প্রথম পাতা

কান্নাপার্টির রমরমা খেলা

শুভ্র দেব

৩০ নভেম্বর ২০২০, সোমবার, ৯:৩৭ পূর্বাহ্ন

বৃহস্পতিবার বিকাল তিনটা। গাজীপুরের কালিয়াকৈরের ব্যবসায়ী শাহাদাত হোসেন সুজনের (৩০) মুঠোফোনে একটি রবি নম্বর থেকে ফোন আসে। ফোনের অপর প্রান্তের ব্যক্তি ব্যবসায়ী সুজনকে প্রশ্ন করে আপনার ছেলে কোথায়? ছেলে তো আমাদের কাছে। তারপর একটি বাচ্চা ‘আব্বু আব্বু’  বলে কান্না করতে থাকে। পরে কলকারী ওই ব্যক্তিটি বলে আপনার ছেলে রাস্তায় এসেছিল এখন সে আমাদের হেফাজতে আছে। আপনি যদি ৬০ হাজার টাকা দেন তবে আমরা গাড়িতে করে তাকে বাসায় দিয়ে আসবো। তখন সুজন বলেন- আমি কেন আপনাকে টাকা দেবো। তখন ওই ব্যক্তি বলে টাকা না দিলে আমরা আপনার বাচ্চাকে নিয়ে যাবো। সুজন তখন চিন্তিত হয়ে প্রথমে বাসায় ফোন দেন। কিন্তু বাসার কেউ তাৎক্ষণিক ফোন ধরেনি। পরে উপায়ান্তর না পেয়ে সুজন পরিচিত আরেক ব্যবসায়ীর মাধ্যমে ওই ব্যক্তির মোবাইল ব্যাংকিং নম্বরে ২০ হাজার টাকা পাঠান। তার কিছুক্ষণ পরেই সুজনের স্ত্রী ফোন দেয়ার পর কথা বলে তিনি নিশ্চিত হন তার ছয় বছর বয়সী শিশু সন্তান বাসায় নিরাপদে আছে। কিন্তু ঘটনার শেষ এখানেই হয়নি। ওই ব্যক্তি সুজনকে আবার ফোন করে আরো ১০ হাজার টাকা পাঠানোর কথা বলে। সুজন তখন তাকে বলেন আপনি রং নম্বরে ফোন করেছেন। আমার ছেলে বাসায় আছে। ওই ব্যক্তি তখন বলে ঠিক আছে আপনার টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছি। এরপর ওই ব্যক্তি তার মোবাইল ফোন বন্ধ করে দেন। আর সুজনের আর বুঝতে দেরি হয়নি তিনি প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়েছেন। এরা কান্না পার্টি হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। আর এভাবেই কান্নার অভিনয়ের মাধ্যমে এতোদিন রমরমা খেলা খেলে এসেছে। হাতিয়ে নিয়েছে লাখ লাখ টাকা।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের ওয়েব বেইজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিম ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা ও ত্রিশাল এলাকায় অভিযান চালিয়ে প্রতারক চক্রের দুই সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। প্রতারকরা হলো- মো. বিন ইয়ামিন (২৫) ও মো. এনামুল হাসান (৩২)। এই চক্রের আরেক সদস্য পলাতক রয়েছে। তাদের প্রত্যেকের বাড়ি ত্রিশাল এলাকায়। ডিবি এই প্রতারক চক্রের নাম দিয়েছে কান্নাপার্টি। কারণ এই চক্র বিভিন্ন মোবাইল অপারেটরের ভিআইপি নম্বরের মালিকদের ফোন দিয়ে বলে ‘আপনার সন্তান রাস্তায় হাঁটার সময় ধাক্কা মেরে আমার আইফোন ভেঙে ফেলেছে। এখন মোবাইল ঠিক করতে টাকা লাগবে। টাকা না পাঠালে আপনার সন্তানকে ছাড়বো না। বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের জন্য প্রতারক চক্রের একজন বাচ্চার কণ্ঠে কান্নাকাটি করে। সেই কান্নার সুর ফোনকলের মাধ্যমে ভিআইপি নম্বরের লোকদের   শোনানো হয়। অথবা তারা ফোন করে বিভিন্ন নম্বরের মালিকদের বলে আপনার সন্তান বাসার বাইরে চলে আসছে। এখন সে আমাদের কাছে আছে। টাকা পাঠালে তাকে বাসায় দিয়ে আসবো। ডিবিসূত্র বলছে, এই প্রতারকরা অফিসিয়াল