শেষের পাতা

সংকটে শিক্ষা উত্তরণের উপায় কি?

পিয়াস সরকার

৫ ডিসেম্বর ২০২০, শনিবার, ৯:২০ অপরাহ্ন

দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী আলিয়া আক্তার। গত শুক্রবার সৌদি প্রবাসী আত্মীয়ের সঙ্গে বিয়ে হয়। ছেলে তার থেকে প্রায় ১৫ বছরের বড়। আলিয়ার বাড়ি নীলফামারীর ডোমার উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকায়। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বাবা বাধ্য হয়েই বিয়ে দেন মেয়ের। ছোট দোকানে চলতো সংসার। করোনার ধাক্কায় আর যেন সংসার চলছে না। বিনা পণে মেয়েকে বিদায় করাই যেন তার প্রধান লক্ষ্য। করোনার ধাক্কায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আর্থিক ধাক্কা। গ্রামাঞ্চলে বাড়ছে বাল্যবিবাহ কিছুটা বাধ্য হয়েই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন অভিভাবকরা। আর ছেলেরা জড়িয়ে যাচ্ছেন নানা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে। দেশের তিন জেলার প্রত্যন্ত এলাকার তিনজন চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নীরবেই হচ্ছে বিয়ে। আগে যেসব মেয়েদের মাধ্যমিকের পরে বিয়ে হতো এখন স্কুলের মেয়েদের বিয়ে হচ্ছে। এর প্রধান কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেন দারিদ্র্যকে।
সেভ দ্য চিলড্রেন শঙ্কা প্রকাশ করে জানায়, শুধু এ বছরই ৫ লাখ শিশু বাল্যবিবাহের শিকার হবে। ২০২৫ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহের শিকার হবে ২৫ লাখ মেয়ে। দেশের প্রত্যন্ত জেলা কুড়িগ্রামের হিসাব মতে, ২০১৭ থেকে ২০২০ সালের আগস্ট পর্যন্ত বাল্যবিবাহ হয়েছে ২ হাজার ৬০২টি। জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত হয়েছে ৩৩৯টি।
করোনায় ধাক্কায় থমকে আছে শিক্ষা। সংক্রমণ ঠেকাতে বন্ধ অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অচলাবস্থায় চলে এসেছে শিক্ষা কার্যক্রম। ১৭ই মার্চের পর কয়েক ধাপে বাড়িয়ে চলমান এই ছুটি করা হয়েছে ১৪ই ডিসেম্বর পর্যন্ত। বাতিল করা হয়েছে পিইসি, জেএসসি, এইচএসসি পরীক্ষা। পরীক্ষা ছাড়াই উপরের ক্লাসে উঠবেন প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা।
আবার স্কুলগুলো বন্ধ থাকায় শিশুদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং উন্নতির ওপর সুস্পষ্ট নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে উল্লেখ করে করোনা ভাইরাস মহামারির মধ্যেই বাংলাদেশের স্কুলগুলো পুনরায় চালু করার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে বলে পরামর্শ দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের (সিডিসি) কান্ট্রি ডিরেক্টর ডা. মাইকেল ফ্রিডম্যান। ইউএনবি’কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, রেস্তোরাঁর পরিবর্তে স্কুল খুলে দেয়া হোক।
এই বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আজিজুর রহমান বলেন, এই বয়সের বাচ্চাকে যদি এক থেকে দেড় ঘণ্টার বেশি ক্লাসে রাখা হয় এতে তার মানসিক বিকাশে বাধা পড়বে। করোনাকালে যখন বাচ্চারা দীর্ঘ সময় ঘরে বন্দি তখন তাদের মেজাজ এমনিতেই খারাপ অবস্থায় রয়েছে। একটা শিশু শুধু বাবা-মায়ের সঙ্গে বেশি সময় কাটাতে পারে না। তার সমবয়সী কারো প্রয়োজন। অথচ সেখানে দীর্ঘ সময় ক্লাস করতে হচ্ছে। এটা শিক্ষা হতে পারে না। আমরা এর মাধ্যমে শিশুর সৃজনশীলতা নষ্ট করে দিচ্ছি। তিনি এইসময় বিশেষ করে নগরের শিক্ষার্থীদের আনন্দমুখর পরিবেশে রাখার কথা বলেন। যাতে শিশুর মধ্যে কোনো একঘেয়েমি না চলে আসে।
