অনলাইন

স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরামের ওয়েবিনার

দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে প্রবাসীদের উদ্বেগ, করোনায় মৃত্যুহার নিয়ে সন্দেহ

তারিক চয়ন

১০ জানুয়ারি ২০২১, রবিবার, ৬:৪৮ অপরাহ্ন

করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারে দায়িত্বশীলদের রাজনৈতিক অঙ্গীকার খুব গুরুত্বপূর্ণ। করোনা মহামারিতে দেশের স্বাস্থ্যখাতের নাজুকতা বেরিয়ে এসেছে। দেশে যাদের স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি, তারাই সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হচ্ছেন। অন্যান্য খাতের মতো দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মধ্যে দুর্নীতি ঢুকে গেছে। দুর্নীতির অন্যতম একটি হচ্ছে রাজনীতিকরণ। চিকিৎসক নিয়োগ, পদোন্নতি সবকিছুই রাজনৈতিক বিবেচনায় হচ্ছে। নামকাওয়াস্তে মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ছড়িয়ে পড়ছে। করোনায় দেশে মৃত্যুহার যেটা বলা হচ্ছে সেটা ঠিক নয়। দিনে এনে দিনে খাওয়া মানুষেরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আজ রোববার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে আয়োজিত এক ওয়েবিনারে বক্তারা এসব মতামত দেন। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরাম নিয়মিতভাবে সাপ্তাহিক এই ওয়েবিনার আয়োজন করে আসছে।

এতে অতিথি হিসেবে আলোচনায় অংশ নেন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সিনিয়র সাংবাদিক রোকেয়া হায়দার, ইংল্যান্ড থেকে জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরের সাবেক পরিচালক ড. সেলিম জাহান এবং কানাডা থেকে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, ইউএনএফপিএ'র সাবেক টেকনিক্যাল স্পেশালিষ্ট ড. সুকান্ত সরকার। ওয়েবিনার সঞ্চালনা করেন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ড. জিয়াউদ্দিন হায়দার।

 

ড. সুকান্ত বলেন, স্বাস্থ্যখাতে বাংলাদেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে দেখে গর্ববোধ করি। কিন্তু সেগুলো রাতারাতি হয়ে যায় নি। বছরের পর বছর কাজ করতে করতে আজকের জায়গায় এসেছে। করোনাভাইরাসে উত্তর আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপে যুক্তরাজ্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পেছনে তাদের দুই সরকারপ্রধান ডনাল্ড ট্রাম্প এবং বরিস জনসনের বড় দায় রয়েছে। দুজনই করোনাকে অস্বীকার করেছিলেন। সবদেশেই সরকারে দায়িত্বশীলদের রাজনৈতিক অঙ্গীকার খুব গুরুত্বপূর্ণ। যে কোন পরিস্থিতিকে প্রকৃত দৃষ্টিতে দেখা, তাকে স্বীকার করে নেয়া এবং সে অনুযায়ী কাজ করা।

 

স্বাস্থ্যখাতের বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ প্রতিবেশী অনেক দেশের তুলনায় এগিয়ে রয়েছে উল্লেখ করে ড. সেলিম বলেন, করোনা মহামারীতে দেশের স্বাস্থ্যখাতের নাজুকতা বেরিয়ে এসেছে। বাংলাদেশে ত্রিধারার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা রয়েছে৷ একটি সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, দরিদ্র মানুষের জন্য। আরেকটি বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, মোটামুটি বিত্তবানদের জন্য। অন্যটি বিদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, যারা বিদেশ গিয়ে চিকিৎসা নেয়ার সক্ষমতা রাখেন তাদের জন্য। স্বাস্থ্য একটি মানবাধিকার। কিন্তু ত্রিধারার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা থাকায় সরকারি ক্ষেত্রে অর্থের সংকট যেমন রয়েছে, তেমনি অন্যান্য সুযোগ সুবিধার অভাবও রয়েছে। সুতরাং বলা যায় ত্রিধারার স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় অসমতা আছে। যার ফলে যাদের স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি, তারাই সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হচ্ছেন। বেসরকারি হাসপাতাল শুধু মুনাফাই আগে দেখছে, চিকিৎসকরাও কতো বেশি আয় করা যায় তা নিয়েই ভাবছেন, রোগীরাও ভাবছে- যেহেতু অর্থ খরচ করছি, আমাকে সুস্থ করে তুলতেই হবে। রোগী এবং চিকিৎসকের মধ্যে পারস্পরিক সম্মানের জায়গা নষ্ট হচ্ছে, হাসপাতাল ভাংচুরের ঘটনা ঘটছে।

 

দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মধ্যে দুর্নীতি ঢুকে গেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, দুর্নীতির অন্যতম একটি হচ্ছে রাজনীতিকরণ। চিকিৎসক নিয়োগ, পদোন্নতি সবকিছুই রাজনৈতিক বিবেচনায় হচ্ছে। নামকাওয়াস্তে মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ছড়িয়ে পড়ছে।