টাইমেই কল করে। কারণ তারা আগে থেকেই জানে এই সময়টা ভিআইপি মোবাইল নম্বরের মালিকরা হয় অফিসে না হয় ব্যবসার কাজে ব্যস্ত সময় কাটায়। তারা এমনভাবে ফোন করে বাচ্চার কান্নাকাটি শোনায় যাদের সন্তান আছে তাদের আর ওই সময়টাতে কোনো কিছু যাচাই বা ঠিকমতো বাসায় যোগাযোগ করে খোঁজ করার চিন্তা মাথায় থাকে না। তাদের মানসিকতা সন্তান ছাড়া অন্যদিকে কাজ করে না। সন্তানের নিরাপত্তার স্বার্থেই প্রতারকরা যা বলে তাই শুনে।
ডিবি’র অভিযানিক টিমের সদস্যরা জানিয়েছেন, ব্যবসায়ী শাহাদাত হোসেন সুজনই নয় কান্নাপার্টির প্রতারণার শিকার হয়েছেন হাজারখানেক লোক। সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে বড় বড় অনেক ব্যবসায়ী। সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের বেশ কিছু অভিযোগ পেয়েই চক্রটিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ব্যবসায়ী সুজন প্রতারণার শিকার হওয়ার পর তিনি উত্তরার পশ্চিম থানায় একটি মামলা করেন। এ ছাড়া এর কিছুদিন আগে সরকারি এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে একইভাবে ফোন করে প্রতারক বিনিয়ামিন বলে ওনার ছেলে রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় তার আইফোন ভেঙে ফেলেছে। এখন ঠিক করার জন্য ৫০ হাজার টাকা পাঠাতে হবে। পরে ওই কর্মকর্তা তাদের দাবিকৃত টাকা পাঠান। পরে বাসায় খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন সন্তান বাসায় আছে। সে বাইরেও যায়নি, কারো ফোন ভাঙেনি। প্রতারকের খপ্পরে পড়েছেন বুঝতে পেরে তিনিও একটি জিডি করেন।
ডিবি জানিয়েছে, এই চক্রের মূলহোতা মো. বিন ইয়ামিন। তিনজনের এই চক্রে বিন ইয়ামিনই প্রতিদিন নীরব স্থানে বসে বিভিন্ন মোবাইল নম্বরে ফোন দেয়। ২০ থেকে ৩০ জন মানুষকে ফোন দিলে সেখান থেকে একজনকে ফাঁদে ফেলে। বাকিরা এসব ফোন পেয়ে তাকে পাত্তা দেয় না। চক্রের আরেক সদস্য মো. এনামুল হাসান বাচ্চা সেজে কান্না করে। পলাতক অন্য সদস্য টাকা সংগ্রহের কাজ করে। ডিবি জানায়, মূলহোতা বিন ইয়ামিন বাবার অভাবের সংসারে সে বেশিদূর লেখাপড়া করতে পারেনি। একবার ফুফুর বাড়িতে মরিচ চুরি করে ধরা খেলে ফুফুই তাকে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেয়। কিছুদিন পর জেল থেকে ছাড়া পেয়ে প্রায়ই চুরি করতো। ৮/১০ বছর আগে ত্রিশালের দিনার নামে এক বাড়ির দারোয়ানের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। দিনারের কাছ থেকেই বিন ইয়ামিন কান্নাপার্টির বিদ্যা অর্জন করে। ওই সময়টাতে দিনার তাকে দিয়ে বিভিন্ন নম্বরে ফোন করাতো। আর দিনার নিজেই কান্নাকাটি করে অভিনয় করতো। এভাবে তারা বেশ কিছুদিন একসঙ্গে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে। কিন্তু কিছুদিন পর বিন ইয়ামিন তার গুরু দিনারের স্ত্রীর সঙ্গে পরকীয়ার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে ধরা খায়। গুরুর কাছ থেকে সরে এসে পরে সে নিজেই বিভিন্ন প্রতারণামূলক কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। ২০১৬ সাল থেকে প্রতারণাকে পেশা হিসেবে নেয়। মাঝখানে কিছুদিন বিন ইয়ামিন অস্ত্র ও চুরির মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে জেলে যায়। এর বাইরে বাকি বছরগুলো একই প্রতারণা করে লাখ লাখ টাকা কামিয়ে আসছিল সে।
