শেষের পাতা

দুই কিশোর-কিশোরী এই ধরনের বিকৃতির সঙ্গে যুক্ত হলো কি করে?

ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা

১২ জানুয়ারি ২০২১, মঙ্গলবার, ১০:০৩ অপরাহ্ন

ঘটনাটি ভয়ঙ্কর। রক্তক্ষরণে, স্রেফ রক্তক্ষরণে মারা গেছে মেয়েটি। বলছি, রাজধানীর ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল মাস্টারমাইন্ডের ‘ও’ লেভেল পর্যায়ের শিক্ষার্থী আনুশকা নূর আমিনের কথা। মামলার একমাত্র আসামিও আর এক ইংরেজি মাধ্যম ম্যাপললিফের ছাত্র। দু’জনের কারোরই কৈশোর পেরোয়নি। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট বলছে, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা গেছে  মেয়েটি। দুইভাবে হয়েছে এই রক্তক্ষরণ- ‘ভ্যাজাইনাল’ এবং ‘রেক্টাল’। ময়নাতদন্তকারী ডাক্তার বলছেন বিকৃত যৌনাচারের ফলে ঘটেছে এই মৃত্যু। ঘটনাটি বীভৎস এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ১৬/১৭ বছরের দুই কিশোর-কিশোরী এই ধরনের বিকৃতির সঙ্গে যুক্ত হলো কি করে?
ঘটনাটি পড়ে অনেকক্ষণ বসেছিলাম স্তব্ধ হয়ে। মনে পড়ছিল আমাদের  শৈশব-কৈশোরের কথা। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় শেষে কর্মক্ষেত্র শুরুর একটা সময় পর্যন্ত কাছের বা দূরের যেকোনো যাত্রা পথে মা কিংবা বাবা থাকতেন আমার সঙ্গে। দুইজনই কর্মজীবী ছিলেন কিন্তু নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়াটা এত চমৎকার ছিল যে, একমাত্র সন্তানকে বাসায় কোনোদিন গৃহকর্মীর কাছে একা থাকতে হয়নি। আমার মা ছিলেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা  অধিদপ্তরের প্রথম মহিলা মহাপরিচালক, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট, সিনেট, একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য এবং ডিন (শিক্ষা অনুষদ)। বাবা ছিলেন পুরোদস্তুর রাজনীতিবিদ। এত কথা লিখছি শুধু এটুকু বোঝানোর জন্য যে অতি, অতি ব্যস্ত মানুষ ছিলেন তারা দুজনই। কিন্তু সন্তানের ব্যাপারে ছিলেন পাহাড়ের মতো অটল। কোনো দিন একটা ঘণ্টাও বাড়িতে একা থাকতে হয়নি আমাকে। হোক না সেই গৃহকর্মী ১০/১৫ বছরের পুরনো। মনে পড়ে না ছাত্রাবস্থায়  কোনো দিন নিজের গাড়িতে শুধুমাত্র ড্রাইভার দিয়ে পাঠানো হয়েছে আমাকে। আমি যেই সময়ের কথা বলছি, যে পরিবারে আমি বেড়ে উঠেছি, সেখানে কাজের লোক বা ড্রাইভার ছিল পরিবারের সদস্যের মতো। তাদের কেউ কেউ আমার জন্মের আগে থেকে আছে আমার পরিবারের সঙ্গে, পরিবারের সদস্য হয়ে। কিন্তু তারপরও বাবা-মা  কোনো দিন সাহস করেননি তাদের হাতে আমাকে একা ছাড়ার।     
