অনলাইন

মিমের মিশন বাংলা

নিজস্ব প্রতিনিধি, ঢাকা

২ ডিসেম্বর ২০২০, বুধবার, ৯:৫১ পূর্বাহ্ন

হায়দারাবাদি উত্তেজনা টু কলকাতা ভায়া বাংলাদেশ। বিজেপি এবং মিমের ভোট লড়াইটা আজ শেষ হলো না নিজামের ঐতিহাসিক হায়দারাবাদে। 'মিম' মানে পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের নতুন ক্রেজ আসাদুদ্দিন ওয়েইসির নেতৃত্বাধীন এআইএমআইএম বা মিম। তিনি নতুন নেতা। হায়দারাবাদে বিজেপির সঙ্গে ফাইটার। কলকাতায় ফাইটার। দিদি-দাদার বাইরে বিজেপি বধের দায়িত্ব তার ওপরে একদম কম নয়। আসাদ এরই মধ্যে শিখে গেছেন কিভাবে বিজেপিকে ঘায়েল করতে হয়।
তবে নতুন করে 'মিম' নিয়ে দলকে সতর্ক করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। কেন ওয়েসির দলকে ভয় পাচ্ছে তৃণমূল, ব্যাখ্যা করলেন তিনি। মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল-মুসলিমিন তথা মিম নিয়ে দলের কোর গ্রুপের বর্ধিত বৈঠক করেন তিনি সম্প্রতি। অনলাইন ভারতীয় মিডিয়া বলছে, কোচবিহারের কর্মীসভায় মিমকে ইঙ্গিত করে বললেন, 'ওরা বিজেপির কাছে টাকা নেয়। সংখ্যালঘুরা ভুল করবেন না। ওদের বাড়ি হায়দরাবাদে। এখানে নয়।'
ব্রিটিশ ভারতে হায়দরাবাদে জন্ম মিমের। ১৯২৭ সালে হায়দরাবাদের নিজাম ওসমান আলি খানের পৃষ্ঠপোষকতায় নওয়াজ খান কিলেদার এটা গড়ে তুলেছিলেন। নিজামের অনুগামী দল। হায়দরাবাদ আসন থেকে বহুবার লোকসভায় জিতেছেন মিম নেতারা। কিন্তু এখন দাক্ষিণাত্যের সীমানা পার করে মিম মহারাষ্ট্র, বিহারসহ বিভিন্ন রাজ্যে পাড়ি জমানোর চেষ্টায় নেমে পড়েছে।
এটা লক্ষনীয় যে, পশ্চিমবঙ্গের লাগোয়া বিহারের কিষাণগঞ্জ। বিধানসভার একটি উপনির্বাচনে সদ্য জিতেছে আসাদউদ্দিন ওয়েসির দল। সেদিনই দ্য ওয়াল-এ লেখা হয়েছিল, ' দিদির ললাটে ভাঁজ বাড়িয়ে বিহারে খাতা খুলে ফেলল মিম ।' এর দু'সপ্তাহের মধ্যেই মিমের পোস্টারে ছয়লাব কোচবিহার শহর। সেই পোস্টারে ছিল ওয়েসির বিরাটাকার ছবি।
আর নীচে লেখা ' ইনতেজার অব খতম, মিশন ওয়েস্ট বেঙ্গল!' বাংলায় তৃণমূলের অন্যতম মজবুত ভোট ব্যাঙ্কও তো সংখ্যালঘুরাই। অনেক পর্যবেক্ষকের ধারণা, এখন মিম যদি বলে, এরপর 'মিশন বাংলা', দিদির চিন্তা বাড়বে না?
হাওড়া, হুগলি, মুর্শিদাবাদ, দুই চব্বিশ পরগনায় ইতিমধ্যেই তলে তলে সংগঠন গোছানোর কাজ চলমান রেখেছে দক্ষিণ ভারতের এই সংখ্যালঘু দল। রংপুরের ওপারে কোচবিহারে হৈহৈ করে অভিযানে নেমেছে ওয়েসি বাহিনী। গত সপ্তাহে সে ব্যাপারেই নেতাকর্মীদের সতর্ক করে দেন মমতা।
এদিকে ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ পুনরায় ' বাংলাদেশী অনুপ্রবেশ' বাণ নিক্ষেপ করেছেন। হায়দরাবাদেও একই কার্ড চলেছে। অমিত বলেছিলেন, বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী এবং রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন করতে মিমের নেতা লিখিত দিন। আমি তাদের বিতাড়নে পদক্ষেপ কিভাবে নেই, সেটা সবাই দেখবেন।' মিম নেতাও কম যান না। রসিকতার সুরেই বলেছেন, ' ভারতের ইতিহাসে মি. অমিত প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, যিনি বেআইনিভাবে অবস্থানরত বিদেশীদের পুশব্যাক করতে বিরোধী দলের সাংসদের অনুমতির অপেক্ষায় থাকেন।' মি. অমিতের ব্যাখা হলো, তার সরকার তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নিলেই তো তারা ( মুসলিম নেতারা) গেল গেল বলে জিগির তোলেন!
আসাদ টুইট বার্তায় আরো লিখেছেন, তার (অমিত) নিজের দলই (বিজেপি) হায়দরাবাদে বেআইনি অনুপ্রবেশকারী থাকার কল্পকাহিনী তৈরি করেছে। সেখানে ওদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কিভাবে আমার সম্মতি চাইছেন তিনি। আসামেও নাকি ৪ লাখ 'উইপোকার' অস্বিস্ত আছে।'আসামের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনেও মিম ফ্যাক্টর আছে।
ভারতের মজলিশ-ই-ইত্তেহাদুল-মুসলেমিন (মিম) প্রধান ব্যারিস্টার আসাদউদ্দিন ওয়াইসি এমপি এর আগে বলেছেন, আসামের এনআরসি থেকে বিজেপির উচিত শিক্ষা নেয়া। ১৯ লাখেরও বেশি মানুষের নাম বাদ পড়ে, যার অধিকাংশই হিন্দু সম্প্রদায়ের । যদিও হিন্দুত্ববাদী বিজেপি নেতারা লাখ লাখ কথিত বাংলাদেশি মুসলিম অনুপ্রবেশকারীর কথা বলে রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গন উত্তপ্ত করেছিলেন।
সেসব উক্তির দিকে ইঙ্গিত করে মিম নেতা টুইটারে বলেন,' এগুলো সবই শাহের ছেলেমানুষি । তার উর্বর কল্পনাপ্রসূত এবং শুধুমাত্র ভোটের কথা মাথায় রেখেই।’