করোনায় শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে মানিকগঞ্জ এস কে সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রেবেকা জাহান বলেন, করোনার ফলে শিক্ষার্থীরা প্রয়োগিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সরকার শিক্ষার্থীর কথা ভেবে যে পাঠ পরিকল্পনা দিয়েছে সেভাবে কিছুটা ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।
সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জগদীশচন্দ্র দেবনাথ বলেন, ক্লাসরুমে বসে ক্লাস করা আর অনলাইনে ক্লাসের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। গ্রামের অনেক ছেলেমেয়ের হাতে স্মার্টফোন নেই। তারা এগুলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তবুও অনলাইন ক্লাসটা জরুরি কারণ এছাড়া বিকল্প কিছু করা এই মুহূর্তে সম্ভব হচ্ছে না।
নাটোর জেলার শিক্ষা অফিসার মো. রমজান আলী আকন্দ বলেন, অনলাইনের ক্লাসগুলো কখনো কারিগরি শিক্ষার সম্পূরক বা সমকক্ষ হতে পারে না। এটা শুধুমাত্র একটা ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার সাময়িক পদক্ষেপ। শুধু আমাদের দেশেই না, দেশের বাইরেও শিক্ষার্থীরা সুশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কিন্তু পরবর্তীতে ক্লাসের সংখ্যা যদি বাড়িয়ে দেয়া যায় বা শিক্ষকরা এ ব্যাপারে আন্তরিক হন তাহলে অনেকটা ক্ষতি পুষিয়ে আনা সম্ভব।
এই বিষয়ে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. ছাদেকুল আরেফিন বলেন, এই মুহূর্তে আমাদের অনলাইনে যে শিক্ষা কার্যক্রম আছে তা বেগবান করতে হবে। স্মার্ট ডিভাইস থেকে শুরু করে নেটওয়ার্কের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। এই মুহূর্তে যেহেতু করোনার একটা অস্বাভাবিক সময় চলছে সেহেতু পুরোপুরি উত্তরণ সম্ভব নয়। তবে এই অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমকে চালিয়ে নিয়ে যদি পরীক্ষাগুলো আমরা নিতে পারি তবে কিছুটা হলেও উত্তরণ সম্ভব। আর স্বাভাবিক হওয়ার পর পরিসর বাড়িয়ে এগিয়ে যেতে হবে। স্বল্প সময়ে অধিক কার্যকরী পদ্ধতি কী হতে পারে তা নিয়ে এখনই ভাবতে হবে।
কবে খুলছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান? করোনার এই সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলবার পক্ষে একমত নন কর্তাব্যক্তিরা। যদিও শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছিলেন, সীমিত পরিসরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলবার পরিকল্পনা চলছে। এছাড়াও তিনি বলেছেন, মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের সংক্ষিপ্ত সিলেবাস তৈরি করে তিন মাসের একটি সেশন পরিচালনা করা হবে। তবে এরই মধ্যে চলছে দেশের কওমি মাদ্রাসাগুলো।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সহসাই খুলছে না হয়তো। কারণ জাতীয় করোনা বিষয়ক কিমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়, করোনা ভ্যাকসিন না আসা পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা কঠিন হবে। ওদিকে ১৮ বছরের ওপরের শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিন দেয়ার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কথাও বলা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখন খোলা যাবে কিনা এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা আমার থেকে ভালো বলতে পারবেন। তবে আমি বলবো, কিছু ক্ষতির সম্মুখীন হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এই মুহূর্তে বন্ধ রাখাই শ্রেয়। উন্নত বিশ্বেও দেখছি তারা খুলে দেয়ার পর আবার বন্ধ করে দিচ্ছেন। কারণ শিক্ষার্থীরা করোনা আক্রান্ত হওয়া মানে দেশের ভবিষ্যৎ আক্রান্ত হওয়া। বরং আমার মতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না খুলে আরো যেসব স্থানে উন্মুক্তভাবে চলছে সেসব স্থানে কড়াকড়ি আরোপ করা উচিত।