মিশনারি স্কুলের ছাত্রী ছিলাম আমি। বন্ধু বলতে হাতেগোনা ৫/৬ জন,  সেই যে বন্ধুত্বের সূচনা হয়েছিল  শৈশবের শুরুতে; সেই বন্ধুত্ব আজও অটল। এখনো বন্ধু বলতে তারাই। স্কুলে যে বন্ধুত্বের শুরু তা কিন্তু  কেবল দু’জন শিশুর বন্ধুত্বে আটকা পড়েনি। পরিবারগুলোর মধ্যেও ছিল পারিবারিক বন্ধুত্ব। বন্ধুর বাসায়  ‘ডে-স্পেন্ড’ ছিল আমাদের রেগুলার রুটিন। কিন্তু দিয়ে আসতেন বাবা, নিয়ে আসতেন মা। কোনো দিন একলা ছেড়েছে তা কল্পনাও করতে পারি না। কদাচিৎ কারও বাবা-মা না পারলে যে বাসায় দাওয়াত সেই আন্টি-আঙ্কেল ঠিক দায়িত্ব নিয়ে নিজ সন্তানের মতো পৌঁছে দিতেন আমাদের। আমার বাবার মজার একটা অভ্যাস ছিল। কোনো কোনো ‘ডে-স্পেন্ড’-এর শেষে বন্ধুদের তাদের বাড়ি পৌঁছে দেয়ার সময় আইসক্রিম খাওয়াতে নিয়ে যেতেন সবাইকে। সে ছিল আরেক রাউন্ড আনন্দ। কিন্তু কি সহজ, নির্মল আর পবিত্র।
গ্রুপ স্টাডি বস্তুটার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে।  সেটাও ৫/৬ জন মিলে একটা গ্রুপ, হয় ক্লাসের আগে আর না হলে ক্লাস  শেষে ক্লাশে বসে একসঙ্গে পড়া। আমাদের অনেক বন্ধুই তখন প্রেম করে। কিন্তু সেটাও একটা গণ্ডির মধ্যেই, পারস্পরিক সীমারেখা  মেনে।
আমি জানি এই লেখা কাউকে বিস্মিত করবে, কেউ ভ্রূকুঁচকে ভাববে কী বন্দিদশায় বড় হয়েছি আমরা। কেউ এটাও ভাবতে পারেন বাড়িয়ে বলছি আমি। মধ্যবিত্তের এখন বিত্তটুকু ছাড়া বাকি আর কিছু  নেই, কিন্তু সেই সময়ে আমরা যারা ঢাকায় এলিট একটা স্কুলে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম তারা কিন্তু প্রায় একই ধরনের পরিবার থেকে এসেছিলাম। বিত্তটা মধ্যম মানের ছিল কিন্তু সঙ্গে ছিল কয়েক প্রজন্মের শিক্ষা, মূল্যবোধ, পারিবারিক বন্ধন, ধর্মীয় ও নৈতিকতা বোধ। ধর্ম আর  নৈতিকতার চর্চাটা জীবনে ছিল,  দেখানেপনায় নয়। মোটা দাগে একই ধরনের আচরণ সব বন্ধুর পরিবারেই  দেখেছি।
গভীর নিরাপত্তা বোধ নিয়ে বড় হয়েছি, নিজেকে বন্দি মনে হয়নি কখনোই। আনন্দের তো কোনো কমতি ছিল না শৈশবে। এখনো জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ভাবতে বসলে  তো কেবল শৈশবের আর কৈশোরের স্মৃতিই মনে পড়ে। আমাদের শৈশব আর কৈশোরে ফ্ল্যাট বাড়ির সূচনা হয়নি। ফ্ল্যাটের একজনের ঘাড়ের উপর আর একজনের নিঃশ্বাস ফেলার বদলে বড় বাগানঘেরা একতলা বা বড়জোর দোতলা বাড়িতে বড় হয়েছি সবাই। তার একটা ছাপও হয়তো ছিল আমাদের বেড়ে ওঠার উপর। আভিজাত্যে,  চিন্তা আর মনের প্রসারতায়। ধানমণ্ডিতেই বাসা ছিল আমার প্রায় সব বন্ধুর, তাই  দূরত্বও ছিল না তেমন একটা। তবে তাই বলে যে চাইলেই রওনা হতে পারতাম তেমন নয়। দুই বাড়ির অভিভাবকের সম্মতিতে, উপস্থিতিতেই কেবল মাত্র যেতে পারতাম আমরা।
সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়তে যাই তখন আমার মা আমার জন্য যে হলে থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন সেটি ছিল অতি এক্সক্লুসিভ ‘মুসলিম, গার্লস, নন স্মকিং’ হোস্টেল। এর জন্য বাড়তি অর্থ মাকে গুনতে হয়েছে, বাড়তি ঝক্কি পোহাতে হয়েছে। আমি যখন ব্যারিস্টারি করছি তখনও কেবল মাত্র নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই আমাকে লিঙ্কন্সইন  থেকে ৫ মিনিটের হাঁটা দূরত্বে কয়েক গুণ বেশি খরচ করে হোস্টেলে রাখেন। আমার মা নিজেও ষাটের দশকে যুক্তরাষ্ট্রের টপ রেঙ্কিং বিশ্ববিদ্যালয় শিকাগোর ছাত্রী ছিলেন। সুতরাং বিদেশের স্টুডেন্ট লাইফ সম্পর্কে খুব ভালো ধারণা ছিল তার। তারা তাদের সাধ্যের বাইরে গিয়ে হলেও সর্বোচ্চটা সন্তানের জন্য নিশ্চিতের চেষ্টা করেছেন। তবে  হ্যাঁ, তারপরও হয়তো বাবা-মাবিহীন প্রথম স্বাধীন জীবন আমি আমার মতো ‘উপভোগ (!)’ করতেই পারতাম। কিন্তু ওই যে আজন্ম লালিত মূল্যবোধ, সেটি আমাকে  হোস্টেল, ক্লাস আর ইনের বাধ্যতামূলক ডিনারের বাইরে কিছু করতে দেয়নি। আশৈশব বাবা-মা আমাকে বিশ্বাস করেছেন আর শিখিয়েছেন কি করে বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে হয়।  
একজন সন্তান কেমন হবে, কী করবে, কীভাবে চলবে, তার চিন্তাধারা কেমন হবে, জীবনকে সে কীভাবে দেখবে, কীভাবে যাপন করবে তার বীজ বপন হয় অতি  শৈশবেই, বাবা-মায়ের হাত ধরেই। জীবনযাপন একটা পদ্ধতি যেটা শিশু  দেখে শেখে, বড় বড় লেকচার শুনে নয়। আমরা হয়তো ভাবি শিশু সন্তান কিইবা বোঝে। বলে রাখি তারা কিন্তু আপনার আমার চেয়ে কম বোঝে না। যে পিতার আয় হাজারের অঙ্কে আর ব্যয় লাখের ঘরে সে পরিবারের সন্তান খুব ভালো বোঝে শুভঙ্করের ফাঁকিটা। যে উদাসীন, আত্মমগ্ন বাবা-মা’র সময় হয় না সন্তানকে সময় দেয়ার, সে কোথায় যায়, কার সঙ্গে মেশে, তার বন্ধুবান্ধব কারা  সেই খবর রাখবার সেই সন্তানের চিন্তা, আচরণ আর কাজের দায়ভার কি কেবল সেই সন্তানের? একজন মানুষের চিন্তা, কর্ম, আচরণ একদিনে  তৈরি হয় না। পরিবারের গভীর ছাপ থাকেই সেখানে।
আমার মধ্যবিত্ত বাবা-মায়ের অনেক  বেশি সামর্থ্য, সাধ্য ছিল না, কিন্তু  যতটুকুই ছিল, আমি খুব ভালোভাবেই জানি, ততটুকু এই শহরের বহু পরিবারের নেই। চাইলেও সবাই সবকিছু করতে পারবেন না, বুঝি সেটাও। আমার জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়ের একটা জার্নির যে কথাগুলো বলেছি  সেই কথাগুলোর একটা প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে তখনকার বাবা-মায়েরা সন্তানদের প্রতি কতোটা মনোযোগী ছিলেন।
নিশ্চিতভাবেই এই শহরের অসংখ্য পরিবারকে প্রতিদিন কঠিন জীবনযুদ্ধে নামতে হয়। সেই যুদ্ধই হয়তো তাদেরকে সন্তানের প্রতি অনেক  ক্ষেত্রেই অমনোযোগী করে তোলে। কিন্তু তাদের মনে রাখা উচিত যে সন্তানদের তারা পৃথিবীতে নিয়ে আসেন সেই সন্তানকে যথেষ্ট পরিমাণ  কেয়ার দিয়ে করে তোলা তাদের অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব তাদের বাবা-মা হওয়ার দিনটি  থেকেই শুরু হয়ে যায়।
এই দেশে একটা সুস্থ মুক্তবাজার অর্থনীতিও নেই বহুবছর, আছে স্রেফ চুরির অর্থনীতি, লুটপাটতন্ত্র। শুধুমাত্র টাকা থাকলেই এই সমাজে যে কেউ এখন একধরনের সম্মান পায়; টাকার উৎস নিয়ে এই সমাজে আর মাথা ঘামায় না তেমন কেউ। তাই এখনকার অসংখ্য বাবা-মা বৈধ বা অবৈধ, যেকোনো পথেই হোক টাকার পেছনে ছুটছেন। ভুলে যান তারা সন্তানদের কোয়ালিটি টাইম  দেয়ার কথা, অবহেলা করেন তাদের প্রতি কর্তব্যকেও।
কলাবাগানের মতো, এমনকি তার চাইতে আরো ভয়ঙ্কর সব ঘটনা ছড়িয়ে পড়া আমি দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছি আমাদের সমাজে।
লেখক: সংসদ সদস্য, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status