পর্যবেক্ষরা খেয়াল করছেন, ভারতে মিমকে ঘায়েল নয়, ঘায়েল চলছে অন্যকিছু। প্রশ্ন উঠছে, আবার অমিত শাহের মুখে সেই অনুপ্রবেশ নিয়ে খোচা। টার্গেট শিফটিং চলছে। যেন মুসলিমদের স্বার্থ দেখবে মুসলিম নেতারা।
ভারতের দিক থেকে ঘুরে কেন চীনের দিকে ঝুকেছে বাংলাদেশ, সেই প্রশ্ন বিশ্লেষণে ভারতের মিডিয়ায় এর আগে বলা হয়, অমিত শাহ বাংলাদেশীদের কথিতমতে 'কীটপতঙ্গ' বলে কটাক্ষ করেছিলেন। সেটাও দূরত্বের অন্যতম কারণ।
দীর্ঘ বিরতির পরে এখন নতুন করে আশংকা তৈরি হল, বাংলাদেশ কার্ডের খেলা হবেই ২০২১ সালের পশ্চিমবঙ্গে। এর পাল্টা আঘাত এবারে কংগ্রেস বা মমতা দিদি যতোটা দেবেন। মিমও দেবে।
অনেকের মতে আসাদুদ্দিন যেন কলিকালের জিন্নাহ। তবে জিন্নাহর কাধে দায়িত্ব বর্তেছিল মুসলিম লীগকে জেতানোর। কিন্তু কলিকালের জিন্নাহকে দায়িত্ব নিতে হবে কংগ্রেস এবং তৃণমূলের মুখরক্ষার।
উল্লেখ্য, ব্যালটে ভুল মুদ্রণের কারণে হায়দরাবাদে নির্বাচন আজ স্থগিত হলো। আগামী ৩ ডিসেম্বরে পুনরায় ভোট হবে। এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে তীব্র প্রচারের পর মঙ্গলবার গ্রেটার হায়দরাবাদ মিউনিসিপাল কর্পোরেশন ভোটে অংশ নিলেন ৭৪ লাখেরও বেশি ভোটার। কিন্তু ফলাফল যাই হোক বা না হোক, মূল আকর্ষণ হলো চার–পাঁচ মাস পরই পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন। এই নির্বাচনে জয় পেতে এমনকি হিন্দিভাষী বিজেপি নেতারা আচমকা বাংলায় কথা বলা শুরু করেছেন।
এখন বলা হয়, হায়দরাবাদ পৌর নির্বাচন এত তীব্র লড়াই আগে কখনও দেখেনি। বিজেপি তাদের প্রচারে এনেছে অমিত শাহ, জেপি নাড্ডা ও যোগী আদিত্যনাথদের। এই দৃশ্য শিগগিরই দেখা যাবে কলকাতায়। এখন তারই মহড়া চলছে।
অনানুষ্ঠানিক ক্যাম্পেইন শুরু অনেক আগেই। প্রেসিডেন্ট শাসন জারির ভয়ভীতি ভালোই দেখছে ওপার বাংলার মানুষ। ভারতের অন্য রাজ্যগুলো জিতার চেয়ে বাংলাজয়ের স্বাদই আলাদা। অনেকের মতে, বিজেপির দার্শনিক গুরু শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির রাজ্যে যে তারা আজও গেরুয়া নিশান উড়াতে পারল না, এটা কম দুঃখের নয়। আসন্ন নির্বাচন তাদের জন্য ভীষণরকম মর্যাদার লড়াই। বিজেপি রাজনীতি ও সংস্কৃতির বিজয় কেতন ওড়াতে চায়।
