছাড়া অন্য কোনো পেশায় সাধারণত নেই। আর শিক্ষকতা পেশায় কজনইবা থাকে। এক্ষেত্রে আমি যদি হতে পারি তাহলে আমার পরে আরো অনেক নারীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। নারীরা তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। এই কারণে আমার আগ্রহটা জাগে এবং আবেদন করি। আবেদন করার পর পাঁচ সদস্যের উপদেষ্টা কমিটি নিয়ে তারা প্যানেল প্রস্তুত করেন। এক স্মারকে চাওয়া হয়েছিল দুই এলাকায় দু’জন রেজিস্ট্রার। আমার প্যানেলে আমরা তিনজনই নারী ছিলাম। এই প্যানেলে পাঁচ সদস্যই স্বাক্ষর করেছেন। আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, পরবর্তীতে এটা পাঠানো হয় আইন মন্ত্রণালয়ে। ওখান থেকেই নিয়োগ দেয়া হয়। ২০১৪ সালে ওখানে যাওয়ার পর যোগাযোগ করলে তারা জানায়, দেশে যেহেতু নারী নিকাহ রেজিস্ট্রার বা কাজী নেই তাই আমাদেরকে এ বিষয়ে একটু আলোচনা করতে হবে।
তারপর আমরা সিদ্ধান্ত নেবো। পরবর্তীতে আলোচনা করে ফাইলে নোট সংযুক্ত করে পাঠায়। এরপর দীর্ঘ দুই থেকে তিন মাস পর আমাকে চিঠি দিয়ে জানানো হলো নারী হওয়ায় আমি নিকাহ রেজিস্ট্রার হতে পারবো না। নারীদের পুরো প্যানেলটিই বাতিল করে দিয়েছে। পৌরসভার ১, ২ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ডের নিকাহ রেজিস্ট্রারের লাইসেন্সের জন্য যে পুরুষ প্রার্থী আবেদন করেন তাকে ওই প্যানেল থেকে নিয়োগ দেয়া হয়। বাতিলের কারণ ইতিমধ্যে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, নারীরা রাতের অন্ধকারে নিকাহ রেজিস্ট্রি করতে যেতে পারবেন না। যেহেতু বিবাহ অনুষ্ঠানটি রাতে হয়। এবং নারীদের পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে শরিয়া আইন অনুযায়ী রেজিস্ট্রি করাতে পারবেন না। কিন্তু আমি তো বিয়ে পড়ানোর জন্য নয়, বিবাহ রেজিস্ট্রি করানোর জন্য আবেদন করেছি। তাহলে এখানে বিয়ে পড়ানোর প্রসঙ্গটা আসছে কেনো? তিনি বলেন, নিকাহ রেজিস্ট্রারের বালাম বইতে উল্লেখ আছে নিকাহ রেজিস্ট্রার এবং বিবাহ পড়ানো দুটোই আলাদা পেশা এবং ব্যক্তি। যেহেতু সকল কিছু আলাদাভাবে উল্লেখ আছে তাই আমি রেজিস্ট্রার হতে চেয়েছি। যখন দেখলাম তারা আমাকে আইনের ভাষায় বাতিল করেনি। যে ভাষায় বাতিল করা হয়েছে তাতে মনে হয়নি এটা বাতিলের ভাষা হতে পারে। একারণে আমি পরবর্তীতে উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করি। এবং আমার রিটটি পিটিশন হয়েও যায়। দীর্ঘ পাঁচ থেকে ছয় বছর লড়াই করলাম উচ্চ আদালতে। এরপর আমাকে গত বছর ২৬শে ফেব্রুয়ারি জানানো হয় আমার রিটটি খারিজ করে দেয়া হয়েছে। তখন খুব খারাপ লেগেছে। মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি। এভাবে তো বাতিল হয় না। কিন্তু এখানেও উল্লেখ নেই নারী বা পুরুষের বিষয়টি।
আয়েশা বলেন, ২০০৯ সালে আইন মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা বিধিমালায় কোথাও বলা হয়নি যে, কেবল পুরুষই নিকাহ রেজিস্ট্রার হতে পারবেন। সেখানে যেসব যোগ্যতার কথা বলা হয়েছে, তার সবগুলোই আমার আছে। তাছাড়া বাংলাদেশের সংবিধানে নারী ও পুরুষকে সমান অধিকার দেয়া হয়েছে।
এটা জানার পরে আমি আবার আপিল ডিভিশনে আবেদন করি। চলতি বছরের ৯ই জানুয়ারি পুনরায় রায়টি প্রকাশ পেলো। যেটা ইতিমধ্যে সকলেই জেনেছে। তিনি বলেন, যতদিন পর্যন্ত না আমি সঠিক রায় পাবো ততদিন লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছি। এবং যাবো। এতদিন আমি একাই লড়াই করেছি। এখন আমার সঙ্গে দেশের অনেকে চলে এসেছেন। সমর্থন করছেন। এবং গণমাধ্যমও রয়েছে বলে আশা করছি। আয়েশা বলেন, শুরু থেকেই আমার স্বামী এবং তিন ছেলেমেয়ে পাশে ছিল। এবং এখনো আছে। পরিবারের সকলেই আমার পাশে আছেন। বড় মেয়ে হোমিও মেডিকেলের শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, আমার বাবাও একজন হোমিও চিকিৎসক ছিলেন। তাই ছোট বয়স থেকেই বাবার চিকিৎসার সহযোগী হিসেবে কাজ করেছি। এবং পাশাপাশি ছিলাম। আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই পেশাগতভাবে হোমিও চিকিৎসক। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত আমার কাছের মানুষদের কাছ থেকে এ বিষয়ে কোনো নেতিবাচক আচরণ পাইনি। কিন্তু পেছনে তো অনেকে থাকবে সমালোচনা করার জন্য। কারো কথায় আমি কান দেইনি। কারণ, আমি তো এ বিষয়ে নিকাহ রেজিস্ট্রারের গেজেটটি বিস্তারিত পড়েছি। জেনেছি। এখনো আমার বিশ্বাস আছে যেহেতু উচ্চ আদালতে গিয়েছি তাই আদালত আমার রায়টি পুনর্বিবেচনা করে দেখবেন। আশা করে আছি লড়াইয়ে জিতবো আমি। এ সময় নারীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সংসদের স্পিকার সর্বত্রই যেহেতু নারী আছে। সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী, রেলওয়েতে আছে। শুধু নিকাহ রেজিস্ট্রারে নেই। এবং এই নিকাহ রেজিস্ট্রারে যদি নারী আসে তাহলে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে। এ কাজে তাকে আইনি সহায়তা দিচ্ছেন ফাউন্ডেশন ফর ল’ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের চেয়ারম্যান এডভোকেট ফাওজিয়া করিম। আয়েশা বলেন, আমার লড়াইটা মূলত একারণেই। ভবিষ্যতে আরো অনেক নারী এই পেশায় যোগ দেবেন- এমনটিই প্রত্যাশা।        
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status