ডিবি’র অভিযানিক টিমের সদস্যরা জানান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে এই চক্রটি বহু বছর ধরে প্রতারণা করে আসছিল। একটি প্রতারণা করে সকল আলামত তারা নষ্ট করে ফেলতো। পুলিশ বা গোয়েন্দারা যাতে তাকে গ্রেপ্তার করতে না পারে সেজন্য তার বাড়ির চারপাশের সর্বত্রই সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছে। যেগুলো বিন ইয়ামিন ঘরের ভেতর থেকে মোবাইলের বিশেষ অ্যাপসের মাধ্যমে মনিটরিং করতো। বাড়ির আশেপাশে অচেনা কাউকে দেখলে সতর্ক হয়ে যেত। প্রয়োজনে পেছনের দরজা দিয়ে পালাতো। তাকে গ্রেপ্তারে রাতেও ডিবি সদস্যদের উপস্থিতি টের পেয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু অভিযানিক টিমের সদস্যদের কৌশলী অবস্থানের কারণে অন্ধকার রাতের অচেনা পথেও বহুদূর দৌড়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ডিবি’র ওয়েব বেইজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার আশরাফ উল্লাহ মানবজমিনকে বলেন, প্রতারক বিন ইয়ামিন এখন পর্যন্ত ৯টি বিয়ে করেছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। এ ছাড়া আরো ১৫/২০টি মেয়ের সঙ্গে তার বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক রয়েছে। একাধিক বিয়ে করায় তার বাবা তাকে তাজ্যপুত্র করেছেন। তিনি বলেন, প্রায় প্রতিদিনই বিন ইয়ামিন মানুষকে ফাঁদে ফেলে টাকা আদায় করতো। সর্বনিম্ন ২০ হাজার থেকে শুরু করে ৬০ হাজার টাকাও আদায় করতো। এই টাকা থেকে একটি ভাগ তার সহযোগীরা পায়। আর বাকি টাকা তার বিলাসী জীবন ও নারীর পেছনে খরচ করে। কারণ তার দুটোই শখ ছিল। একটি নারী ও অন্যটি টাকা উপার্জন। ত্রিশালের যে বাড়িতে আমরা অভিযান চালিয়েছি ওই বাড়িটি টিনের বেড়ার। অথচ টিনের বেড়ার আড়ালে লাখ লাখ টাকার আসবাবপত্র রয়েছে। ওই বাড়িটির পেছনে অন্তত দশ তলা ফাউন্ডেশনের একটি বাড়ির বেইজমেন্টের কাজ চলছে। বিন ইয়ামিন দাবি করেছে বাড়িটি তার বাবা তৈরি করছেন। তিনি আরো বলেন, সুনির্দিষ্ট বেশকিছু অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা এই চক্রটিকে গ্রেপ্তার করেছি। ভুক্তভোগীর সংখ্যা বেশি হলেও ঝক্কি-ঝামেলা এড়াতে থানায় কেউ অভিযোগ করেন না। প্রতারকদের কঠিন শাস্তি নিশ্চিত করতে ভুক্তভোগীদের সাহায্য প্রয়োজন। ভুক্তভোগীরা যদি মামলা করতে সহযোগিতা চান সেটি আমরা করবো। ভুক্তভোগীরা না বুঝে, যাচাই বাছাই না করে কেন টাকা পাঠান এমন প্রশ্নের জবাবে ডিবি’র এই কর্মকর্তা বলেন, যখন প্রতারকরা ফোন দিয়ে বাচ্চার বিষয়টি সামনে নিয়ে আসে আবার বাচ্চার কান্নাজড়িত কণ্ঠ শোনানো হয় তখন আর কোনো চিন্তা মাথায় কাজ করে না। এটা একটা সাইকোলজিক্যাল বিষয়। মাথায় যখন সন্তানের বিপদের বিষয় সামনে থাকে তখন বাচ্চা কান্না করছে না অন্য কেউ কান্নার নাটক করছে সেটি  বোঝা যায় না।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status