হায়দরাবাদে ভোটের ইস্যুগুলি রাস্তা, নিকাশি ব্যবস্থা, জল সরবরাহ, রাস্তার আলো ও প্রাথমিক পৌর পরিকাঠামো ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে – যে, হায়দরাবাদ তার নাম পরিবর্তন করে ভাগ্যনগর করতে চাইছে কি না, এবং তেলেঙ্গানার নতুন শাসকদল প্রয়োজন কি না। বিজেপির তেজস্বী সূর্য, বেঙ্গালুরু দক্ষিণের সাংসদ, বিভাজনকারী মন্তব্য করেছেন টিআরএস ও মিম-কে আক্রমণ করে। গত সপ্তাহে হায়দরাবাদের মুখ্যমন্ত্রীকে চন্দ্রশেখর রাও আবেগপূর্ণ ভাষায় মানুষকে আবেদন জানিয়েছেন, ‘শহরকে বিভাজনকারী শক্তির হাত থেকে বাঁচান”। তিনি নাম না করে বিজেপিকেই ইঙ্গিত করেছেন। হায়দরাবাদে মোট ১১২২ জন প্রার্থী লড়াইয়ে রয়েছেন। ৪টি জেলা জুড়ে ১৫০টি ডিভিশনে ভোট হচ্ছে। ফেব্রুয়ারি ২০১৬ তে বিগত পুর নির্বাচনে শাসক টিআরএস পেয়েছিল ৯৯টি আসন, মিম পেয়েছিল ৪৪টি, বিজেপি ৪টি, কংগ্রেস ২টি ও তেলেগু দেশম ১টি আসন পেয়েছিল।
আর পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু ভোটের সিংহভাগই পাচ্ছিল সিপিএম। সেটা ২০১১ সালের আগের কথা। এবারই বাংলায় বিধানসভা ভোটে লড়ার ঘোষণা করেছে এআইএমআইএম ওরফে মিম। নড়েচরে বসেছে সিপিএম ও কংগ্রেস । তারা ইতিমধ্যেই এনিয়ে বৈঠক করে ফেলেছে। মিডিয়ার খবর, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনায় বাংলাভাষী মুসলিমদের টার্গেট করেছে মিম। বাংলাভাষী মুসলিম প্রার্থী হলে তার ইতিবাচক প্রতিফলন তারা পাবে ভোট-যুদ্ধে। মালদহ, উত্তর ২৪ পরগনা ও দক্ষিণ ২৪ পরগনায়, মুর্শিদাবাদ, ও উত্তর দিনাজপুর, হাওড়ায় মিমের সংগঠন বাড়ছে। মিম মুখপাত্র বলেন, ''বিহারের পর আমাদের মূল লক্ষ্য পশ্চিমবঙ্গ। বিধানসভা ভোটে প্রার্থী দেব। ৩ বছর ধরে ওই রাজ্যে সংগঠনের জন্য পরিশ্রম করছি। ভোটে লড়ার জন্য সংগঠন তৈরি। বাংলায় আমাদের নেতাদের নাম ঘোষণা সময়ের অপেক্ষা মাত্র।''
বিহারে এর আগে ২০টি আসনে প্রার্থী দিয়েছিলেন আসাউদ্দিন ওয়াইসি। জিতেছেন ৫টি। ভোটের হার ১.২৪ শতাংশ। বাংলায় বহু আসনে নির্ণায়ক সংখ্যালঘু ভোট। জিনিউজ বলেছে, সেক্ষেত্রে মিম শেষপর্যন্ত বড় ভূমিকা নিতে পারে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। মালদহ, মুর্শিদাবাদ ও উত্তর দিনাজপুরে এখনও কংগ্রেসের সঙ্গে রয়েছে সংখ্যালঘু ভোট। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় সিপিএমের দখলেও কিছু সংখ্যালঘু ভোট এখনও অবশিষ্ট রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে মিম প্রার্থী দিলে সবটাই তালগোল পাকিয়ে যেতে পারে। মিমকে কীভাবে সামলে নেওয়া হবে, এনিয়ে ইতিমধ্যেই বৈঠকে বসেছে কংগ্রেস। আলিমুদ্দিনের রেডবেডেও আলোচনা হয়েছে বলে খবর। কংগ্রেস ও সিপিএমের কারো কারো অনুমান , মেরুকরণের ফায়দা তুলে নিতে পারে মিম ও বিজেপি। এক বামের মতে, কাটায় কাটায় লড়াই। সবাই রক্তাক্ত হবে। কাটাই টিকে থাকবে অক্ষত।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status