উত্তরণের উপায় নিয়ে তিনি বলেন, করোনার ধাক্কার পর যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলবে তখন নতুন করে শুরু করতে হবে। অনেক শিক্ষার্থী হয়ত আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসবে না। এখন শিক্ষকদের নিজস্ব উদ্ভাবনী চিন্তা নিয়ে আসতে হবে। কীভাবে তারা তাদের শিক্ষার্থীদের শিক্ষায় আগ্রহী করে তুলবেন। আগের প্রক্রিয়ায় শিক্ষা আর চলবে না। শারীরিক ক্লাসের পাশাপাশি অনলাইনে জোর দিতে হবে। আর শিক্ষার্থীদের কম সময় ক্লাসে রেখে কীভাবে অধিক ফলপ্রসূ শিক্ষা দেয়া যায় সে বিষয়ে ভাবতে হবে। পরিবর্তন আনতে হবে মূল্যায়ন পদ্ধতিতে।
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে. চৌধুরী বলেন, আমাদের কয়েকটি বিষয়ের ওপর জোর দিতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মানার সকল প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা আছে কিনা সে বিষয়ে খোঁজ রাখতে হবে এবং সেভাবে পরিকল্পনা করতে হবে। রাজধানীর প্রতিষ্ঠানের জন্য যেভাবে ভাববো গ্রামের প্রতিষ্ঠানের জন্য ভাবনাটা হবে ভিন্ন। সর্বত্র স্বাস্থ্যবিধি মানার উপকরণগুলো সমভাবে বিতরণ করতে হবে। শিক্ষার্থীরা যেহেতু দীর্ঘদিন লেখাপড়ার মধ্যে ছিল না তাই তাদের গতিতে ফেরাতে শিক্ষকদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। এজন্য শিক্ষকদের দিতে হবে বিপুল পরিমাণে প্রশিক্ষণ। আর শেষে রেডিও, টেলিভিশনের মাধ্যমে যে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচলনা করা হয়েছিল তাতে যারা যুক্ত হতে পারেনি। তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় যুক্ত করা যাতে ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে পারে।
সৈয়দ মঞ্জুরুল হক বলেন, এই মুহূর্তে আসলে আমাদের বিকল্প নেই। শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা যেসব সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তাতে শূন্য থেকে এক ভালো। শিক্ষার্থীদের কথা ভেবেচিন্তেই তারা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। সামনে আরো ভেবেচিন্তে তারা সিদ্ধান্ত নিবেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে এক বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। সেটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। এই করোনাকালীন ক্ষতিও কাটিয়ে উঠতে পারবো আশা করি।
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি সার্বিক বিষয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, কোভিড-১৯ সংক্রমণ বৈশ্বিক সংকট তৈরি করেছে। শিক্ষা খাতও এ সংকটের বাইরে নয়। তাই শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে একাধিক বিকল্প পরিকল্পনা তাদের ভাবনায় রয়েছে। সবকিছুই নির্ভর করবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কবে খুলে দেয়া সম্ভব হবে- তার ওপর। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা থেমে নেই। তিনি আরো বলেন, করোনা-সংকট শুধুই সমস্যা নয়, নতুন সম্ভাবনাও তৈরি করেছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা অনলাইন ক্লাসে দক্ষ হচ্ছেন। ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার শিক্ষায় বাড়ছে। সরকার এখন শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status