রোকেয়া হায়দারও অন্য দুই বক্তার সাথে একাত্ম হয়ে বলেন, যাদের অর্থকড়ি রয়েছে তারা চলে যান ভারত, থাইল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোতে। অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো করোনাকালেও দেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ 'নিয়তির উপর ভরসা করে' কাজ করে যাচ্ছেন।

অন্যান্য খাতের মতো স্বাস্থ্যখাতেও দুর্নীতি ছেয়ে গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, হাজারো শ্রমিক ভুয়া সার্টিফিকেটের কারণে বিদেশ যেতে পারে নি। এসব প্রবঞ্চনা করেছেন বিত্তবানরা। এরকম দুর্নীতি আর রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব থাকলে মানুষ এগিয়ে যেতে পারে না। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনেক বড় বড় প্রতিবেদন বের হলেও হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাবে মানুষ মারা গেছে। ঢাকায় বড় বড় হাসপাতাল, ক্লিনিক থাকলেও পর্যাপ্ত সরঞ্জাম নেই। সবমিলিয়ে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবই এসবের পেছনে মূলে কারণ সব মন্ত্রণালয় তারাই চালায়।

 ড. সুকান্ত নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানান বাংলাদেশে তার পরিচিত লোকজন খুব কম কিন্তু তাদের মধ্যে অনেকেই করোনায় মারা গেছেন। সুতরাং দেশে মৃত্যুহার যেটা বলা হচ্ছে সেটা ঠিক নয়। করোনার শুরুতেই সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে 'আমরা করোনা মোকাবেলায় প্রস্তুত' বলা হলেও বিদেশ থেকে আসা লোকদের কোয়ারেন্টিনের জায়গারও ঠিকঠাক ব্যবস্থা করা হয় নি।

করোনাকে আর্থ-সামাজিক সমস্যা উল্লেখ করে ড. সেলিম বলেন, যদিও দেশে এ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে না। করোনায় দিনে এনে দিনে খাওয়া মানুষেরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সবমিলিয়ে আরো ৩ কোটি ৬০ লক্ষ মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে চলে যাবে। তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষা তৃণমূল স্তরে সবাই পাচ্ছে না বলে ভবিষ্যতে দক্ষতা এবং আয়ের মধ্যে অসমতা দেখা দেবে। কৃষিকাজ ব্যাহত হওয়ায় খাদ্য নিরাপত্তা এবং ফলশ্রুতিতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে পুষ্টিহীনতা দেখা দেবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক সম্প্রতি রাষ্ট্রগুলোকে ভ্যাকসিনের ব্যাপারে দ্বিপাক্ষিক কোন বাণিজ্য চুক্তি না করতে আহবান জানিয়ে বলেছেন, ভ্যাকসিন নিয়ে যেনো বাণিজ্য না হয়। কিন্তু এ নিয়ে বাণিজ্য হবেই। পশ্চিমা দেশগুলোতে ভ্যাকসিনে অগ্রাধিকার নিয়ে নীতিমালা থাকলেও বাংলাদেশে এমপি-মন্ত্রীরা আগে পাবেন বলে শোনা যাচ্ছে। ভ্যাকসিনের সুবিধা পেতে হলেও এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

 

রোকেয়া হায়দার বলেন, শোনা গিয়েছিল কোন দেশ থেকে নিজেদের ট্রায়ালের পর বাংলাদেশে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন পাঠানো হবে। বাংলাদেশ নেবে কি নেবে না এই দ্বিধাদ্বন্দে থাকতে থাকতেই দেশটি অন্য দেশে ভ্যাকসিন পাঠিয়ে দেয়। বাংলাদেশ ভারতের সাথে চুক্তি করলেও ভারত নিজের জনগণকে আগে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেবে বলা জানিয়েছে।

 

করোনায় অনেকেই মারা যাচ্ছেন যারা হয়তো তাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। অনলাইনে শিক্ষার সুফল প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র শিক্ষার্থীরা নিতে পারছে না। করোনায় বাংলাদেশ উন্নত বিশ্বের অনেকে দেশের মতো ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও আত্মপ্রসাদ লাভ করে বসে থাকলে চলবে না। এখন থেকেই সবাইকে এসব মোকাব্রলায় এগিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যম বড় ভূমিকা পালন করতে পারে৷

 

সঞ্চালক ড. জিয়া আলোচক অতিথিদের কাছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরাম আয়োজিত ওয়েবিনারের বিষয়ে পরামর্শ আহবান করলে আলোচকরা এমন একটি জনগুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান আয়োজন করার জন্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরামকে ধন্যবাদ জানান। তারা বলেন, দেশে এবং দেশের বাইরে থেকে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষদের (শিক্ষক, স্বাস্থ্যকর্মী, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, গণমাধ্যমকর্মী, হাসপাতালের মালিক, ব্লগার ইত্যাদি) নিয়ে সাজানো এ অনুষ্ঠান নিয়মিতভাবে আয়োজন করা হলে দীর্ঘমেয়াদে তা বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখতে পারবে।

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status